এমপিও শিক্ষকের হতাশার বাজেট এবং কষ্টের ঈদ আনন্দ - Dainikshiksha

এমপিও শিক্ষকের হতাশার বাজেট এবং কষ্টের ঈদ আনন্দ

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |
mujjam sir
অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী

দেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীগণ দেশ ও জাতির বোঝা কী-না, কে জানে! মনে হয় যেন শিক্ষকতা পেশায় এসে তাঁরা তাঁদের আজন্ম পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে চলেছেন দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা। তাঁরা পরিবার-পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশী এমনকি নিজেরা পর্যন্ত নিজেদের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হন কখনো কখনো। একজন শিক্ষকের সর্বদা মাথা উঁচু করে চলাফেরা করবার কথা কিন্ত আমাদের দেশে এমন চলাফেরা করতে পারেন ক’জন এমপিও শিক্ষক? আত্মসম্মান ও নিজের ব্যক্তিত্বটুকু বাঁচিয়ে জীবন পরিচালনা করতে না পারলে একজন শিক্ষকের মর্যাদা থাকে কোথায়? আর এমন পরিস্থিতিতে একজন শিক্ষক জাতি গঠনের গুরু দায়িত্ব কতটুকুই বা সম্পন্ন করতে পারেন? রাষ্ট্র যদি অন্ততঃ শিক্ষকদের মাথা উঁচু করে মর্যাদার সাথে জীবন যাপনের সুযোগ করে দিতে না পারে, তবে জাতির মেরুদন্ড মজবুত কিংবা সোজা হবে কী করে? একজন উপোস কিংবা উদ্বিগ্ন কারিগর কী করে কোনকিছুর শক্ত ভিত রচনা করতে পারেন?

জুন মাস আমাদের জাতীয় বাজেটের মাস। প্রতি বছর এ মাসে এক বছরের রাষ্ট্রীয় আয়-ব্যয় জাতির সামনে তুলে ধরা হয়। মহান জাতীয় সংসদে মাননীয় অর্থমন্ত্রি তাঁর বাজেট বক্তৃতা উপস্থান করেন। তাঁর প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর মহান সংসদে মাননীয় সদস্যগণ অংশগ্রহণ করে আলোচনা-সমালোচনায় মেতে ওঠেন। এরপর প্রয়োজনীয় কাটছাট করে তা সংসদে পাশ হবার পর সে আলোকেই জাতি একটা বছরের জন্য সামনের দিকে এগুতে থাকে। ভবিষ্যতের যে কোন কর্মপরিকল্পনার বীজ তাতে রোপন করা হয়।

বাজেটে জাতির আশা আকাংখা ও পরিকল্পনা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। তাই প্রতিবছর জুন মাস ঘিরে দেশের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার লোকজনের কৌতুহলের শেষ থাকে না। নতুন কিছু পাবার প্রত্যাশা থাকে নানা পেশার মানুষের। শিক্ষক কিংবা শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলেই ফি বছর প্রত্যাশা করেন, এ খাতে বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি পাবে। এ জন্য বাজেট উপস্থাপনের পূর্বে তারা বাজেট সংক্রান্ত বিভিন্ন ডায়লগে অংশ গ্রহণ করে কিংবা সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধনের মাধ্যমে বিষয়টি সরকারের নজরে এনে থাকেন। সরকার ও প্রতি বছর শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দের কথা বলে। কিন্তু কোথা যায় সে সব বরাদ্দ? জাতীয় বাজেটে জিডিপি’র ১৬% বরাদ্দের দাবি সে তো অনেক পুরনো। কিন্তু, কেন জানিনে আমাদের সরকারগুলো এখনো তা ২%-৩% এর উপরে নেয়নি কিংবা নিতে চায়নি।

বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকারের প্রতি শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবার বিশেষ করে এমপিও শিক্ষকদের প্রত্যাশা সঙ্গত কারণে অনেক বেশী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রি শিক্ষা খাতের ব্যয়কে ”সর্বোৎকৃষ্ট বিনিয়োগ” বলে মন্তব্য করায়, স্নাতক পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক করার মনোভাব ব্যক্ত করায় এবং বেসরকারি স্কুল-কলেজ জাতীয়করণে সর্বমোট ব্যয় জানতে চাওয়ায় এবারের বাজেটে শিক্ষা খাতে বিশেষ করে এমপিও শিক্ষকদের বেলায় বরাদ্দ বৃদ্ধির বিষয়ে দেশবাসীর সাথে দেশের সাড়ে পাঁচ লক্ষ এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীর প্রত্যাশা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছিল।

দেশে এমপিওভুক্তি বেশ ক’বছর ধরে বন্ধ। এমপিও বিহীন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার দৈন্যদশা কে দেখে? তাদের শিক্ষক-কর্মচারীরা নিজেদের পরিবার পরিজন নিয়ে বছরের পর বছর মানবেতর জীবন যাপন করে আসছেন। সৃষ্টপদে আইসিটি, ব্যবসায় শিক্ষা, উৎপাদন ও বিপনন শিক্ষকদের এমপিও নেই আজ অনেকগুলো বছর ধরে। তাঁরা বিভিন্ন উপায়ে তাঁদের দুঃখ-দূর্দশা ও দূর্ভোগ তুলে ধরার চেষ্টা করে সর্বশেষ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট কিংবা জাতীয় প্রেস ক্লাবে গিয়ে কতো কাকুতি মিনতি করে ও কোন ফল পাননি। তাঁদের খবরটুকু কেউ রাখে না। তাঁদের বুঝি কোন মানবিক চাহিদা নেই?

স্কুল-কলেজে স্থান সংকুলান হচ্ছে না আজকাল। নতুন শ্রেণি শাখা খোলার পথ রুদ্ধ। প্রতিটি ইউনিয়নে এখন কমপক্ষে পাঁচটি মাধ্যমিক ও অন্ততঃ একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা দরকার হয়ে পড়েছে। না হয় আমাদের সন্তানেরা কোথায় গিয়ে লেখাপড়া করবে? নাকি কৌশলে এ প্রজন্মকে কোচিংসেন্টারগামী করা হচ্ছে? আমাদের পাঠ্যপুস্তকে সিলেবাস ও কারিকুলামের সমন্বয় না থাকায় আমাদের শিক্ষার্থীরা মূল বই ফেলে রেখে নোট-গাইড আঁকড়ে ধরে বসেছে। সাধারণ শিক্ষায় চারুকারু, শারীরিক শিক্ষা, ইতিহাস, ক্যারিয়ার শিক্ষা-ওসব পড়ে কী হবে? এ সব বিষয়ের কোন শিক্ষক তো স্কুল- কলেজে নেই। এ সময়ে আইসিটি’র গুরুত্ব সর্বাধিক। কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর নেই। প্রয়োজনে সাধারণ শিক্ষা সীমিত করে আইসিটি ও কারিগরি শিক্ষা প্রসারের উদ্যোগ নেয়া অপরিহার্য। কিন্তু হায়! আমাদের বাজেটে এ সবের কোন ঈঙ্গিত নেই। তাই দিনে দিনে ঘুণে ধরে এখন পোকায় খেতে শুরু করেছে আমাদের।

সাড়ে পাঁচ লাখ এমপিও শিক্ষকের বেশ কতকগুলো মৌলিক সমস্যার সুরাহা নেই অনেক দিন ধরে। তাঁদের বাড়ি ভাড়া কোন্ হিসেবে দেয়া হয়? ১০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা ! বস্তিতে ও তো ৫০০ টাকায় এক মাস থাকা যায় না। আজকাল একজন অখ্যাত ডাক্তারের ও একবারের ভিজিট ফি যেখানে ৫০০ টাকা, সেখানে ৩০০টাকা চিকিৎসা ভাতা দেয়ার চেয়ে না দেয়াটাই তো ভাল ছিল। মুমুর্ষূ একটা ইনক্রিমেন্ট যা-বা ছিল, তা এখন নেই। টাইমস্কেল তো এখন সমাধির নীচে। এমপিও শিক্ষকরা সারা জীবনে একটা-ই পেতেন। এখন তাঁদের বেলায় ৫% বার্ষিক বৃদ্ধির বিষয়ে নীরবতা কেন? নাকি তাঁদের সরকারের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেবার কৌশল হিসেবে এ নীরবতা? বৈশাখি ভাতা জাতীয় স্কেলের অন্তর্গত সকলে পেলো। এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের অপরাধটা কী? তাঁদের পেনসন ও কল্যাণ ট্রাস্ট সুবিধা পেতে কতো যে অসুবিধা পোহাতে হয়। ভাগ্যিস, এ বাজেটে ৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কী হবে ৬০০ কোটি টাকায়? উপোস মানুষের সামনে একমুঠো ভাত -এ আর কী!

নতুন নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, পুরনো এমপিওবিহীন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তিকরণ, বিধিমতে নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করা, এমপিও শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা যৌক্তিক হারে বৃদ্ধি করা, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি (৫%), বৈশাখি ভাতা, উৎসব ভাতা এবং সর্বোপরি বেসরকারি শিক্ষকদের চাকুরি জাতীয়করণ ইত্যাদি বিষয়ে নির্দেশনাসহ এবারের বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দের প্রত্যাশা ছিল সকলের।

কিন্তু বাজেটে এসবের কোন প্রতিফলন ঘটেনি। আমাদের শিক্ষা খাতে যতো উন্নয়ন সে তো কেবল ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন, বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক প্রদান, উপবৃত্তি ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ খাতে। তাতে পুকুর চুরির বিস্তর সুযোগ। শিক্ষকদের চাকুরি জাতীয়করণ হলে তাতে তৃতীয় পক্ষের লাভের সুযোগ কোথায়? তাই, এ দেশের আপামর এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীগণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রির কথাবার্তায় বারবার আশান্বিত হলেও এরা তাঁদের আশাহত করে কষ্ট দিতে সদা তৎপর।

পবিত্র রমজান মাসের প্রথম সপ্তাহ চলমান এখন। রমজান মাসে সঙ্গত কারণে সকল মুসলিম পরিবারে খরচ অনেকটা বেশী পড়ে। এ ছাড়া জিনিসপত্রের দামে আগুন লেগে থাকে। তাই প্রায় সকলেই রমজান আসতে না আসতে পুরো রমজানের খরচ সেরে ফেলে। তাতে তাদের কিছুটা আর্থিক সাশ্রয় হয়। কিন্তু, দেশের সাড়ে পাঁচ লাখ এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীর পরিবার সে কাজটা করতে পারেন নাই। জুন মাসের এক সপ্তাহ গত হবার পর রমজান মাস এলে ও তাঁরা তাঁদের মে মাসের বেতন আজ অবধি পান নি। আট মাসের বকেয়া এক সাথে পাবার হিংসায় জ্বলে যারা তাঁদের পবিত্র রমজানের অগ্রীম বাজার করতে দেবার সুযোগটা দেয় নাই, তারা মানুষ না শয়তান? এ সব শয়তানের কারণে নিশ্চয় ইফতার ও সেহরিতে নানা ঘাটতি হচ্ছে অনেক শিক্ষক-কর্মচারী ও তাঁদের পরিবার পরিজনের। অনেক কষ্টে কেউ কেউ তাঁদের রমজানের সিয়াম সাধনা চালিয়ে যাচ্ছেন।

পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর অত্যাসন্ন। দীর্ঘ এক মাসের রমজান শেষে ঈদ আসে আনন্দের বার্তা নিয়ে। যে কোন স্বল্প আয়ের মানুষের দায়-দেনা রমজান মাসে বেড়ে যায়। ফেতরা দিয়ে গরীবের কষ্ট লাঘবের ধর্মীয় নির্দেশ। সন্তান-সন্ততি, পরিবার পরিজন ও নিকট আত্মীয়দের জন্য ঈদে নতুন জামা কাপড় কিনে দেয়া চিরায়ত এক রেওয়াজ। ঈদ খুশী আর আনন্দের দিন। এ দিনে ভাল খাবার দাবার তৈরি করে নিকটজনকে খাওয়ানো চিরন্তন আরেক রীতি বিশেষ। স্ত্রী-সন্তান , ছোট ভাইবোন কিংবা বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ভিন্ন চাওয়া ও এ সময় থেকে থাকে। বেচারা এমপিও শিক্ষক! ঈদে বোনাস ক’টাকা পান? মাত্র বছর কয়েক থেকে তাঁরা বেতনের ২৫% উৎসব ভাতা পেয়ে আসছেন। তাতে আর ক’টাকা হয়? ঈদ আনন্দকে খন্ডিত করে দেবার এ কেমন নির্মম প্রয়াস? দূর্মূল্যের বাজার। ২৫% উৎসব বোনাস ঈদের আনন্দের চেয়ে তাঁদের কষ্টকেই বাড়িয়ে দেয়। নিজের প্রতি এক ধরণের অবজ্ঞা নিজেকে নিজের কাছে ছোট করে ফেলে।

আর কত ছোট হয়ে থাকবেন আমাদের মানুষ গড়ার কারিগরেরা? যে জাতির কারিগরেরা যথার্থ মূল্যায়ন পায়না, সে জাতির আত্ম সম্মান ও আত্ম মর্যাদা বোধ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক।

লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট।

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0053019523620605