অবশেষে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে সরকার। এখন শুধু কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে-ই-হাদিসকে (স্নাতকোত্তর) স্বীকৃতি দেওয়া হবে। সরকারের কোনো প্রতিনিধি ছাড়াই মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষগুলোর করা কমিটির অধীনে পরীক্ষা নিয়ে এই সনদ দেওয়া হবে। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষগুলোর চাওয়া অনুযায়ী এই প্রক্রিয়ায় স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও মাদ্রাসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্রগুলো বলেছে, গত ২৮ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় সনদের স্বীকৃতির বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়। আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কওমি মাদ্রাসার বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎ হওয়ার কথা রয়েছে।
বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ আইন পর্যালোচনা কমিটির আহ্বায়ক ও ইকরা বাংলাদেশের পরিচালক মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি গত রোববার বলেন, তাঁরা আশা করছেন ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতির বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবেন। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে তিনি বলেন, দাওরায়ে-ই-হাদিসের স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে সবাই একমত হয়েছেন। এ জন্য মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষগুলোর সমন্বয়ে করা একটি
কমিটি পরীক্ষা নেবে। এর ভিত্তিতে সনদ দেওয়া হবে। এই কমিটিতে কোনো সরকারি প্রতিনিধি থাকবেন না। তবে কওমি মাদ্রাসার অন্যান্য স্তরের শিক্ষা সনদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের (বেফাক) প্রতিনিধিরাও প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন বেফাকের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক।
জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম গত রোববার বলেন, কমিটিতে যদি সরকারের প্রতিনিধি না থাকেন, তাহলে সেটা কার্যত শিক্ষার্থীদের স্বার্থের পরিপন্থী হবে। এতে ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীরাই সমস্যায় পড়বেন। এ জন্য সরকারের প্রতিনিধি, শিক্ষাবিদসহ সবাইকে নিয়ে একটি ভারসাম্য কমিটির মাধ্যমে কাজটি করতে হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য জাগতিক শিক্ষারও ব্যবস্থা থাকতে হবে।
গত ২৮ মার্চের ওই সভায় উপস্থিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকার চেয়েছিল কওমি মাদ্রাসার নিচের স্তর থেকে ধারাবাহিকভাবে স্বীকৃতি দিতে। কিন্তু মাদ্রাসাগুলোর কর্তৃপক্ষ তা মানতে রাজি হয়নি। তারা শুধু দাওরায়ে-ই-হাদিসের স্বীকৃতি চায়। এর যুক্তি হিসেবে তারা বলেছে, বিদেশে চাকরি পেতে সুবিধা হবে। পরে এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কোনো আপত্তি তোলেননি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, দাওরায়ে-ই-হাদিস যেহেতু স্নাতকোত্তর স্তর, তাই সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রতিনিধি রাখার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হলে তাতেও মাদ্রাসাগুলোর কর্তৃপক্ষ রাজি হয়নি। তারা নিজেদের করা কমিটির মাধ্যমেই স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে জোরালো অবস্থান নেয়। পরে তাতে রাজি হয় মন্ত্রণালয়। ওই কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি যেহেতু সরকারের উচ্চমহল থেকে দেখভাল করা হচ্ছে এবং সভায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন, তাই তাঁরা আর কোনো আপত্তি করেননি। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় মাদ্রাসাগুলোর প্রায় সব পক্ষই উপস্থিত ছিল। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির আল্লামা শাহ্ আহমদ শফীর ছেলে মাওলানা আনাস মাদানী ছিলেন।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বিগত সরকারের শেষ দিকে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ জন্য ‘বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ’ গঠনেরও সিদ্ধান্ত হয়েছিল। প্রস্তাবিত এই কর্তৃপক্ষ গঠন করার ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিনিধি রাখার কথা ছিল। কর্তৃপক্ষ গঠনের জন্য আইনের খসড়া অর্থ, জনপ্রশাসন ও প্রশাসনিক উন্নয়ন-সংক্রান্ত সচিব কমিটির সভায় অনুমোদন শেষে মন্ত্রিসভার বৈঠকেও উত্থাপন করা হয়। কিন্তু খসড়াটি আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ফেরত পাঠানো হয়। মূলত মাদ্রাসাগুলোর সবাই একমত না হওয়ায় এবং রাজনৈতিক কারণে তা পিছিয়ে যায়।
জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গত রোববার বলেন, সরকার সব ক্ষেত্রেই কওমি মাদ্রাসাগুলোকে সহযোগিতা করতে চায়। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীও ইতিবাচক।
ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার আদলে ১৮০০ সালের শেষের দিকে এ দেশে কওমি মাদ্রাসার গোড়াপত্তন হয়। দেশে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার প্রাক্-প্রাথমিক স্তর শুরু হয় শিশুর চার-পাঁচ বছর বয়স থেকে। সর্বোচ্চ স্তর হলো দাওরায়ে-ই-হাদিস। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা বোর্ড এই স্তরকে সাধারণ শিক্ষার স্নাতকোত্তর ডিগ্রির সমমান বলে।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী সারা দেশে ১৩ হাজার ৯০২টি কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। বেশির ভাগ মাদ্রাসাই মফস্বল এলাকায় অবস্থিত। লাখ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করলেও এখনো এর কোনো সরকারি স্বীকৃতি নেই।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান বলেন, কওমি শিক্ষাকে সরকার স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে, এটা ভালো। কিন্তু যদি সরকারি স্বীকৃতি দিতে হয়, তাহলে সরকার-নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষাক্রম তৈরি করে তার আলোকে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে (স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তর হলে) দিতে হবে। তা না হলে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
সৌজন্যে: প্রথম অালো