দেশে বেসরকারি বলতে যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বুঝানো হয়, মূলতঃ সে সবের প্রধান সমস্যাগুলো এক ও অভিন্ন। দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে এ সব প্রতিষ্ঠানের অবদান শতকরা আটানব্বই ভাগ। স্বাধীনতা অর্জনের প্রায় অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে আজো কেবল প্রাথমিক শিক্ষা স্তর ব্যতীত অন্য কোন স্তর জাতীয়করণ করতে না পারাটা আমাদের অন্যতম জাতীয় ব্যর্থতা। অন্ততঃ মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর জাতীয়করণ না করে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার প্রচার-প্রচারণা অনেকের কাছে বাগাড়ম্বর ও হাস্যকর বৈ ভিন্ন কিছু নয়।
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহের বিদ্যমান সমস্যাগুলো সর্বজন বিদিত। এখানে এ সবের দু’একটি নিয়ে ঈষৎ আলোকপাত করা যায়।
আমাদের দেশে শিক্ষার একেকটা স্তরে পাঠক্রম যদিও অভিন্ন, কিন্তু সর্বত্র পাঠ্যসুচি বা সিলেবাস এক নয়। সিলেবাস যে যার মত করে তৈরী করে। একমাত্র পাবলিক পরীক্ষা ছাড়া আভ্যন্তরীণ পরীক্ষা সমূহে যার যেমন ইচ্ছে, তেমন সিলেবাস প্রণয়ন করে নিয়ে থাকে। এর ফলে নতুন প্রজন্ম সব জায়গায় সমান ভাবে নিজেদের মেধা বিকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।
শিক্ষার্থী তথা ছাত্র-ছাত্রীদের মাসিক বেতন কিংবা টিউশন ফি যাই বলিনা কেন, একেক জায়গায় একেক রকম। একই শ্রেণিতে ছাত্র বেতন সর্বত্র সমান থাকে না। অনেকটা যে যার মত করে আদায় করে। কোন কোন জায়গায় গলাকাটা ফি ও আদায় করা হয়।
ম্যানেজিং কমিটি ও গভার্ণিং বডি গঠন, সভাপতি নির্বাচন,ভোটার তালিকা, দাতা-প্রতিষ্ঠাতা এবং শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে অনেক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কত রকম ঝামেলা রয়েছে। এ নিয়ে দেশে শত শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে আছে। এ জাতীয় মামলায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান নানা ভাবে ভোগান্তির শিকার। এর ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, সারা বছর ধরে লেখাপড়ার পরিবেশ ও বিভিন্ন ভাবে বিঘ্নিত হতে থাকে।
বদলির সুযোগ না থাকায় কত শিক্ষক-কর্মচারী নানা ভাবে হয়রানির শিকার। বদলি কেবল শিক্ষক-কর্মচারীর সুবিধের জন্য নয়, বদলিকে কাজে লাগিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের তথা শিক্ষার ও কল্যাণ সাধন করা যায়। এর দ্বারা অনাকাঙ্খিত কোন কোন পরিস্থিতি এড়িয়ে কিংবা কাটিয়ে উঠা সহজ হয়।
নোট-গাইড ও কোচিংয়ে দেশ সয়লাব হয়ে গেছে। নোট-গাইড বন্ধ করে কোচিংবাণিজ্য উঠাতে না পারলে আমাদের শিক্ষায় আরো কত দূর্গতি অপেক্ষা করছে, কে জানে? বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে সঙ্গত নানা কারণে এ সবের অনুকূল পরিবেশ থেকে যায়।
আমাদের দেশে অনেক পুরনো স্কুল-কলেজ আছে, যেগুলো তৎকালীন জমিদার বা বিত্তশালী শ্রেণির লোকেরা প্রতিষ্ঠা করেন। তারা তখন এ সব প্রতিষ্ঠানের নামে অনেক স্থাবর সম্পত্তি ও জায়গা জমি দান করে দিয়ে যান।
বর্তমানে এ সব জায়গা-জমি ও স্থাবর সম্পত্তি অনেক প্রতিষ্ঠানের জোত-দখলে নেই। অনেক জায়গায় প্রভাবশালীদের দখলে কিংবা কমিটির লোকজনের যোগ সাজসে নামমাত্র মূল্যে নিলামে আছে। শহরের মত জায়গায় ও কোন কোন প্রতিষ্ঠানের দশ-কুড়ি বিঘা জমি আছে। কারো মার্কেট পর্যন্ত আছে। কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি কত প্রতিষ্ঠানের কত ভাবে অযত্নে-অবহেলায় ও অনাদরে কিংবা বেদখলে পড়ে রয়েছে। এ সবের সঠিক ও যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে একেক প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তির আয় দিয়ে একাধিক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের সরকারি হিসেবে বেতন ভাতা দেয়া সম্ভব বলে অনেকের ধারণা। কিন্তু, বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় থাকতে থাকতে এ জাতীয় সম্পদ একদিন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের হাত ছাড়া হয়ে যেতে পারে।
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ নিয়ে এতদিন ম্যানেজিং কমিটি ও গভর্ণিং বডি কোন কোন জায়গায় নানা রকম অনিয়ম করেছে। এখনো অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক, সুপার, উপাধ্যক্ষ, সহকারি প্রধান ও সহকারি সুপার এবং কর্মচারী নিয়োগে তাদের যা ইচ্ছে তাই করার অবারিত সুযোগ বিদ্যমান। ‘এনটিআরসিএ’ কর্তৃক শিক্ষক নির্বাচনের সূচনায় সকলেই আশাহত। আরো বেশী করে অনিয়মের ক্ষেত্র সৃষ্টি হওয়ার আশংকা। আলামতে মনে হচ্ছে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে স্থায়ী ভাবে শিক্ষক সংকট লেগেই থাকবে।
আমাদের দেশ দীর্ঘ বহু বছর স্বৈরাচার ও স্বৈর শাসকদের অপশাসনে পিষ্ট হয়েছে। এর আগে ইংরেজ ও পাকিস্তানী শাসনামল আমরা পেরিয়ে এসেছি। শোষণ ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম চেতনা ও অঙ্গীকার। ইংরেজ আমল ও পাকিস্তানী শাসনামল এবং স্বৈরাচার ও স্বৈর শাসকদের সময়ে তারা নিজেদের পছন্দের দু’একটি স্কুল-কলেজ সরকারিকরণ করেছে। এখন ক্ষমতায় জাতির জনকের আদর্শের সরকার। তারা কেন বিচ্ছিন্ন করে স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ করবে? এভাবে জাতীয়করণ করায় আজ নানা জায়গায় বিক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। কোথাও আনন্দ মিছিল ও মিষ্টিমুখ আবার কোথাও মানববন্ধন ও প্রতিবাদ। সে আমাদের কাম্য নয়। তাই আজ শিক্ষা ক্ষেত্রে সব সমস্যার ত্বড়িত ও এক সাথে সমাধানের লক্ষ্যে একত্রে সব স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ করা ছাড়া আর কোন পথ নেই। কেবল এ পথটিই নিঃসন্দেহে একান্ত মসৃণ।
মুজম্মিল আলী: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব শিক্ষা বিশ্লেষক।