বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে বেকার জীবনযাপন করা যে কত যন্ত্রণার তা বেকার ছাড়া অন্যদের বোঝানো কষ্টকর। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে গ্র্যাজুয়েট অথচ চাকরি বা কর্মসংস্থানের কোনো নিশ্চয়তা নেই। জীবিকা নির্বাহে দেশে বিকল্প আর্থিক নিশ্চয়তারও অভাব। আবার শূন্য পদের তুলনায় বেকারের সংখ্যা বহুগুণ বেশি। তখন প্রাইভেট টিউশন অথবা পরিবারের আয়ের ওপর নির্ভর করে চলতে হয়। কিন্তু সবাই তো আর প্রাইভেট টিউশনের ব্যবস্থা করতে পারেন না। ফলে বাধ্য হয়েই উচ্চ শিক্ষিত এই বেকারদের পরিবারের কাছ থেকেই টাকা নিতে হয়। যে পরিবারটি এত দিন ধারদেনা কিংবা সম্পদ বন্ধক বা বিক্রি করে তাদের সন্তানদের পড়াশোনা শিখিয়েছে, সে পরিবারটিকেই কি না বেকার নামের এই বোঝা টানতে হচ্ছে অবিশ্রান্তভাবে! একবার ভাবুন তো, উচ্চ শিক্ষিত এক বেকার সন্তান তাঁর বৃদ্ধ বাবার কাছ থেকে মাসের পর মাস কিংবা অনেকের ক্ষেত্রে বছরের পর বছর টাকা নিচ্ছেন—যে বাবার হাতে নিজের চিকিৎসা করারও পর্যাপ্ত টাকা নেই। কী যে পরিহাস! কাজ করার যোগ্যতা আছে কিন্তু কাজ নেই। বেকার। অর্থ উপার্জনের সামর্থ্য আছে কিন্তু পকেটে অর্থ নেই। শূন্য পকেট। সীমিত টাকায় যাদের জীবন চলে সেই বেশির ভাগ শিক্ষিত বেকারকেই চাকরির আবেদনের জন্য ফি গুনতে গিয়ে পড়তে হচ্ছে বিপাকে। যাদের আয়ের কোনো উৎস নেই, তাদের কাছ থেকে ফি নেওয়া কতটা যৌক্তিক?
কোনো প্রতিষ্ঠান যেখানে নিজেদের প্রয়োজনেই লোকবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয় সেখানে নিয়োগসংক্রান্ত ব্যয়ের ভার কেন বেকারদের নিতে হবে? যাঁরা প্রায় কুড়ি বছর নিজ খরচে লেখাপড়া করে রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছেন, কাজ করার যোগ্যতা অর্জন করেছেন, সেই তাঁদেরই আবার রাষ্ট্রের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করার সুযোগ পাওয়ার জন্যও ফি দিতে হচ্ছে! কোনো একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান হয়তো যুক্তি দেখাবে, নিয়োগ পরীক্ষার ব্যয় নির্বাহের জন্য আবেদন ফি মাত্র ৫০০/৭০০ টাকা নেওয়া হয়, তা আবার এমন কী! কিন্তু যিনি বেকার, তিনি তো জানেন প্রতি মাসে কতটা প্রতিষ্ঠানের জন্য ফি গুনতে হয় তাঁকে। চাকরির কোনো নিশ্চয়তা না থাকায় যত দিন একটি চাকরি জোটেনি, তত দিন প্রায় প্রতিটি বিজ্ঞাপনের বিপরীতেই আবেদন করেন একজন বেকার। শুধু যে আবেদন ফি দিলেই খরচ মিটে যায়, তা তো নয়। একেক প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষার স্টাইল একেক রকম। একাডেমিক পড়াশোনার সঙ্গে চাকরির পরীক্ষার মিল না থাকায় প্রস্তুতি নিতে তাই বইপত্রও কিনতে হয় ভিন্ন ভিন্ন। আবার বেশির ভাগ পরীক্ষা হয় রাজধানী ঢাকায়। বারবার ঢাকা শহরে যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়ায়ও তো প্রচুর খরচ। কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আর বিদেশি কিছু সংস্থা ছাড়া সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব চাকরিতেই আবেদন করতে গুনতে হয় ফি। একজন বেকার এত খরচ কিভাবে বহন করবেন? টাকার অভাবে লাখ লাখ শিক্ষার্থী তাই অনেক সময় আবেদনই করতে পারেন না।
সম্প্রতি এই আবেদন ফি সম্পর্কে একটা সুখবর এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে; এখন থেকে রাষ্ট্রায়ত্তসহ সব ব্যাংকে চাকরির আবেদন করতে কোনো ফি লাগবে না। এর ফলে কোনো ধরনের ফি ছাড়াই ব্যাংকের যেকোনো নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন চাকরিপ্রার্থীরা। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও কি বেকারদের জন্য এমন সুসংবাদ দিতে পারে না? উন্নত বিশ্বে সরকার বেকারদের কর্মসংস্থান হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের ভাতা দিয়ে থাকে। অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত না হওয়ায় বাংলাদেশের পক্ষে বেকারদের ভাতা দেওয়া হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু তাদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে ব্যবসা করা অমানবিক। চাকরি দেওয়া সম্ভব না হোক, অন্তত সবাইকে বিনা ফিতে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত।
লেখক : শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা