এমপিওভুক্তিতে ঘুষ লেনদেন তিন গুণ বেড়েছে, বিকেন্দ্রীকরণের পর - দৈনিকশিক্ষা

এমপিওভুক্তিতে ঘুষ লেনদেন তিন গুণ বেড়েছে, বিকেন্দ্রীকরণের পর

শরীফুল আলম সুমন |

এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নতুন শিক্ষকদের এমপিও পাওয়ার জন্য ঘাটে ঘাটে ঘুষ দিতে হয়। স্কুল থেকে ফাইলপত্র তৈরিতে প্রথমে নিম্নমান সহকারীকে ঘুষ দিতে হয়। এরপর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও আঞ্চলিক কার্যালয়ে ঘুষ দিতে হয়। সবচেয়ে বেশি ঘুষ দিতে হয় জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে। টাকা দিলেই অনলাইনে ফাইল পাঠানো হয়। নইলে নানা কারণ দেখিয়ে ফাইল আটকে দেওয়া হয়।

এমপিও (বেতন-ভাতার সরকারি অংশ) বিকেন্দ্রীকরণের পর আগের চেয়ে ঘুষ লেনদেনের পরিমাণ প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। টাইম স্কেল, সিলেকশন গ্রেড ও নানা বিষয় সংশোধনেও দিতে হয় ঘুষ। সব মিলিয়ে একজন শিক্ষককে নতুন এমপিও পেতে ঘুষ দিতে হয় ৩৮ থেকে ৫০ হাজার টাকা।

সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরে কোন অফিসে কত ঘুষ দিতে হয় তার বিস্তারিত বর্ণনা পাঠিয়েছেন যশোর জেলার ২০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান। তাঁরা ঘুষ বাণিজ্য বন্ধে মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুনের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। অভিযোগ আমলে নিয়ে মাউশি অধিদপ্তর বিষয়টি তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

মাউশি অধিদপ্তরের পরিচালক  (মাধ্যমিক) অধ্যাপক মো. এলিয়াছ হোসেন, ‘১২ এপ্রিল যশোর জেলার ২০ প্রতিষ্ঠানের প্রধানের লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে, শিগগিরই তদন্ত শুরু হবে। যারা ঘুষ বাণিজ্যে জড়িত, তাদের রেহাই দেওয়া হবে না। শিক্ষকরা যাদের ঘুষ দিয়েছেন সেটা সুনির্দিষ্টভাবে বললে তদন্ত করতে সুবিধা হবে।’

আগে শিক্ষকদের এমপিও সংক্রান্ত সব কাজই মাউশি অধিদপ্তর থেকে করা হতো। ফলে দূরদূরান্ত থেকে শিক্ষকদের কয়েকবার ঢাকায় আসতে হতো। মাউশির কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধেও ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ছিল। এ অবস্থায় গত বছরের মার্চ থেকে পর্যায়ক্রমে দেশের ৯টি আঞ্চলিক শিক্ষা কার্যালয়ে অনলাইনে এমপিও বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস ও জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের প্রয়োজনীয় কাজ শেষে এখন দুই মাস পর পর আঞ্চলিক শিক্ষা অফিস শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি দিয়ে থাকে। সারা দেশে বছরে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষক নতুন এমপিও পেয়ে থাকেন। এ ছাড়াও টাইম স্কেল, সিলেকশন গ্রেড পান আরো প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষক।

শিক্ষকদের অভিযোগ থেকে জানা যায়, নতুন এমপিওর ক্ষেত্রে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার মাধ্যমে পদ সৃষ্টি করতে ঘুষ দিতে হয় তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা, এরপর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস থেকে অনলাইনে ফাইল পাঠাতে ঘুষ দিতে হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। সবচেয়ে বেশি ঘুষ দিতে হয় জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে। ওই অফিসে প্রতিটি এমপিওর জন্য শিক্ষকদের দিতে হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। এভাবে খরচ হয় ৩৮ থেকে ৫০ হাজার টাকা।

শিক্ষকরা পরিসংখ্যান দেখিয়েছেন, আগে তাঁদের এমপিওপ্রতি ঘুষ দিতে হতো ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। আর এখন টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পেতে এবং বিভিন্ন বিষয় সংশোধনে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস থেকে ফাইল পাঠাতে ঘুষ দিতে হয় আট থেকে ১০ হাজার টাকা, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে দিতে হয় পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা। মোট ঘুষ দিতে হয় ১৩ থেকে ২০ হাজার টাকা। আগে এ কাজে দিতে হতো পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা। শিক্ষকদের ভাষ্য মতে, ঘুষ বাণিজ্য ও দুর্ব্যবহারে সবার ওপরে ঝিকরগাছা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা।

