জাল সনদ: বিপুল সংখ্যক শিক্ষক নিয়ে বিপাকে মন্ত্রণালয় - দৈনিকশিক্ষা

জাল সনদ: বিপুল সংখ্যক শিক্ষক নিয়ে বিপাকে মন্ত্রণালয়

বিভাষ বাড়ৈ |

মোছাঃ আরজিনা বেগম কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন কম্পিউটার বিষয়ের এমপিওভুক্ত শিক্ষক। কারিগরি বোর্ড থেকে ২০০১ সালে কম্পিউটার শিক্ষায় ডিগ্রি নিয়ে সরকারের কাছে সনদ জমা দিয়ে তিনি এমপিওভুক্ত হয়েছেন। ২০০৫ সালের আগে শিক্ষা সনদ দেখিয়ে তার মতো কম্পিউটার বিষয়ে এমপিওভুক্ত হয়েছেন শত শত শিক্ষক। যারা সরকারি অনুদানভুক্ত হয়ে প্রতিমাসে সরকারী কোষাগার থেকে তুলছেন লাখ লাখ টাকা। অথচ শিক্ষা বোর্ড বলছে, ২০০৫ সালের আগে বোর্ড থেকে কম্পিউটার বিষয়ের কোন সনদই দেয়া হতো না।

কেবল এ একটি বিষয়েই নয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরের (ডিআইএ) তদন্তে একে একে বেরিয়ে আসছে সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের নামে সনদ জালিয়াতির উদ্বেগজনক সব তথ্য। কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, যুব উন্নয়ন অধিদফতর, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি, রয়েল ইউনিভার্সিটি, এশিয়ান ইউনিভার্সিটিসহ সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের নামে জাল সনদ দেখিয়ে মাউশির অসৎ কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে এমপিওভুক্ত হচ্ছেন শত শত শিক্ষক। কেউ যুব উন্নয়ন অধিদফতরের নামে সনদ বানিয়ে হচ্ছেন কারিগরি বিষয়ের এমপিওভুক্ত শিক্ষক, আবার বেসরকারী ইউনিভার্সিটির নামে ভুয়া বিএড, এমএড সনদ জমা দিয়ে নিচ্ছেন সরকারী অর্থ।

পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরের পরিচালক অধ্যাপক আহম্মেদ সাজ্জাদ রশীদ বলছিলেন, আমরা চাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সকল কাজ হবে শতভাগ স্বচ্ছ। এখানে কোন অনিয়ম চলবে না। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী আমাদের শিক্ষা পরিবারের জন্য একটি স্বচ্ছ পরিবেশ নিশ্চিত করতে কাজ করছেন। মাননীয় মন্ত্রী যেখানে বলছেন যে, এক টাকা দিয়ে দুই টাকার কাজ করতে হবে, সেখানে ভুয়া সনদ দেখিয়ে যদি সরকারের কোটি কোটি টাকা লোপাট হয় তা দেখার দায়িত্ব সকলের। আমরা বিভিন্ন সনদ যাচাই করতে দিয়ে দেখছি অসংখ্য ভুয়া সনদধারী এমপিও নিয়ে নিচ্ছেন। অপকর্ম করতে অনেকেই খোদ সরকারী প্রতিষ্ঠানের নামেও সনদ এনে জমা দিয়ে নিচ্ছেন এমপিও। আমরা যখন কোন তদন্ত বা পরিদশন করি তখন সরকারী সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করি। আর এটা করতে গিয়েই দেখা যায়, সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে আসলে ভুয়া সনদই জমা দিয়ে তারা নিয়েছেন সরকারী অনুদান। সরকারের এ কর্মকর্তা মনে করেন, যেহেতু অসংখ্য এমপিওধারীর এভাবে ভুয়া সনদ বলে প্রমাণিত হচ্ছে সেহেতু প্রয়োজন সরকারী অনুদান দেয়ার সময়েই তাদের সনদ যাচাই-বাছাই করা। আসলে দরকার একটা সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন। কিসের ভিত্তিতে এমপিওভুক্ত হবেন? কী কী যোগ্যতা দেখা হয়? এসব বিষয়ে যদি একটি সুনির্দিষ্ট গাইডলাইট ভালভাবে ফলো করা যায় তাহলে সরকারের কোটি কোটি টাকা এভাবে ভুয়া এমপিওর নামে লোপাট হতে পারবে না।

