কপিরাইট সংরক্ষণের পদক্ষেপ নিতে হবে - Dainikshiksha

কপিরাইট সংরক্ষণের পদক্ষেপ নিতে হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক |
অমরত্বের বাসনা মানুষের মজ্জাগত। এ কারণেই মানুষ বংশবিস্তার, সম্পদ বিস্তার ও রক্ষণের মাধ্যমে দেহনাশের পরও জগতে প্রাসঙ্গিক থাকতে চায়। আর সৃষ্টিশীল মানুষ সৃজনকর্মের মাধ্যমে অমরত্বের বাসনাকে জাগরূক রাখে। কিন্তু দেহনাশের পর বস্তুগত সম্পদ রক্ষায় বংশধরদের যতটা আগ্রহ থাকে, সৃজনকর্ম বিশেষত পুরনো পাণ্ডুলিপি, দলিল, দস্তাবেজ রক্ষণে উত্তরসূরিদের তেমন নজর থাকে না। তাই সৃজনকর্ম সরক্ষণ এবং এ থেকে প্রাপ্তিযোগ নিশ্চিত করতেই কপিরাইট ধারণার উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে।
উন্নত দেশের প্রাগ্রসর চিন্তার মানুষদের মস্তিষ্কজাত দূরদর্শী চিন্তন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৮৮৩ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত কনভেনশনে পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন, জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন ইত্যাদির মাধ্যমে সৃষ্টিশীল মানুষের আর্থিক ও নৈতিক অধিকারপ্রাপ্তির বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। বাংলাদেশসহ ১৭৩টি দেশ এ কনভেনশনের সঙ্গে সহমত পোষণ করে এতে অনুস্বাক্ষর করে।
বাংলাদেশ সৃষ্টির আগেই ১৯৬২ সালে কপিরাইট আইন পূর্ব পাকিস্তানে বলবৎ ছিল। তবে দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭৩ সালে ওই আইনের ধারাকে সংশোধন করে পাকিস্তানি আমলের আঞ্চলিক পেটেন্ট রাইট অফিসকে জাতীয় পর্যায়ের একটি সংযুক্ত দফতরের দায়িত্ব দিয়ে স্থাপন করা হয় রেজিস্ট্রার অব কপিরাইটের কার্যালয়। বর্তমানে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ কপিরাইট অফিস একটি আধা-বিচার বিভাগীয় দফতর। বাংলাদেশে কপিরাইট আইন ২০০০ (২০০৫ সালে সংশোধিত) কার্যকর।
বিদ্যমান আইনের বিধানমতে, সৃজনশীল ব্যক্তির মেধাশক্তির রক্ষণ, উন্নয়ন, সৃজনশীল কর্মে তাদের উৎসাহ বৃদ্ধিকরণ এবং পাইরেসি রোধকরণের মাধ্যমে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সাধনই কপিরাইট আইনের লক্ষ্য। বাংলাদেশে কার্যকর আইন অনুযায়ী সৃজনকর্মের স্রষ্টার উত্তরসূরিরা ৬০ বছর পর্যন্ত অধিকারপ্রাপ্ত হবেন।
আইনের কথাগুলো সুন্দর হলেও বাস্তবতা বড়ই অসুন্দর। পাইরেসির বেড়াজালে দেশের সৃজনশীল কর্মের নাকাল দশা। ইতিমধ্যে চলচ্চিত্র ও সঙ্গীত শিল্পে ধস এসেছে, প্রকাশনা শিল্পের অবস্থাও বেহাল। এ দেশে পাইরেসি চক্র এতটাই উগ্র যে, নীতি-নৈতিকতা, আইন-বিধি-বিধান কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করে না তারা। তাদের বিবেচনা একটাই- কোনো সৃজনকর্মের পাইরেটেড কপি প্রকাশ করে কত মুনাফা পাওয়া যাবে! কপিরাইটের বিদ্যমান আইনের ৯৩(১) ধারা অনুযায়ী সাব-ইন্সপেক্টরের নিন্মতর পদাধিকারী নন, এমন যে কোনো পুলিশ কর্মকর্তা গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই পাইরেসি সংক্রান্ত কর্মের সব অনুলিপি বা যন্ত্রপাতি বা দ্রব্যসামগ্রী এবং অনুলিপি তৈরির উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত সব প্লেট বা যন্ত্রপাতি বা দ্রব্যসামগ্রী যেখানেই পাওয়া যাক, তা জব্দ করতে পারেন। ৯৯ ধারায় রেজিস্ট্রার অব কপিরাইটকে বেশকিছু দেওয়ানি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, কপিরাইট সংরক্ষণে কপিরাইট দফতরের তৎপরতা কম।
কপিরাইটবিষয়ক অ্যাপিলেট অথরিটি হিসেবে আইনের ১১ ধারামতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে ছয় সদস্যের একটি কমিটি আছে; কিন্তু কোনো কার্যকারিতা নেই। এসব কমিটি সভা-সেমিনার ইত্যাদির সংযোগ পছন্দ করলেও পাইরেসি রোধে কোনো নিয়ন্ত্রণমূলক কার্যক্রম বা অভিযান পরিচালনা করে না। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রশাসনিক আদেশে ২০০৮ সালের ১০ নভেম্বর কপিরাইট টাস্কফোর্স গঠন করলেও অভিযান পরিচালনায় তাদের বড়ই অনীহা। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ১২-১৩টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে।
