‘কোচিং বাণিজ্য একেবারেই বন্ধ হওয়া উচিত’ - দৈনিকশিক্ষা

‘কোচিং বাণিজ্য একেবারেই বন্ধ হওয়া উচিত’

বিন- ই- আমিন |

‘অতিরিক্ত ক্লাস’ বা ‘কোচিং’  যে নামেই আখ্যা দেওয়া হোক না কেন, সেটা শিক্ষকদের বাড়তি সুবিধা। এটা একেবারেই বন্ধ হওয়া উচিত।

বর্তমান সরকার শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়নে অত্যন্ত আন্তরিক। ইতোমধ্যে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনেছেন। তেমনি কোচিং বা প্রাইভেট টিউশনি একেবারে বন্ধ করলে সেটা হবে আরেকটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ। আমি একজন বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। অবশ্য ‘বে’ সরকারী বলাটা এখন সমীচীন হবে কি-না বুঝে উঠতে পারছি না। কারণ, সরকারী কোষাগার থেকে আমাদের মূল শতভাগ দেওয়া হয়। শুধু সরকারীদের মতো বাড়ী ভাড়া আর বদলী এ দুটো হলেই আর “বে “থাকবে না। তবে তাও সময়ের ব্যাপার মাত্র। বর্তমান সরকারের এ মেয়াদেই আমরা পুরোপুরি সরকারী হতে পারব বলে শতভাগ আশা করি।

আমি যখন চাকরী শুরু করেছিলাম তখন সরকারী বেতন পেতাম তিন হাজার টাকার কাছাকাছি। আজ বেতন পাচ্ছি একুশ হাজার টাকারও বেশী। মানে প্রায় সাতগুন। আগামী বিশ বছরে শিক্ষকদের বেতনও অনেক অনেক বেড়ে যাবে, যেটা কিছুদিন আগেও জানিয়েছিলেন আমাদের শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়।

মূল বিষয় প্রাইভেট নিয়ে আলোচনা করা যাক। প্রাইভেট এর ব্যাপারে কিছু মতামত ব্যক্ত করার মানসে এই লেখাটুকু। বাস্তবতার নিরীখে দেখা গেছে উপজেলা লেবেলে একজন প্রাইভেট পড়ানো শিক্ষক যতনা বেপরোয়া তার চেয়ে বেশী জেলা লেবেলে। ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য বাবা মার যে যুদ্ধ করতে হয় তা চলতে থাকে সন্তানের পুরো শিক্ষা জীবন ধরে।

যাদের সামর্থ্য আছে তারা না হয় সন্তানের পেছনে অতিরিক্ত টাকা খরচ করেন, যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, কিন্তু সাধ আছে ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর, তাদের খরচ আসবে কোথা থেকে? গরীবের সন্তান সায়েন্স  নিয়ে পড়লে প্রাইভেটের টাকা পাবে কোথায়?  আমার সতেরো বছরের চাকরি জীবনের প্রথম দিকে এতো প্রাইভেটমূখি শিক্ষার্থী দেখিনি।

প্রাইভেট পড়ানো শিক্ষকের বাসার সামনে মনে হয় যেন স্কুল ঘর।  অন্য দিকে উল্টো চিত্র স্কুলে। প্রাইভেট পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা স্কুল বিমুখ। দেখে মনে হয় যেন প্রাইভেট এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। আর স্কুল কলেজ চতুর্থ  বিষয়। পরীক্ষায় যেমন ফোর সাবজেক্ট এর মতো গুরুত্বহীন। সাধারণত: গণিত ও ইংরেজি বিষয়ই বেশী প্রাইভেট পড়ে এবং পড়ানো হয়।

শিক্ষায় অপচয়ের মোটা অংশ ব্যয় হয় গণিত ও ইংরেজিতে। অন্য আরো বিষয় আছে যেগুলো প্রাইভেট না পড়েও ভালো রেজাল্ট করছে। তাছাড়া ইংরেজি গণিতের মতো বিষয়গুলোকে বেশী গুরুত্ব দিয়ে স্কুলে বার্ষিক ক্লাশ রুটিন করা হয়। অবশিষ্ট কম গুরুত্বের বিষয়গুলো তো শেষের দিকে ক্লাশ হয় যা আবার  মাঝে মাঝে আগে ছুটি হলে ক্লাশ হয়না। সে সব বিষয়ে যদি প্রাইভেট না পড়েও পাস বা ভালো রেজাল্ট করতে পারে তাহলে প্রাইভেটটা অতো জরুরী কেন? অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে প্রধান শিক্ষক সমঝোতার মাধ্যমে প্রাইভেট পড়ানো শিক্ষকদের থেকে একটা পারসেন্টেস (আয়ের একটা অংশ) নিয়ে স্কুলে পড়ানোর অনুমতি দিয়ে থাকেন।

