এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের দুঃখের অমানিশা কি পোহাবে না? - দৈনিকশিক্ষা

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের দুঃখের অমানিশা কি পোহাবে না?

মো. আবু হানিফ ভূইয়া |

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে প্রায় ৯৫% শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই হচ্ছে এমপিওভুক্ত বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা। এসব প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত ৪ লাখ ৭৭ হাজার ৩২০ জন এমপিওভুক্ত শিক্ষক সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত প্রাণী। একই যোগ্যতাসম্পন্ন, একই সিলেবাসের পাঠ্যবইয়ে পাঠদান করা এবং প্রতি বছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণে বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা যথেষ্ট এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক বেতন বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। যেমন-

১. একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক সরকার থেকে স্কেল অনুসারে ১০০% বেতনের পাশাপাশি বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা এবং উৎসব ভাতা যথাক্রমে ১ হাজার টাকা, ৫শ’ টাকা এবং মূল বেতন স্কেলের ২৫% পেয়ে থাকেন; কিন্তু তার মূল বেতন স্কেলের ৫% হারে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি, শিক্ষা ভাতা, বৈশাখী ভাতা এবং প্রভিডেন্ট ফান্ড কিছুই নেই। পক্ষান্তরে একজন সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তা বা সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষক মূল বেতন স্কেলের সঙ্গে ৫% হারে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি আকারে বেতন, শিক্ষা ভাতা, চিকিৎসা ভাতা ১ হাজার টাকা, বৈশাখী ভাতা, বাড়ি ভাড়া এবং উৎসব ভাতা যথাক্রমে বেতনের ২০%, ৪০% বা ৬০% এবং ১০০% পেয়ে থাকেন। সেই সঙ্গে তার প্রভিডেন্ট ফান্ডও চালু রয়েছে। অর্থাৎ একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষকের সঙ্গে একজন সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তা বা সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষকের দুটি ক্ষেত্রে মিল (স্কেল ও চিকিৎসা ভাতা) থাকলেও বাকি সব ক্ষেত্রে আকাশ-পাতাল ব্যবধান।

২. পদোন্নতির ক্ষেত্রে যেখানে সরকারি কলেজের শিক্ষকরা ‘প্রভাষক’ থেকে পদোন্নতি পেয়ে শিক্ষা ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ ‘অধ্যাপক’ পর্যন্ত আসীন হয়, সেখানে বেসরকারি কলেজের শিক্ষকরা ‘প্রভাষক’ থেকে শিক্ষা ক্যাডারের দ্বিতীয় ধাপ ‘সহকারী অধ্যাপক’ পর্যন্ত পদোন্নতি পেয়ে থাকেন, যা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক শিক্ষক সংখ্যার ৭:২ বা ৫:২ অনুপাতে। অর্থাৎ বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের ২৯ থেকে ৪০ ভাগ এ সুযোগটি পেয়ে থাকেন। বাকি ৬০ থেকে ৭১ ভাগ শিক্ষক ‘প্রভাষক’ পদে যোগদান করে সে পদে বহাল থেকেই অবসর গ্রহণ করেন। এমন ঘটনাও রয়েছে- এক কলেজে বাবা ‘প্রভাষক’ পদে চাকরিরত আর অপর এক কলেজে ছেলে বা ছেলের বয়সী সহকর্মী ‘সহকারী অধ্যাপক’ পদে উন্নীত হয়েছেন। এটা শিক্ষকদের জন্য অপমান ও লজ্জার বিষয় নয় কি? এ অবস্থায় একজন শিক্ষককে রবীন্দ্রনাথের গান ‘জেনে শুনে বিষ করেছি পান’ শোনা বা আওড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় আছে?

৩. দেশের গুটিকয়েক নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষকদের প্রভিডেন্ট ফান্ড, দক্ষতা-উন্নয়ন ভাতা, বাড়ি ভাড়া ও অন্যান্য ভাতাদি দিয়ে থাকলেও প্রায় ৯৯% এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই ছাত্রদের কাছ থেকে টিউশন ও উন্নয়নসহ অন্যান্য ফি নিয়ে থাকে, কিন্তু শিক্ষকদের আর্থিকভাবে সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে। অথচ টিউশন ফি পুরোটাই শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও উন্নয়ন ফি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন খাতে ব্যয় করার কথা। বাস্তব কথা- প্রতিষ্ঠান কত টাকা আয় করে এবং কত টাকা ব্যয় করে, শিক্ষকদের তা জানার কোনো অবকাশ নেই। কয়টা প্রতিষ্ঠান নিজস্ব তহবিল থেকে কলেজ অবকাঠামো উন্নয়নে খরচ করে, তা আমাদের সবারই জানা। উপরন্তু ফলাফল খারাপ হলে হুমকি-ধমকিসহ নানা আইন-কানুন করে শিক্ষকদের মানসিকভাবে চাপের মধ্যে রাখা হয়। মনে হয়, সমাজ বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকদের শিক্ষক হিসেবে তো নয়-ই, মানুষও মনে করে না।

