জাতীয়করণ নিয়ে প্রিয় ও অপ্রিয় কিছু কথা - দৈনিকশিক্ষা

জাতীয়করণ নিয়ে প্রিয় ও অপ্রিয় কিছু কথা

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

এ  সময়ে দেশে সবচেয়ে কমন ও আলোচিত ইস্যু কোনটি? -এমন প্রশ্ন করা হলে ‘একত্রে স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ’ ই হবে সকলের এক ও অভিন্ন উত্তর। শিক্ষার বৃহত্তর স্বার্থে এটি এক যুগোপযোগি ও বাস্তবধর্মী চিন্তাধারা। দেশের কয়েক লক্ষ শিক্ষক-কর্মচারী ও কম করে তাদের অর্ধ কোটি পোষ্য আজ একযোগে দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা সেটিই মনে প্রাণে কামনা করেন। কেবলি কী শুধু তারা? ইদানিং শিক্ষার মানের ক্রমাবনতির কারণে উদ্বিগ্ন গোটা জাতি। তারা ও শিক্ষার উন্নয়নে এর বিকল্প আর কিছু দেখতে পান না।

আমাদের জাতির জনক একটি ধ্বংসন্মুখ অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়ে প্রাথমিক শিক্ষাকে একত্রে জাতীয়করণ করেছিলেন কেন? তাঁর সুযোগ্য তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনা বাবার পদাংক অনুসরণ করে আরো ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন এক সাথে জাতীয়করণ করেন? নিশ্চয় এর মাঝে ‘মিলিয়ন ডলার সেক্রেট’ বলে একটা কিছু লুকিয়ে আছে। একত্রে জাতীয়করণ করলে যেটুকু সুফল জাতি পেতে পারে, নিশ্চয় তা অনুধাবন করেই তারা তা করেছিলেন। তারা সে সত্যটি অবশ্যই অনুধাবন করেছিলেন যে, শিক্ষাই একমাত্র হাতিয়ার যা সমগ্র পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে। কিন্তু, স্বাধীনতা লাভের প্রায় অর্ধ শত বছর পেরিয়ে এসে ও আজ পর্যন্ত কেন পরবর্তি স্তরের স্কুল-কলেজ একত্রে জাতীয়করণের কোন উদ্যোগ কারো নেই?

প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোর নিজস্ব কোন অর্থের সংস্থান কোনদিন ছিল না এবং আজো নেই। কেবল মাত্র স্কুল ঘরের ভিটেটুকু ছাড়া অনেক স্কুলের নিজস্ব আঙ্গিনা পর্যন্ত ছিল না। জাতীয়করণের পর থেকে এদের পুরো ব্যয় ভার সরকারি কোষাগার থেকে শত ভাগ নির্বাহ করা হয়। কিন্তু, প্রাথমিকের পর শিক্ষার অপরাপর স্তরে স্কুল-কলেজের নিজস্ব অর্থের সংস্থান আছে। শিক্ষার্থীরা প্রতি মাসে বেতন অর্থাৎ টিউশন ফি দিয়ে থাকে। ফলে মাসে এ খাতে সব মিলিয়ে কয়েক কোটি টাকার আয়। সেশন ফি বাবদ বছরে আরো কয়েক শ’ কোটি টাকার সংস্থান আছে। সব স্কুল-কলেজের সাধারণ ও সংরক্ষিত তহবিল মিলে ব্যাংকে কয়েক হাজার কোটি টাকার কম হবে না।

অনেক স্কুল-কলেজ আছে, যেগুলোর সম্পদ অপরিসীম। প্রাচীনকালে জমিদার কিংবা বিত্তশালীরা একেকটি স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করার সময় নিজেদের অনেক সম্পদ অকাতরে দান করে গেছেন। সে সব সম্পদ কোন কোন জায়গায় এখন বেদখল অবস্থায়। অনেক রাগব বোয়াল এ সব গিলে ফেলেছে। সে সব উদ্ধারের জন্য সর্বাগ্রে স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ করা অপরিহার্য। স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ হলে রাগব বোয়ালরা আপনা থেকে সব উগলে দিয়ে পালিয়ে যাবে। কোটি কোটি টাকার বেহাত সম্পত্তি সরকারের হস্তগত হবে।

এ সব নিয়ে যথাযথ ও সঠিক যোগ বিয়োগ করলে আসল হিসাবটা বেরিয়ে আসবে। সকল স্কুল-কলেজ একত্রে জাতীয়করণ করা হলে শিক্ষক-কর্মচারীর জন্য সরকারের অতিরিক্ত আর কত টাকা খরচ হবে? বরং সরকার স্কুল-কলেজের সকল আয় ও সম্পদ নিয়ে নিলে তাদের তহবিল অনেক সমৃদ্ধ হবার সম্ভাবনা থাকে।

এমনিতেই সরকার থেকে স্কুল-কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের শত ভাগ স্কেলে বেতন দেয়া হয়। বাড়ি ভাড়া ১ হাজার টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৫’শ টাকা এবং উৎসব ভাতা ২৫ শতাংশ। তারপর আর এমন কী বাকি থাকে? কেবল বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা আর উৎসব ভাতাটা সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের হিসেব মতো দিলেই হয়ে যায়। তাতে তো আর এত বেশী টাকা লাগার কথা নয়।

তদুপরি, জাতীয়করণের বিষয়টি যেন কোন ভাবেই গুরুত্বের সাথে নিচ্ছে না কেউ। শিক্ষকদের জন্য ‘পৃথক বেতন স্কেলের’ কথা বললে প্রকারান্তরে কী শিক্ষা জাতীয়করণের প্রশ্নটি সামনে চলে আসে না? আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এ কী শিক্ষকদের মর্যাদার বিষয়ে আলোকপাত করা হয় নাই?