এক প্রশ্নের জবাবে ডিআইএ পরিচালক বলেন, আসলে মাউশি কি তাড়াহুড়ার কারণে এমপিও দেয়ার সময় এসব সনদ যাচাই-বাছাই করতে পারে না, না সুনির্দিষ্ট গাইডলাইনের অভাবে ভুলত্রুটি হচ্ছে সেটা ঠিক পরিষ্কার না। তবে এমপিও হয়ে যাওয়ার পর যখন আমরা তথ্য যাছাই করতে যাই তখনই বেরিয়ে আসছে ভুয়া সদনের ছড়াছড়ির তথ্য।

প্রতিষ্ঠানটির যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকারের মতে, অবশ্যই শিক্ষকদের এমপিও দেয়ার সময় এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা দরকার। অন্যথায় সরকারী অনুদানভুক্ত হয়ে মাসের পর মাস কখনও বছরের পর বছর সরকারী কোষাগার থেকে কোটি কোটি টাকা চলে যাওয়ার পর পদক্ষেপ নিয়ে জটিলতা খুব একটা কমে না। কারণ সাধারণত অভিযোগ পেলে কেবল তাদেরটাই দেখা হয়। যদি এমপিও দেয়ার সময় এসব সনদ দেখা হয় তাহলে অনেক বড় একটা সঙ্কট কেটে যায়।

জানা গেছে, যুব উন্নয়ন অধিদফতরের অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষক সনদ নিয়ে এমপিওভুক্তসহ সরকারী সুবিধা নিচ্ছেন সারাদেশের অসংখ্য কারিগরি শিক্ষক। প্রতিমাসে এমপিও হিসাবে এসব শিক্ষকের পেছনে সরকার ব্যয় করছে লাখ লাখ টাকা। তবে সম্প্রতি অধিদফতরের অনুমোদনপ্রাপ্ত ‘নুরুল ইসলাম যুব উন্নয়ন সোসাইটি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সনদের বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে চোখ কপালে ওঠার দশা ডিআইএর কর্মকর্তাদের। নমুনা হিসাবে মোহাম্মদ কামরুজ্জামান নামে একজনের সনদ যাচাই করতে যুব উন্নয়ন অধিদফতরের চিঠি পাঠিয়েছিল ডিআইএ।

প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক আহম্মেদ সাজ্জাদ রশীদকে যুব উন্নয়ন অধিদফতরের পরিচালক (প্রশিক্ষক) মোঃ জাহাঙ্গীর আলম লিখিতভাবে জানিয়েছেন, যুব উন্নয়ন অধিদফতরের প্রশিক্ষণ সনদপত্র প্রদানের কোন অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান নেই। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলিতে যুব উন্নয়ন অধিদফতর প্রশিক্ষণ শেষে সরাসরি সনদপত্র প্রদান করে থাকে। নুরুল ইসলাম যুব উন্নয়ন সোসাইটি নামের প্রতিষ্ঠানটি যুব উন্নয়ন অধিদফতরের কোন অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানও নয়।

শিক্ষকদের বিএড এবং এমএড সনদ নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ ছিল সময় সময়েই। তবে সম্প্রতি তিনটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে একের পর এক আসা সনদ নিয়ে রীতিমতো বেকায়দায়ই পড়ে যায় ডিআইএ। তবে এসব সনদ যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে ভুয়া সনদের কেলেঙ্কারি। অভিযোগ আসে অনেকে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকার বিনিময়ে সনদ কিনে মাউশিতে জমা দিয়ে সরকারী সুবিধা নিয়েছেন শতাধিক শিক্ষক। ডিআইএ‘র পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের কাছে শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা ও এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছিল।

