এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের কিছু বেদনার কথা - Dainikshiksha

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের কিছু বেদনার কথা

মো. ফজর আলী |

সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পণ্ডিত মশাই’ গল্পে পড়েছিলাম পণ্ডিত মশাই ক্লাসে ছাত্রদেরকে প্রশ্ন করলেন, ‘তিন ঠ্যাঙওয়ালা একটি কুত্তার পেছনে যদি মাসে পঁচাত্তর টাকা খরচ হয় তাহলে ঐ কুত্তার একটি ঠ্যাঙের পিছনে প্রতি মাসে কত খরচ হয়’? ছাত্ররা মনে করেছিল পণ্ডিত মশাই খুবই কঠিন অংকের প্রশ্ন করবেন। সহজ প্রশ্ন পেয়ে সবাই চিৎকার করে বললো, ‘পঁচিশ টাকা’। পণ্ডিত মশাই খুশি হলেন। এবার পণ্ডিত মশাই আরেকটি প্রশ্ন করলেন, ‘আমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা আট জন। আমি প্রতি মাসে বেতন পাই পঁচিশ টাকা। এখন তোমরা বলতো দেখি, ‘আমার পরিবার ঐ কুত্তার কয়টি ঠ্যাঙের সমান?’

ছাত্ররা সেদিন ঐ প্রশ্নের উত্তর দেয়নি বা দিতে পারেনি। পণ্ডিত মশাই ছিলেন উঁচু বর্ণের ব্রাহ্মণ। যে দিন তিনি জানতে পারলেন আসামের ছোট লাটের তিন ঠ্যাঙওয়ালা কুত্তার পেছনে প্রতি মাসে খরচ হয় পঁচাত্তর টাকা আর তার আট সদস্য বিশিষ্ট পরিবারের জন্য সরকার বাহাদুর বেতন দেয় পঁচিশ টাকা। সেই দিন তিনি লজ্জায়, ঘৃণায়, বেদনায় মর্মে মর্মে আত্মগ্লানিতে ভুগে মৃত্যুর যন্ত্রণায় ছটফট করেছিলেন।

পণ্ডিত মশাইয়ের সৌভাগ্য যে, তিনি সৈয়দ মুজতবা আলীর মত ছাত্র পেয়েছিলেন। আর তা পরবর্তীতে গল্পাকারে লিখে গিয়েছিলেন। ফলে আজকের প্রজন্মে আমাদের তা পড়ার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য হয়েছে।  বর্তমানে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের একই অবস্থা একজন সহকারি শিক্ষক বা সহকারি মৌলভী প্রারম্ভিক বেতন পান ১২,০০০ টাকা। তারপর সহকারি শিক্ষকগণ বিএড করলে পান ১৬,০০০ টাকা। সহকারি মৌলভী তারা কিন্তু বিএড করতে পারেন না।

আমরা পত্রিকা মারফত জেনেছি বর্তমান  আইন শৃঙ্খলাবাহিনী যে ‘ডগ স্কোয়াড’ ব্যবহার করা হয় তার পেছনে নাকি প্রতিমাসে লাখ টাকা খরচ করা হয়। পণ্ডিত মশাই যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে অবশ্যই ছাত্রদের প্রশ্ন করতেন তার পরিবার ঐ ‘ডগ স্কোয়াড’ এর কয়টি নখের সমান। বর্তমানে দাখিল, আলিম, ফাযিল, কামিল মাদ্রাসার ইবতেদায়ী বিভাগের শিক্ষকদের মাসিক বেতন ১০০০০ টাকা। আজকের দ্রব্যমূল্যের বাজারে এক বস্তা সাধারণ চালের মূল্য আড়াই হাজার টাকা। আট সদস্য বিশিষ্ট পরিবারে মাসে দুই বস্তা চাল খরচ হলে তার মূল্য দাঁড়ায় ৫০০০ টাকা। বাকি ৫০০০ টাকা চিকিৎসা, ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ, ডাল, মরিচ, হলুদ, পেঁয়াজ, আদা ইত্যাদি কিনে কীভাবে সংসার চালাবেন তা ভূক্তভোগী ছাড়া কেই বুঝেন না।

এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণ ২৫ শতাংশ হারে দুটি উৎসব ভাতা পেয়ে থাকেন। সে অনুযায়ী বর্তমানে একজন প্রভাষক পান ৫৫০০ টাকা, সহকারি শিক্ষক পান ৪০০০ টাকা, ইবতেদায়ী শিক্ষক পান ২৫০০ টাকা। সামনে ঈদুল আজহা আসছে। আপনারা বলুন তো এই পরিমাণ টাকা দিয়ে কোরবানীর জন্য একটা ছাগল হবে কিনা? এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সারা জীবনে একটি মাত্র ইনক্রিমেন্ট ছিল বর্তমানে সেটাও তুলে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া চাকরিকাল আট বছর পূর্ণ হলে টাইম স্কেল বা উচ্চতর গ্রেডে যাওয়ার সুযোগ ছিল যেটাকে শিক্ষকগণ সোনার হরিণ মনে করতেন। বর্তমানে সেটাও বন্ধ। এ ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের প্রতিবছর চক্রবৃদ্ধি হারে ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হচ্ছে কিন্তু এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণ তা হতেও বঞ্চিত হচ্ছে।

