সম্প্রতি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বদরুজ্জামানকে গ্রেপ্তার ও এর চার-পাঁচ দিন পর মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। জনসাধারণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট একটি সিস্টেম বা প্রক্রিয়ার সঙ্গে একজন কিংবা দু-চারজন ব্যক্তির কর্মকাণ্ডকে গুলিয়ে ফেলা বোধ হয় সঠিক হবে না। ভুক্তভোগীদের মধ্যে আজ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে হাজার হাজার, লাখ লাখ পরীক্ষার্থী এত দিন থাকত রাজনীতিকদের কাছে আর এখন কি খোদ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই জিম্মি হয়ে থাকবে? এসব পরীক্ষার্থীর উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তার শেষ কোথায়?
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডের পরিধি আজ অনেক বিস্তৃত। এর অধীন দুই হাজারের বেশি কলেজের মধ্যে অন্তত ১৫০টি কলেজে মাস্টার্স কোর্স পড়ানো হয়। ২০১৪ সালের মাস্টার্স শেষ পর্বের চূড়ান্ত পরীক্ষাটি পূর্বনির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী ৩ এপ্রিল, ২০১৭ সালে শুরু হওয়ার কথা ছিল। ২০১৩-২০১৪ শিক্ষাবর্ষের এমএ, এমএসএস, এমবিএ, এমএসসি ও এমমিউজ মিলে ৩০টি বিষয়ে মোট পরীক্ষার্থী দুই লাখের বেশি। দেশব্যাপী অন্তত ১১৬টি কলেজে (পরীক্ষা কেন্দ্রে) একযোগে পরীক্ষাটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু পরীক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্ট সবার চূড়ান্ত প্রস্তুতির মুখে ১৯ মার্চ আকস্মিক জানা গেল ‘অনিবার্য কারণবশত’ ৩ এপ্রিল শুরু হতে যাওয়া মাস্টার্স শেষ পর্বের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ এনে ২০১২ সালে গাজীপুরের জয়দেবপুর থানায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বদরুজ্জামান, সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহসহ আরো অনেকের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় গত ১৩ মার্চ গ্রেপ্তারের পর থেকে কারাগারে আছেন বদরুজ্জামান। হঠাৎ ‘অনিবার্য কারণে’ মাস্টার্স পরীক্ষা স্থগিত করায় সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার্থী ছাড়াও অন্যান্য সেশনের শিক্ষার্থী ও পরীক্ষার্থী, এমনকি অভিভাবকদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও হতাশা। পরীক্ষা স্থগিত করার ব্যাপারে উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ সাংবাদিকদের কাছে বলেন, ‘আমাদের কন্ট্রোলার সাহেব গ্রেপ্তার, তিনি পরীক্ষার মূল ব্যক্তি। তাঁর জামিন বা মুক্তি না হলে আমাদের জিম্মায় পরীক্ষা নেওয়া কঠিন। …কিছুদিনের মধ্যে আবার পরীক্ষার শিডিউল দেওয়া হবে। তাই আপাতত বন্ধ করা হয়েছে। ’
একটা সময় গেছে ডিগ্রি (পাস) পরীক্ষা সম্পন্ন করতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বছর তিন মাস, চার মাস, এমনকি এরও বেশি (১৩৯ দিন) সময় লেগেছে। আবার পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ফলাফল প্রকাশ করতে চার মাস, পাঁচ মাস, এমনকি একেবারে সাত-আট মাস (২০৮ দিন) সময় লাগিয়ে দিয়েও দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। সর্বশেষ অনুষ্ঠিত মাস্টার্স শেষবর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে ৯ অক্টোবর, ২০১৬।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৪ সালে ঘোষণা করে তার বহুল আলোচিত ‘ক্রাশ প্রগ্রাম’। ‘শঙ্কামুক্ত জীবন চাই, নিরাপদে ক্লাস করতে ও পরীক্ষা দিতে চাই, শিক্ষা ধ্বংসকারী সহিংসতা বন্ধ করো’—এ ধরনের অভিন্ন লেখাবিশিষ্ট ব্যানার সামনে রেখে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন দেশের দুই হাজার ১৫৪টি কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ১৪ মার্চ, ২০১৫ সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৪৫ মিনিট ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। অধিভুক্ত কলেজগুলো ছাড়াও কেন্দ্রীয়ভাবে মূল কর্মসূচিটি পালন করা হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গাজীপুর ক্যাম্পাসে। এখানকার কর্মসূচিতে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ট্রেজারার, রেজিস্ট্রার ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকসহ শত শত শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী অংশগ্রহণ করেন। মানববন্ধন শেষে উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, ‘সেশনজট কাটাতে আমরা ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পরীক্ষার সূচি, ক্লাস সময়, ফরম পূরণ, ফলাফল প্রকাশসংক্রান্ত একটি কর্মপরিকল্পনা বা ক্রাশ প্রগ্রাম ঘোষণা করেছিলাম। কিন্তু দুই মাসের বেশি সময় ধরে চলমান হরতাল-অবরোধে আমাদের কর্মপরিকল্পনা এখন হুমকির সম্মুখীন। গত দুই মাসে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোতে পরীক্ষা হয়নি। সহসা এ অচলায়তন কাটারও কোনো লক্ষণ নেই। হরতাল-অবরোধের নামে সহিংসতা ও প্রাণহানি বন্ধের দাবি ও নির্বিঘ্নে-নিরাপদে ক্লাস ও পরীক্ষাসহ শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টির দাবিতেই আমরা আজ মানববন্ধন করছি। ’
এরপর থেকেই প্রধানত সেশনজট নিরসন ও সব বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলার প্রয়াস চালায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ইত্যবসরে ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক তত্পরতা কমে যায়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষার পর পরীক্ষা নিতে শুরু করে। পরীক্ষা যেন লেগেই থাকে সারা বছর। শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর চেয়ে পরীক্ষার ওপর অধিক মনোযোগ ও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে সমালোচনাও করা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টির। তবে যে করেই হোক সেশনজটের মাত্রা কমে আসছে দিন দিন—এ কথা মানতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে একজন বা দু-চারজন কর্মকর্তার অবর্তমানে একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা আকস্মিক স্থগিত করে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি আবার কোন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাইছে তা আমাদের কাছে সহজবোধ্য নয়। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা দোষী নাকি নির্দোষ তা দেখবেন আদালত। কিন্তু এ জন্য পরীক্ষার মতো কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হবে কেন? একজন ব্যক্তি গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার স্থলে এক সপ্তাহে বা এরও বেশি সময়েও জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পাদন বা চালিয়ে যাওয়ার জন্য বিকল্প অন্য একজনকে বের করতে না পারা—এটা কী ধরনের সিস্টেম? এ ছাড়া পরীক্ষার নির্ধারিত তারিখের একেবারে দুই সপ্তাহ সময় হাতে থাকতেই অনিবার্য কারণ প্রদর্শন! আইনকে তার নিজস্ব গতিতেই চলতে দেওয়া উচিত। আমরা মনে করি, কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা থাকলে বিপুলসংখ্যক পরীক্ষার্থীর গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাটি সময়মতোই গ্রহণ করা যেত। যেকোনো ব্যাপারে গোঁ ধরে বসলে শুধু ‘ক্রাশ প্রগ্রাম’ নয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো অনেক কিছুই বাধাগ্রস্ত হতে পারে। যার মাসুল দিয়ে যেতে হবে আগের মতোই হাজার হাজার, লাখ লাখ হতভাগ্য পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের।
লেখক : কলেজ শিক্ষক