নিয়মানুযায়ী প্রতি ব্যাচে দশ জন এবং মাসে বারো দিন পড়ার জন্য দেড়শত টাকা উপজেলা শহরে নেওয়ার আইন থাকলেও বাস্তবে ঘটছে উল্টো। অনেক শিক্ষক চল্লিশ থেকে ষাট জনের ব্যাচ করে রীতিমতো স্কুলে পাঠদানের মতো প্রাইভেট বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। কমপক্ষে  চল্লিশ জনের ব্যাচে একজন শিক্ষার্থী সময় পায় এক মিনিট। চিন্তা করা যায়! অতিরিক্ত ক্লাশের নামে কি বাণিজ্য চলছে!

তিন চার জন শিক্ষকের কাছে ৫-৬ঘন্টা আসা যাওয়া সহ ব্যয় করলে বাসায় পড়ার সময় থাকে কত ঘন্টা? সরকার যদি প্রাইভেট বন্ধ করে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান অথবা উপজেলা শিক্ষা অফিসারের  মাধ্যমে তদারকি করেন তাহলে লেখাপড়ায় দূর্নীতি অনেকটা কমে আসবে বলে আমার ধারণা।

সবচেয়ে ভালো হয় যদি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দের মাধ্যমে এ তদারকির কাজ করা হয়। প্রাইভেট বাণিজ্য বন্ধ হলে শিক্ষকরা শ্রেণিতে আন্তরিকভাবে পাঠদানে ফিরবে। অভিভাবকদেরও এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া দরকার। তারা যদি তাদের ছেলে মেয়েদের ভালো ফলাফল করার চেয়ে ভালো জানা-শোনার দিকে ও আলোকিত মানুষ হওয়ার দিকে নজর দেন তাহলে অবস্থার উন্নতি হবে নি:সন্দেহে।

তখন কোনো শিক্ষার্থীকে মাসে মাসে শিক্ষকের কথামতো বিভিন্ন গাইড বই কেনার ঝামেলা পোহাতে হবে না। শিক্ষকরাও টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন কোম্পানির গাইড এবং নোটবই কেনার প্রতি তাদের প্রাইভেট শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে পারবে না। টাকার বিনিময়ে প্রাইভেট শিক্ষক নকল বা অবজেকটিভ এর সমাধান সল্যু্শন নিয়ে আসবে সে অপেক্ষায় শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার হলে বসে অপেক্ষা  করতে হবে না।

প্রত্যেকের জবাবদিহিতা থাকলে শিক্ষায় দূর্নীতি কমবে–বাড়বেনা। শিক্ষা সবার জন্য সহজ ও সহজলভ্য হবে। বাস্তবায়ন সহজ হবে বতর্মান শিক্ষা বান্ধব সরকারের মিশন এবং ভিশন। কাংখিত স্বপ্নে পৌঁছতে পারবে দেশ এবং দেশের মানুষ। শিক্ষা  ব্যয় কমিয়ে শীঘ্রই আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পৌছতে পারব। যেখানে নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত সকলের সন্তানদের সমান অধিকার ও সুযোগ থাকবে।

ড: মাহাথির মোহম্মদ যদি অল্প সময়ে বাংলাদেশের চেয়ে গরীব মালয়েশিয়াকে জাপানের মতো উন্নত দেশে রুপ দিতে পারে, তবে আমরা কেন নয়?  আমাদের শিক্ষার্থীরা চিকিৎসা, বিজ্ঞান,প্রযুক্তি সহ নানান বিষয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে রেকর্ড গড়ছেন। কেউ কেউ বলে থাকেন প্রাইভেট বন্ধ করা সরকারের জন্য অসম্ভব।

আমি জানি অসম্ভব বলে কিছু নেই। সরকার শিক্ষকদের বেতনও প্রায় দ্বিগুনের কাছাকাছি বৃদ্ধি করেছে। দ্রব্য মূল্যের দাম স্থির রাখতে পারলে এ সুফল সকল সরকারী সুবিধাভোগীরা ভোগ করবেন। সীমিত আয় দিয়ে সংসারের সকল ভরণ পোষণ হয়তো কঠিন হবে। তৃপ্ত হওয়া যাবে এ ভেবে যে, সম্মানীত পেশায় নিয়োজিত থেকে পুরোপুরিভাবে সৎ জীবন যাপনের চেষ্টা করছি।

লেখক : বিন- ই- আমিন, দৈনিকশিক্ষার প্রতিনিধি ও সিনিয়র সহকারী শিক্ষক, নলছিটি গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঝালকাঠী।

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0077409744262695