আমাদের শিক্ষাবান্ধব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সকল স্কুল-কলেজ একত্রে জাতীয়করণের হিসাব দেবার জন্য নীতি নির্ধারকদের কয়েকবার তাগিদ দিয়েছেন বলে সংবাদ মাধ্যমে জানা যায়। কিন্তু, কেউ এ সহজ হিসাবটা দিতে এগিয়ে আসছেন না। এর কারণ কী?এর রহস্য উন্মোচন করা দরকার। কারা, কেন এ পথে অন্তরায় হয়ে আছে?

সত্য বরাবরই চির সত্য। তবে তা অনেক সময় অপ্রিয় হয়। বিশেষ প্রয়োজনে সে অপ্রিয় সত্যটুকু প্রকাশ করা অনেক সময় অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

স্কুল-কলেজে ম্যানেজিং কমিটি ও গভার্ণিং বডির লোকজনের অনেকেই হয়ত জাতীয়করণের বিষয়টি মেনে নিতে পারেন না। যে ভাবে আছে সে অবস্থায় থাকলে তাদের মোড়লিপনা যেমন বজায় থাকে, তেমনি ইচ্ছে মতো স্কুল-কলেজের সম্পদ ব্যবহার করার সুযোগ থেকে যায়। এদের অনেকে আবার ক্ষমতা ও প্রভাব উভয়টির মালিক।

প্রশাসনে যারা কাজ করে বিশেষতঃ দেশের আমলা শ্রেণির বেশীর ভাগই জাতীয়করণের বিপক্ষে। কেননা, জাতীয়করণ হলে তাদের অনেকের পদ ও মর্যাদা শিক্ষকদের পদ মর্যাদার নীচে চলে যায়। সেটা তাদের সয় কী করে? কিছু প্রতিষ্ঠান প্রধান থাকতে পারেন, যারা হয়ত বা মনে প্রাণে জাতীয়করণ চান না। বর্তমানে যে সব সুযোগ-সুবিধা আছে, সে সব হারিয়ে যাবার ভয়। পদ-পদবী হেরে যাবার আশংকা। যে বদলিটা অনেক শিক্ষক-কর্মচারীর প্রাণের দাবি, সেটি আবার অনেকের জন্য আতংক। কেননা, বাড়িতে থেকে থেকে ইচ্ছে মত স্কুল-কলেজ চালিয়ে কেউ কেউ ভিন্ন একটা মজা পেয়ে গেছেন।

শহরাঞ্চলে বেশী এবং গ্রামাঞ্চলে কম হলে ও এমন কিছু প্রতিষ্ঠান আছে,যাদের আয় ও সম্পদ প্রচুর। তারা তাদের শিক্ষক-কর্মচারীদের সরকারি হিসেবে বেতন ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দিয়ে ও বছরে অনেক টাকা উদ্ধৃত্ত থাকে। এ সব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছে জাতীয়করণের বিষয়টিতে তেমন আগ্রহ থাকবার কথা নয়।

আমাদের দেশে বিত্তবান অনেকে আছেন, যারা নিজেদের সন্তানকে বিদেশে কিংবা প্রাইভেট নামীদামী স্কুল-কলেজে পড়াশুনা করাতে পছন্দ করেন। জাতীয়করণে তাদের ও কোন আগ্রহ নেই।

দেশের স্কুল-কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে ঐক্যের অমিল নিতান্তই বেমানান টেকে। তাদের অনেক সমিতি,নেতা ও বহু। কে শোনে কার কথা? ভাবখানা যেন এই-গাঁয়ে মানে না, আপনি মোড়ল। অনেক সময় কোন কোন রাজনৈতিক দলের লেজুড় বৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েন তারা। নিজেদের স্বার্থ ও পেশাগত কারণে তাদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা একান্ত অপরিহার্য। তা করতে পারলে অন্ততঃ অনেক আগেই জাতীয়করণের বিষয়টি ত্বরান্বিত হতো।

কিন্তু যে যা-ই ভাবুন না কেন, স্কুল-কলেজের উপর সরকারি নজরদারি ও জবাবদিহিতা ষোল আনা প্রতিষ্ঠা করার এখনই উপযুক্ত সময় এসেছে। তা না হলে আমাদের শিক্ষা দিনে দিনে আরো রসাতলে যেতে থাকবে। শিক্ষা ব্যবস্থা ক্রমাগত হয়ে উঠবে সম্পূর্ণ রূপে হ-য-ব-র-ল। আর সে জন্য অবিলম্বে সকল স্কুল-কলেজ একত্রে জাতীয়করণ করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। শিক্ষা ব্যবস্থাপনাকে যথাযথ নিয়ন্ত্রণে রেখে শিক্ষার প্রকৃত সুফল অর্জন করতে হলে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকেই পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণ করা একান্ত আবশ্যক। আর তা হলেই যথাসময়ে আমাদের দেশ এমডিজি (Millenium development goal) ও এসডিজি (Sustainable development goal) অর্জন করতে সক্ষম হবে। কেবল তখনি আমাদের অগ্রযাত্রা কেউ কোনভাবে রুদ্ধ করতে পারবে না।

লেখক : অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট।

[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়]

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0035741329193115