পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। বর্তমানে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছি। আর এ কারণে ছাত্ররাজনীতি খুব কাছে থেকে দেখেছি। বিশেষ করে রাজনীতি বিজ্ঞানের শিক্ষক হওয়ার সুবাদে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে গবেষণার সুযোগ পেয়েছি যথেষ্ট। ইতিহাসের পাতায় ছাত্ররাজনীতি হলো বড় বড় রাজনৈতিক নেতা তৈরির সূতিকাগার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, পরবর্তীকালে আবদুর রাজ্জাক, কাজী জাফর, রাশেদ খান মেনন, তোফায়েল আহমেদ প্রমুখ ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বেরিয়ে এসেছেন। কিন্তু বর্তমানের ছাত্ররাজনীতি আর ভবিষ্যতের রাজনৈতিক নেতা তৈরি করতে পারছে না বললেই চলে। এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। বিশেষ করে ক্ষমতার আধিপত্য, বড়াই-লড়াই, হল দখল, সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, চাটুকারিতা, পকেট নেতা তৈরি, প্রশাসনের অন্যায্য সমর্থন প্রভৃতি কারণে ছাত্ররাজনীতির যথাযথ বিকাশ হচ্ছে না। ইদানীং গণমাধ্যমে প্রায়ই ছাত্রলীগের অন্যায়-অপকর্মের খবর পাই। পরক্ষণেই আবার কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কর্তৃক সংশ্লিষ্টদের বহিষ্কারসহ নানা ধরনের শাস্তিমূলক আয়োজন দেখে অভিভূত হই। মনটা ভরে যায়। মনে হয়, আবার যেন ছাত্ররাজনীতি তার পুরনো রূপ ফিরে পাচ্ছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এমন কিছু পীড়াদায়ক ঘটনা ঘটে, যা গণমাধ্যমের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। ফলে এসব নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য হয় না।
একসময় দেখেছি, ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের তাণ্ডব। ইয়ানতের নামে চলেছে শিবিরের ব্যাপক চাঁদাবাজি। এখনো কিছু ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের মধ্যেও এমনটা দেখা যায়। প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই ঘোষণা করেন, অন্যায়কারী যে দলেরই হোক তাকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। ফলে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে একধরনের ভীতি রয়েছে। তার পরও অনেকেই ক্ষমতার দাপটে নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়ে নিজেদের প্রিয় সংগঠনকে কলুষিত করে ফেলছে। প্রায়ই গণমাধ্যমে দেখি, ছাত্রলীগের অনেক শীর্ষ পর্যায়ের নেতা নির্বাচিত কিংবা মনোনীত হচ্ছেন যাঁদের পারিবারিক প্রেক্ষাপট মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নয়। বরং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সংগঠনের সক্রিয়দের পারিবারিক উত্তরসূরিরা ছাত্রলীগের পদ ধারণ করছে। আর এতে সহযোগিতা করছেন আওয়ামী লীগের অনেক হাইব্রিড নেতা।
প্রায়ই শুনে থাকি, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে সাধারণ ছাত্র নির্যাতন, অতঃপর হুমকি-ধমকি ও হল থেকে বিতাড়নের ঘটনা। মাঝেমধ্যেই এমন অভিযোগের মুখোমুখি হই শিক্ষক হিসেবে। অভিযোগ শুনে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ছাত্ররাজনীতি নিয়ে শঙ্কিত হই। লজ্জায় মাথা নুয়ে পড়ে যে বঙ্গবন্ধু তো এমন রাজনৈতিক আদর্শকে প্রশ্রয় দেননি, কখনো শেখাননি। তাহলে কেন এগুলো ঘটছে? ধরে নিতে পারি যে যারা এমন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত, তারা কোনোভাবেই প্রকৃত অর্থে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের নয়। শুধু ছাত্রলীগের রাজনীতিতে নয়, এমন নেতিবাচক প্রশ্রয় ওপরতলার রাজনীতিতেও আছে। আর এ কারণে বলা যায় ছাত্ররাজনীতির বর্তমান দশার জন্য শুধু ছাত্ররাই দায়ী নয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্ররাজনীতি থেকে আগাছা উপড়ে ফেলার আহ্বান জানিয়েছেন বারবার। দেশের মূল রাজনীতি, এককথায় বড় রাজনৈতিক দলগুলো আগাছামুক্ত না হলে তাদের লেজুড়বৃত্তি করছে যে ছাত্রসংগঠনগুলো তাদের আগাছামুক্ত করা যাবে না। দলের কমিটি গঠন ও শাখা গঠনের জন্য এখন যোগ্যতার পাশাপাশি চলে লাখ লাখ টাকার রাজনৈতিক বাণিজ্য। এই অপরাজনীতির দাপটে ক্রমেই ছাত্ররাজনীতি হয়ে উঠছে অসৎ ও অশুভ। আর এর প্রভাব পড়ছে সাধারণ ছাত্রদের ওপর।