বর্তমানে শিক্ষকগণ বাড়ি ভাড়া বাবদ ১০০০ টাকা এবং চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা পান যা পূর্বে আরো কম ছিল। বর্তমান সরকার এই ভাতা দু’টি বৃদ্ধি করেছে এই জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। কিন্তু সময়ের তুলনায় সেটা কি খুব বেশি? জাতীর কাছে প্রশ্ন এক হাজার টাকায় বাড়ি ভাড়া তো দূরে থাক বস্তির একটা কুঁড়েঘর পাওয়া যায় কি? বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ব্যক্তিগত উদ্দ্যোগে বৈশাখী ভাতা চালু করেছেন সেখানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিসহ সরকারি স্কুলের শিক্ষকগণ পেলেও এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণ তা থেকে বঞ্চিত।

বাংলাদেশের ৯৭ ভাগ ছাত্র-ছাত্রী এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছে। মাত্র ৩ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী সরকারি স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করছে। সরকারের শিক্ষাক্ষেত্রে আজ যে সাফল্য তার সিংহভাগই এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের অবদান। তথাপি কেন জানি এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণ আজ সবক্ষেত্রে বঞ্চিত। বর্তমান সরকার শিক্ষার উন্নয়নে প্রত্যেক উপজেলায় একটি করে স্কুল ও কলেজ জাতীয়করণের ঘোষণা দিয়েছে। এটা সত্যিই প্রশংসনীয় একটি উদ্যোগ। কিন্তু অতীব পরিতাপের বিষয় দেশের এমপিওভুক্ত একটি মাদ্রাসাকেও জাতীয়করণের ঘোষণা দেওয়া হয়নি। বর্তমানে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা সিলেবাসের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই অথচ জাতীয়করণের ক্ষেত্রে দুই ধরণের নীতি পরিলক্ষিত। মাদ্রাসার শিক্ষকগণ কী অপরাধ করেছে? কেন তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে? তাহলে জাতির বিবেকের কাছে প্রশ্ন সরকার কি মাদ্রাসা শিক্ষাকে অন্য কোন দৃষ্টি ভঙ্গিতে দেখেছে?

আমরা অন্যভাবে বিষয়টি না দেখে সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রত্যেক উপজেলা থেকে একটি করে দাখিল, আলিম, ফাযিল ও কামিল মাদ্রাসা জাতীয়করণের ঘোষণা দেওয়া হোক। শিক্ষকগণ বিভিন্ন সময় তাদের দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করে থাকেন। ১৫তম জাতীয় বেতন স্কেল পাওয়ার দাবিতে শিক্ষকগণ আন্দোলনে গেলে এক সাংবাদিক বর্তমান মাননীয় অর্থমন্ত্রী মহোদয়কে প্রশ্ন করেছিলেন। জবাবে মাননীয় অর্থমন্ত্রী মহোদয় বলেছিলেন কীসের স্কেল তারা তো প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি নয়। মাননীয় মন্ত্রী চমৎকার জবাব দিয়েছিলেন। মন্ত্রী মহোদয় হয়তো সেদিন ভুলে গিয়েছিলেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি নয় কিন্তু প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি তৈরির মহান কারিগর। মন্ত্রী মহোদয় যদি শিক্ষকদের বেদনার কথা জানতেন তাহলে হয়তো ঐ মন্তব্য করার আগে শতবার ভাবতেন।

সর্বশেষ একটা সত্য গল্প দিয়ে শেষ করছি। গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস জনসাধারণকে শিক্ষা দিতেন। তিনি বাজারের প্রান্তে, রাস্তার মোড়ে, জন সমাবেশে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিতেন। তিনি সত্য বলতেন, সত্য বলার জন্যে জনসাধারণ বিশেষত যুবসমাজকে উৎসাহ দিতেন। সক্রেটিসের এই কর্মকাণ্ড তৎকালীন গ্রীক সরকারের পছন্দ হলো না। সরকারের অভিযোগ, তিনি যুব সমাজকে বিপথগামী করছেন। সুতরাং গ্রীক সরকার এই মহান দার্শনিককে মৃত্যুদণ্ড দিলেন। হেমলক নামক বিষ পান করিয়ে তাঁকে হত্যা করা হলো। সক্রেটিসের কী অপরাধ ছিল? তাঁর একমাত্র অপরাধ তিনি ছিলেন শিক্ষক।

লেখক: মাদ্রাসা শিক্ষক

হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0040299892425537