৪. মাসিক বেতন প্রতি মাসের ১০ তারিখের মধ্যে শিক্ষকদের হস্তগত হবে, এমন সরকারি নির্দেশনা থাকলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানের অবহেলার কারণে শিক্ষকরা প্রায়ই যথেষ্ট দেরিতে মাসিক বেতন তুলে থাকেন। যেমন, গত জুন মাসের বেতন আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে তুলতে পেরেছেন। এর ফলে তাদের আর্থিক ও মানসিক কষ্টের সীমা থাকে না। উপরন্তু যেখানে প্রাপ্ত মাসিক বেতন দিয়ে একজন শিক্ষক তার সংসার চালাতে হিমশিম খায়, সেখানে অবসর ভাতা ও কল্যাণ তহবিল বাবদ মূল বেতন স্কেলের ৬% এর পরিবর্তে ১০% কেটে রাখা (আপাতত স্থগিত) ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ ছাড়া কিছুই নয়।

৫. এখানেই শেষ নয়, অবসর গ্রহণের পর ভোগান্তির মাত্রা আরও বাড়তে থাকে। ৪-৫ বছর পরও শিক্ষকরা তাদের শেষ অবলম্বন (অবসর ভাতা এবং কল্যাণ তহবিল)-এর যৎসামান্য টাকা হাতে পান না। এ দিনগুলো কীভাবে একজন শিক্ষক দিনাতিপাত করেন, আমরা কি তা ভেবে দেখেছি? অনেকে এ প্রাপ্য অর্থ না পেয়েই দুঃখজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন; আবার কেউ কেউ অসুখে-বিসুখে মৃত্যুশয্যায় শায়িত আছেন।

যে দেশের শিক্ষকরা এত অবহেলিত, সে দেশের শিক্ষা তথা জাতি উন্নত হতে পারে না। সরকার যেহেতু শিক্ষকদের ১০০% বেতন দিয়ে থাকে এবং প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়নে প্রায় ৮০% অবদান রাখে, কিন্তু প্রতিষ্ঠানকে সরকারি কোষাগারে কানাকড়িও জমা দিতে হয় না, তাহলে প্রতিষ্ঠানের এত আয় যাচ্ছে কোথায়? কথিত আছে, উন্নয়নসহ বিভিন্ন খাতে অবিশ্বাস্য ভাউচার জমা দিয়ে তহবিল লুটতরাজ চলে। যেমন, ১০ হাজার টাকা খরচের বিপরীতে ২০ হাজার টাকার ভাউচার জমা হয়। সুতরাং সরকারই পরোক্ষভাবে এ লুটতরাজের সুযোগ করে দিয়ে বেসরকারি স্কুল, কলেজের ব্যয় নিয়ে নানা অপ্রীতিকর বিবৃতি দেয়।

সরকার যদি বেসরকারি স্কুল, কলেজের সব আয় নিয়ে শিক্ষকদের চাকরি তথা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয়করণ করে, তাহলে প্রতিষ্ঠান যেমন অসাধুচক্রের জিম্মি দশা থেকে মুক্তি পাবে, তেমনি সরকারের শিক্ষা খাতে ব্যয়ভার কমবে এবং লাভ হবে। পাশাপাশি শিক্ষকরাও আর্থিক ও মানসিকভাবে প্রশান্তি লাভ করবেন এবং মর্যাদাবান হবেন।

প্রভাষক, অধ্যাপক আবদুল মজিদ কলেজ
রামচন্দ্রপুর, মুরাদনগর, কুমিল্লা

উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ ও ‘বিশ্ব বই দিবস’ - dainik shiksha স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ ও ‘বিশ্ব বই দিবস’ শিক্ষার মান পতনে ডক্টরেট লেখা বন্ধ জার্মান পাসপোর্টে - dainik shiksha শিক্ষার মান পতনে ডক্টরেট লেখা বন্ধ জার্মান পাসপোর্টে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0035490989685059