জানা যায়, আঞ্চলিক শিক্ষা কার্যালয়ের কর্মকর্তারা অনেক সময় সরাসরি ঘুষ নেন না। কর্মচারীদের দুই-চার হাজার টাকা দিতে হয়। তবে উপজেলা ও জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের নেওয়া ঘুষের একটা অংশ ঠিকই পৌঁছে দেওয়া হয় আঞ্চলিক কার্যালয়ে।

ঘুষ বাণিজ্যের ব্যাপারে আঞ্চলিক শিক্ষা কার্যালয়, খুলনার উপপরিচালক টি এম জাকির হোসেন বলেন, ‘ঘুষ গ্রহণের কিছু অভিযোগ আমরাও পেয়েছি। বিশেষ করে ঝিকরগাছা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বিকাশ চন্দ্রের বিরুদ্ধে বেশি অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাঁকে একই অভিযোগে কিছুদিন আগে কেশবপুর থেকে বদলি করে ঝিকরগাছায় দেওয়া হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সহকারী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলামকে দিয়ে এক সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।’

টি এম জাকির হোসেন আরো বলেন, ‘ঘুষ বন্ধ করতে আমরা এখন আবেদনের হার্ড কপি নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। সরাসরি স্কুলের প্রধান শিক্ষক অনলাইনে ফাইল পাঠিয়ে দেবেন আঞ্চলিক শিক্ষা কার্যালয়ে। শিক্ষকদের হয়রানি বন্ধ করতেই এমপিও বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে।’

তবে শিক্ষকরা বলেছেন, হার্ড কপি গ্রহণ বন্ধ করলেও ঘুষ বন্ধ থাকবে না। উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে টাকা না দিলে তাঁরা পদ সৃষ্টিতে ঝামেলা করবেন। এ ছাড়া অনলাইনে ফাইল পাঠানোর জন্য তাঁদের বিভিন্ন কাগজে সই নিতে হয়। আঞ্চলিক কার্যালয়ে অনলাইনে ফাইল পাঠানোর পরে তো তা ডাউনলোড করতে হবে। ঘুষ না দিলে বিভিন্ন কাগজের ঘাটতি দেখানো হয়। ঘুষ ছাড়া কোনো শিক্ষকের নতুন এমপিও হয়েছে, এমন নজির এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

যশোরের মণিরামপুর উপজেলার ঝাঁপা আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ বি এম শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘অবস্থার শিকার হয়ে ঘুষ দিতে হয়। কারণ একজন শিক্ষকের এমপিওর ফাইল যদি ছয় মাস আটকে থাকে তাহলে তিনি প্রায় ৮৪ হাজার টাকা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন। তবে আমরা এ ঘুষ দিতে চাই না। এ জন্যই এর প্রতিকার চেয়েছি।’

গত বুধবার মাউশি অধিদপ্তরে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক নাম প্রকাশ না করে  বলেন, ‘এক মাস আগে আমার স্কুলের দুজন শিক্ষক টাইম স্কেল পেয়েছেন। এ জন্য উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে প্রতিজনের জন্য পাঁচ হাজার টাকা করে দিতে হয়েছে। এরপর অন্যান্য অফিস তো আছেই। টাকা ছাড়া এমপিওর ফাইল তো নড়েই না।’

ঘুষের অভিযোগকারী যশোর জেলার ওই ২০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে রায়পুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ, নাভারণ কলেজ, হামিদপুর আল-হেরা ডিগ্রি কলেজ, রঘুনাথ নগর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মুক্তিযোদ্ধা ডিগ্রি কলেজ, এবিসিডি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, হাকিমপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, মাটশিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়, নেংগুড়াহাট মাধ্যমিক বিদ্যালয়, খেদাপাড়া পল্লী মঙ্গল বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, তপসীডাঙ্গা আলিম মাদ্রাসা, ঝাঁপা আলিম মাদ্রাসা, ওয়াদীপুর আলিম মাদ্রাসা, কালারহাট আলিম মাদ্রাসা, কৌটা ফাজিল ডিগ্রি কলেজ, কায়েমকোলা নেছারিয়া দাখিল মাদ্রাসা, ছাতিয়ানতলা দাখিল মাদ্রাসা, বালিয়াডাঙ্গা দাখিল মাদ্রাসা, নওয়ালী কাঁঠালতলা মাদ্রাসা ও বাগডোর দাখিল মাদ্রাসা।

সূত্র : কালেরকন্ঠ, ২২ এপ্রিল।

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0045130252838135