অতি সম্প্রতি দেশের কয়েক লাখ এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীকে অবশেষে নতুন স্কেলে বেতন দেয়া এবং বেতনের সাথে বকেয়া না দেয়া প্রসঙ্গে কবিতার নিম্নোক্ত চরণগুলো আজ অত্যন্ত তাৎপর্যময় ও প্রাসঙ্গিক –
‘বসুমতি, কেন তুমি এতই কৃপণা?
কত খোঁড়াখুঁড়ি করে পাই শস্যকণা।
দিতে যদি হয়, দে মা প্রসন্ন সহাস,
কেন এ মাথার ঘাম পায়েতে বহাস?’
কবি চাষীদের হয়ে পৃথিবীর বা মৃত্তিকার কাছে যে আকুতি তুলে ধরেছিলেন, তা যেন বহুদিন পর এসে আজ এমপিও শিক্ষকদের একান্ত মনের কথায় রুপান্তরিত হয়ে গেছে । যে কোন কবিতার আবেদন তাই চির শাশ্বত।
কার কাছে দুঃখ বলবেন কিংবা আবদার করবেন তাঁরা? এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের এমপিও এবং নন্ এমপিও শিক্ষকদের দুঃখ বলার জায়গা নেই। এ সব প্রতিষ্ঠানের অনেকটিতে দু’ ক্যাটাগরির শিক্ষক। কেউ এমপিওভুক্ত আর কেউ নন্ এমপিও। অবশ্য এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে নন্ এমপিও থাকেন এক বা দু’জন শিক্ষক। সারা দেশে এমনি অতিরিক্ত শ্রেণি শাখাপদে, সৃষ্টপদে এবং আইসিটি বিষয়ে কয়েক হাজার শিক্ষক বিধি মোতাবেক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েও আজ অবধি তাঁদের এমপিও নেই। বিনে পয়সায় অনেকেই চার পাঁচ বছর ধরে জাতি গঠনের পবিত্র গুরু দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তাঁদের পেট-পিঠ নেই বুঝি! মাত্র গুটি কয়েক লাইনের একটি গেজেট তাঁদের কপাল পুড়িয়েছে। ২০১১ সালের ১১ নভেম্বর তারিখের কালো গেজেটটি হাজার হাজার শিক্ষক ও তাঁদের পরিবার পরিজনের দুঃখের একমাত্র কারণ। কেবল তাই নয়, এটি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় আরেক কালো অধ্যায়।এর জন্য আজ একই প্রতিষ্ঠানে চাকরী করে কেউ সরকারি বেতন পান আর কেউ পান না। যারা পান, তাঁরা ও তাঁদের সহকর্মীর না পাবার বেদনায় প্রতি মাসে ব্যথিত হন, লজ্জাবোধ করেন। এ সব প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ তাঁদের নন্ এমপিও সহকর্মীর জন্য শান্ত্বনা দেবার ভাষা হারিয়ে ফেলেন।প্রতি মাসে অন্ততঃ একবার নিজের কাছে নিজেকে অনেকটা অপরাধী ও খাটো মনে করেন।
কার দোষে তাঁদের বেতন হয় না? কী তাঁদের অপরাধ? তাঁদের নিয়োগে তো কোন ত্রুটি নেই। এর ওপর আমাদের দেশে এমন অনেক স্কুল-কলেজ ও কারিগরি প্রতিষ্ঠান আছে, যেগুলো নিজেরাই আজো এমপিওভুক্ত হতে পারেনি। সেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারী এবং তাঁদের পরিবার পরিজনের দুঃখ-কষ্টের কথা কেউ কী কখনো ভাবে? এ সব স্কুল-কলেজ চলে কী করে?