আমি শিক্ষক হিসেবে দেখেছি, অনেক ছাত্রই বঙ্গবন্ধুকে পছন্দ করে, শেখ হাসিনাকে পছন্দ করে। আর এই পছন্দ থেকেই একজন সাধারণ ছাত্র তার পরিবারকে যথাযথ আদর্শের মাধ্যমে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়। সব শিক্ষার্থীই যে সক্রিয় ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে থাকবে, আবার সবাই যে মিছিল-মিটিংয়ে যাবে এমনটি কোনোভাবে প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীরা যখন ছাত্রলীগের দ্বারা লাঞ্ছিত হয় তখন এর প্রভাব কেমন হতে পারে কিংবা কত দূর যেতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে চান। আর এই সুযোগে কিছু সুযোগসন্ধানী অন্যায়-অপকর্মের মাধ্যমে বেকায়দায় ফেলতে চায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর এক লেখায় উল্লেখ করেছিলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ছাত্ররাজনীতির নীতি-নৈতিকতা ধ্বংস করা হয় লাইসেন্স-পারমিটবাজিতে ক্ষমতাসীন দলের অনুগত ছাত্রসংগঠনগুলোকে অবাধ সুযোগ দানের ব্যবস্থা দ্বারা। ’ বিএনপি ও আওয়ামী লীগের আমলে এ ধরনের লাইসেন্স-পারমিটবাজির বখরা নিয়ে পর্যায়ক্রমে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের দুই অংশের মধ্যে বিবাদে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটছে। সন্ত্রাস ও দুর্নীতির গ্রাস থেকে ছাত্ররাজনীতিকে মুক্ত রাখা যায়নি কিংবা হয়নি।
ইদানীং যারা ছাত্ররাজনীতি করে তাদের অধিকাংশই রাজনৈতিক কোনো আদর্শ ধারণ করে না। মূল বিষয় হচ্ছে, হলে থাকা, রাজনৈতিক বড় ভাইদের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে সুবিধা আদায় করা। এ কারণে ক্ষমতার রদবদল হলে এদের অনেককেই খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং রং বদলে মিশে যায় অন্য দলে।
যখন ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো তখন ঠিকই ভালো ছাত্রনেতা তৈরি হয়েছে। আর এই উপলব্ধি থেকেই সম্প্রতি মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাঁর বক্তৃতায় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। আমি বিশ্বাস করি, ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলেই ছাত্ররাজনীতি কলুষমুক্ত হবে। এখনকার ছাত্রনেতারা রাজনীতির নামে যে ক্ষমতার অপব্যবহার করছে, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকলে সেই অপব্যবহারের মাত্রা অনেকটাই কম থাকত। কারণ নির্বাচনে সাধারণ ছাত্রদের ভোটে বিজয়ী হওয়ার প্রশ্ন থাকে।
এত কিছুর পরও বিশ্বাস করি, ছাত্ররাই পারে অপার শক্তি ও সাহস নিয়ে জাতির পাশে দাঁড়াতে, ছাত্রদের ওপরই সেই আস্থা রাখা যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে ইতিহাসের প্রতিটি সফলতায় ছাত্রদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু এমনও শিক্ষার্থী আছে, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে রাজনীতি করে নিজের জীবন বলি দিয়ে লাশ হয়ে ফিরেছে। আবার অনেকেই ছাত্রত্ব বলি দিয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরেছে। দেশের ছাত্ররাজনীতি যদি কলুষমুক্ত না হয়, আগাছামুক্ত না হয়, তাহলে জীবন বা ছাত্রত্ব বলিদানের ঘটনা অনবরত ঘটতেই থাকবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
সুত্র: দৈনিক ইত্তেফাক