কপিরাইট অফিস জনসচেতনতামূলক কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করলেও পাইরেসি রোধে তাদের প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা বড়ই অপ্রতুল। ২০০৭-২০০৮ সালে কেবল সঙ্গীত অ্যালবাম রিলিজ হতো প্রায় পাঁচশ’টি এবং বিনিয়োগ হতো ৫ কোটি টাকার অধিক। কপিরাইট দফতরের নির্লিপ্ততার সুযোগে এখন এ খাতে বিনিয়োগ কোটি টাকার নিচে নেমে গেছে, অ্যালবামের সংখ্যা একশ’রও কম। গ্রন্থের ক্ষেত্রেও পাইরেটেড বইয়ের তর্জন-গর্জন দিন দিন বাড়ছে। এখন পাইরেটেড বই প্রকাশ ও বিপণনে কোনো রাখঢাকা নেই। পরিতাপের বিষয়, পাইরেটেড বই ক্রয়ে ক্রেতাদেরও কোনো অনীহা নেই। ‘কম দামে পাই, তাই কিনি’- এমন সরল ব্যাখ্যা ক্রেতাদের।
এ অবস্থার পরিবর্তনে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন হতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিলম্ব হলে দেশের সব সৃজনশীল শিল্প ধীরে ধীরে পাইরেসির করাল গ্রাসে আক্রান্ত হবে। যেমনটা ঘটেছে ইতিমধ্যে চলচ্চিত্র শিল্পে। এ শিল্পে পাইরেসি এমন জেঁকে বসেছে যে, সরকারের নানা প্রণোদনামূলক উদ্যোগেও কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিদিন বন্ধ হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রেক্ষাগৃহ।
কপিরাইট আইনে বেশকিছু সীমাবদ্ধতা আছে। এ কারণে আইন সংশোধনের উদ্যোগ চলছে। তবে সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা থাকলে বিদ্যমান আইনেও পাইরেসি রোধ করা সম্ভব। উল্লেখ্য, বিলম্বে হলেও জামদানির জন্য আন্তর্জাতিক জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন অর্জন করেছে সরকার। এই অধিকার প্রাপ্তির তালিকায় আছে আরও কিছু পণ্য।
কপিরাইট সংরক্ষণে শুধু কপিরাইট অফিসের ওপর ভরসা করলে চলবে না, সংশ্লিষ্ট সবাইকে এর সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। আমাদের দেশের বিভিন্ন সেক্টরের সৃজনশীল ব্যক্তিরা সৃজনকর্ম রক্ষণে মুখে সোচ্চার হলেও কোনো সাংগঠনিক কাঠামোর ওপর ভর করে তাদের এগুনোর প্রয়াস কম। কপিরাইট আইনে (ধারা ৪১-৪৭) কপিরাইট সমিতির কথা জোর দিয়ে বলা হলেও এ দেশে কপিরাইট সংরক্ষণে স্টেকহোল্ডারদের কোনো দৃশ্যমান সমিতি নেই, যার মাধ্যমে তাদের যৌথ দরকষাকষি শক্তিশালী হবে। কপিরাইট বিষয়ে মধ্যস্থতা করার জন্য সিঙ্গাপুরের ‘দ্য কপিরাইট লাইসেন্সিং অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সোসাইটি অব সিঙ্গাপুর লিমিটেড’ বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখছে। এমনকি নাইজেরিয়ার মতো দেশেও ‘দ্য রিপ্রোডাকশন রাইটস্ সোসাইটি অব নাইজেরিয়া’ কার্যকর থাকলেও আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই।
কপিরাইট অফিসের রসদের স্বল্পতাও রয়েছে। বর্তমান জনবল কাঠামোর ৪৯ জনের মধ্যে রয়েছে মাত্র ৩৬ জন। প্রতিবেশী অনেক দেশেই অনলাইন রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি চালু হলেও আমাদের দেশের কপিরাইটকে e-Copyright Application System-এ আনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কোম্পানিটি দীর্ঘসূত্রতা করে মাত্র এ প্রকল্পের ৬০ ভাগ কাজ সম্পন্ন করেছে। কপিরাইট অফিসটি আগারগাঁওয়ের জাতীয় গ্রন্থাগারের একটি ফ্লোরে অবস্থিত। সরকার আগারগাঁওয়ে ১.৪ বিঘা জমি বরাদ্দ দিলেও ভবন নির্মাণ প্রক্রিয়া চলছে শম্বুক গতিতে। প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় হিসেবে কপিরাইট অফিসের অথরিটি সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের গতিও কম।
আগামী শতক হবে আইপির (ইনটেলেকচুয়াল প্রোপার্টি)। কাজেই নতুন শতকের নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণের সক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে আমরা যদি সামনে এগিয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে না পারি, তবে আইপির যুগে আমরা পিছিয়ে পড়ব। এই পিছিয়ে পড়া রোধে সবার সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরি।
খান মাহবুব : খণ্ডকালীন শিক্ষক, মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0045390129089355