এমপিও শিক্ষকদের মনে আজ অনেক কষ্ট। তাঁরা নতুন স্কেলে এ মাসে বেতন পেতে যাচ্ছেন। কিন্তু, বকেয়া এ মাসে পাচ্ছেন না। তাতে তাঁদের মনে অনেক বেদনা। তাঁদের দেনা অনেক। নতুন স্কেল ‘পাব-পাচ্ছি’ করে করে তাঁরা দেনা অনেক লম্বা করে ফেলেছেন। পাওনাদাররা চেয়ে থাকে তাঁদের হাত কিংবা পকেটের দিকে। কেবল তা-ই নয়, সন্তানের অনেক বায়না, স্ত্রীর হরেক রকম আবদার পূরণের প্রতিশ্রুতির তারিখটা ও ঘনিয়ে এসেছে। বৃদ্ধ মা-বাবার নিয়মিত ঔষধ আর ক’দিন বাকীতে চালানো যায়? আর ক’দিন পর ‘সাল-তামামি’ তথা বাংলা বছর সমাপ্তির দিন। পাওনাদারের বেঁধে দেয়া সর্বশেষ আলটিমেটাম একেবারে কাছে। দেনা পরিশোধ করতে না পারলে শিক্ষকের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে। সে দুশ্চিন্তা আজ তাঁদের খুব বেশী পেয়ে বসেছে। আরো তাঁদের অনেক দুশ্চিন্তা।
মানুষ গড়ার কারিগর আমাদের শিক্ষকদের অনেকে বোকা ভাবেন কী-না, কে জানে? তাঁরা একেক সময় একেক কথা বলে শিক্ষকদের ফাঁকি দেন। গত মাসে মাউশি থেকে বলা হলো যে, সকল হিসাব তারা সম্পন্ন করে রেখেছেন। কেবল অর্থ মন্ত্রণালয় টাকা ছাড় দিলেই তারা বকেয়াসহ শিক্ষকদের নতুন স্কেলে মার্চের বেতন দিতে পারবেন। এখন আবার ভিন্ন কথা। নতুন স্কেলের জিও জারীর দু’তিন দিন আগে শিক্ষামন্ত্রণালয় ও মাউশি থেকে বলা হলো, অর্থমন্ত্রণালয় টাকা ছাড় দিলে মাত্র এক সপ্তাহে সব ঠিকটাক করে বকেয়াসহ নতুন স্কেলে বেতন দেয়া যাবে। এর আগের মাসে অর্থমন্ত্রি ও মহাপরিচালক বিদেশে বলে চালিয়ে নেয়া হলো। এখন আবার মে মাস ছাড়া বকেয়া দেয়া সম্ভব নয় বলে মার্চের বেতন নতুন স্কেলে ছাড় দেয়া হয়েছে। দেশের আপামর এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী আজ নতুন স্কেলে বেতন পাবার আনন্দের চেয়ে বকেয়া না পাবার বেদনায় অধিক মর্মাহত।
অন্যান্যরা ডিসেম্বর মাসে বকেয়াসহ নতুন স্কেলে বেতন পেলেন। কিন্তু এমপিওভুক্তদের প্রতি কর্তাদের এতো অনীহা ও অবহেলা কেনো? তাঁদের নতুন স্কেল দেবার নাটকটি আপাততঃ শেষ হয়েছে। তাঁরা আশা করেছিলেন, একসাথে বকেয়াটি ও দিয়ে দিলে সব নাটকের অবসান হয়। এখন তাঁদের আশংকা, বকেয়া নিয়ে আবার যেন কোন নাটক শুরু হয়? ‘দেব- দিচ্ছি’ করে আবার কত দিনই বা যায়-কে জানে? সামনে আসছে বাজেট। টাকা পয়সা নিয়ে কত টানাটানি শুরু হবে। এ খাত থেকে সে খাতে আর সে খাত থেকে এ খাতে টাকা আসবে আর যাবে। নিরীহ শিক্ষকদের টাকা ভিন্ন খাতে নিতে তো আর কাউকে জিজ্ঞেস করতে হয় না। এ ভাবেই এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের কল্যাণ ট্রাস্ট ও পেনসন সুবিধা তহবিলের টাকা এদিক থেকে সেদিক যায় বলে শুনা যায়। প্রতিমাসে কেবল শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন থেকে এ দু’ তহবিলের জন্য অনেক টাকা কর্তন করে রাখা হয়। এভাবে বছরে কত টাকা-ই না জমা হয়। বছরে আর ক’জন শিক্ষক-কর্মচারী অবসরে যান? কিন্তু তহবিলে কেবল টাকা নেই আর নেই। টাকা যায় কোথায়? কল্যাণ ট্রাস্ট ও পেনসন সুবিধার টাকা না পাবার কষ্ট বুকে নিয়ে কত শিক্ষক-কর্মচারী যে ইতোমধ্যে পরপারের বাসিন্দা হয়েছেন-তা একমাত্র আল্লাহই জানেন।
গত জুলাই মাসের পর আজ অবধি অনেক এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী অবসরে চলে গিয়েছেন। এমপিও থেকে তাঁদের নাম বাদ পড়েছে। মাউশিতে এ একটা কাজ মানে এমপিও থেকে নাম কর্তন কোন তদবির ছাড়াই হয়। এখন তাঁদের বকেয়াটা তাঁরা পাবেন কী করে? তাঁদের কেউ দু’মাস, কেউ চার মাস কিংবা কেউ ছয় মাস নতুন স্কেলের মেয়াদে কাজ করে অবসরগামী হয়েছেন।
এখন দয়া করে আমাদের মাউশি’র সংশ্লিষ্ট বিভাগ যদি গত জুলাই মাসের পর যিনি যত মাস চাকুরী করে অবসরে গিয়েছেন, তাঁদের বকেয়াটা ও সকলের সাথে দিয়ে দেয় -তবে এ সব অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারী ও তাঁদের পরিবার পরিজন সীমাহীন কৃতার্থ হবেন। অন্যথায় এ দুঃখ নিয়ে তাঁদের অনেককে ও কবরবাসী হতে হবে। এমনিতে তো কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা পেতে তাঁদের যে কত কাঠ-খড় পোড়াতে হবে, সে কেবল ভুক্তভোগীই জানেন। গত জাতীয় স্কেলসমূহে এ ভাবে অনেক শিক্ষক-কর্মচারী তাঁদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তাঁদের খোঁজ খবর আজ পর্যন্ত আর কেউ করেনি।
এপ্রিলের বেতনের সাথে মে মাসে বকেয়া দেয়া হবে-তাতে কতটুকুইবা আস্থা আনতে পারেন এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীগণ। সবকিছুতেই তাঁরা দেখে আসছেন, ‘ডালমে কুচ্ কালা হ্যায়।
কয়েক মাস আগে শুনা গেল, সৃষ্টপদে এমপিও দেবার সিদ্ধান্ত হয়েছে। অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষা বিষয়ক দেশের একমাত্র জাতীয় পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডটকম মারফত আইসিটি পদে এমপিওভুক্তির জন্য নির্বাচিত আইসিটি শিক্ষকদের তালিকা জেলাওয়ারি ধারাবাহিক প্রকাশ হতে দেখা গেল কয়েকদিন। এরপর আর খবর নেই। কোন অদৃশ্য তেলেসমাতিতে হাবুডুবু খাচ্ছেন দেশের আইসিটি শিক্ষকগণ? মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে আইসিটি এখন আবশ্যিক বিষয় । এখন সকল স্কুল- কলেজে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে প্রজেক্টরের সাহায্যে পাঠদানের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে । আইসিটি শিক্ষকদের উপোস রেখে তা কতটুকু সম্ভব হবে? শুনা যাচ্ছে ই-বুক চালু হবে, শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তে ট্যাব দেয়া হবে -এ সব কারা বাস্তবায়ন করবেন?
আমাদের দেশে এমপিও শিক্ষকদের অনেক কষ্ট। নন্ এমপিওদের তো দুঃখের সীমা নেই। শিক্ষকতায় এসে অনেকে ভাবেন, এ তাঁদের আজন্ম পাপের প্রায়শ্চিত্ত কী-না? একজন শিক্ষকের এ উপলব্ধিটুকু মোটেও কাম্য নয়। এ ভাবে হলে কেউ আর কোনদিন শিক্ষকতায় আসতে চাইবে না। শিক্ষক কেবল মানুষ গড়ার কারিগর নন, দেশ ও জাতি গড়ার কারিগর ও বটে।
শিক্ষক যদি মাথা উঁচু করে চলাফেরা করতে না পারেন, জীবন ও জীবিকার তাগিদে তিনি যদি অন্যদের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হন-তবে তাঁর হাতে গড়া মানুষ, দেশ কিংবা জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে কী করে?
এমপিও শিক্ষকদের বকেয়া নিয়ে যেন আর কোন তেলেসমাতি না হয় এবং সৃষ্টপদের ও আইসিটি শিক্ষকদের এমপিও যেন অবিলম্বে ছাড় দেয়া হয় – সে কামনাটুকু আমাদের সবার।
লেখক : অধ্যক্ষ , চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ কানাইঘাট , সিলেট ।