এরপর মঞ্জুরী কমিশন জানিয়েছে, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজিতে দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে বিএড এবং এমএড প্রোগ্রামের অনুমোদন ছিল ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল থেকে ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। অনুমোদিত কেন্দ্র কেবল উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১ নম্বর বাড়ির মূল ক্যাম্পাস। রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকার বিএড বা এমএড প্রোগ্রামের দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে কার্যক্রম পরিচালনার কোন অনুমোদনই নেই বলে বলছে কমিশন। এছাড়া এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের বিষয়ে কমিশন বলেছে, ২০০৩ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাদের কেবল বিএড দূরশিক্ষন কার্যক্রমের অনুমোদন ছিল। এরপর থেকে শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজির মতো তাদের কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে।

অথচ ডিআইএ‘র তদন্তে একে একে বের হচ্ছে শয়ে শয়ে ভুয়া সনদ। সনদ খুঁজতে গেলেই দেখা যাচ্ছে, যখন এসব প্রতিষ্ঠানের কোন অনুমোদন ছিল না সেই তারিখের সনদ। ডিআইএর উপ-পরিচালক মোঃ রাশেদুজ্জামান কাজ করছেন বিষয়টি নিয়ে। তিনি বলছিলেন, শত শত এমপিও হয়েছে জাল সনদে। সরকারের কোটি কোটি টাকা নিয়ে নিচ্ছে অসৎ লোকজন। তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরে তিনি বলেন, এমপিও প্রদানের সময় এসব সনদ যাচাই-বাছাই করা যেমন দরকার তেমনি যেসব কর্মকর্তাদের হাত দিয়ে এসব এমপিও হয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া জরুরী।

এদিকে এমপিও‘র কাজ মাউশি থেকে জেলা ও উপজেলা এবং মাউশির ৯টি অঞ্চলে চলে যাওয়ার পর সঙ্কট আরও বেড়েছে। জেলা, উপজেলা শিক্ষা অফিস ও আঞ্চলিক অফিসে ঘুষ দিয়ে ভুয়া সনদধারীরা সহজেই নিয়ে নিচ্ছেন এমপিও। রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত একটি বেসরকারী ফ্যাশন ডিজাইন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএড সনদ নিয়ে এমপিওভুক্ত হয়েছেন আবুল কালাম আজাদ ও আব্দুল হাই। তাদের সনদ একই দিনে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইস্যু হলেও দুজনের সনদে ভিসির স্বাক্ষর ভিন্ন।

সনদ যাচাই করার সময় সন্দেহ হলে তা যাচাই করতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে পাঠানো হলে বেরিয়ে আসে ভুয়া সদনের তথ্য। এরকম কয়েক হাজার শিক্ষক রয়েছেন যারা জাল সনদে চাকরি করছেন বলে বলছে ডিআইএ। এদের মধ্যে প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক, কলেজের প্রভাষক এমনকি অধ্যক্ষ পর্যন্ত রয়েছেন। এদিকে এই সিন্ডিকেট ভাঙতে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

সম্প্রতি দুদকের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ মোরশেদ আলমের স্বাক্ষরিত চিঠিতে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ চারটি মহানগরীতে জাল সনদে ৫৫৬ জন শিক্ষকের তথ্য চাওয়া হয়েছে। একই চিঠিতে মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও গাজীপুর জেলায় নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের বিএড সনদের তালিকা চাওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সারা দেশে ভুয়া সনদের চাকরি করার শিক্ষকদের তালিকা চাওয়া হবে। বিষয়টি নিশ্চিত করে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর জানিয়েছে, দুদকের চাহিদা মোতাবেক সকল শিক্ষকের তথ্য দেয়া হয়েছে। দুদক আমাদের কাছে এসব শিক্ষকের নাম, যে শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ ভুয়া, আইডি ও বর্তমান কর্মস্থলের নাম চেয়েছিল তা দেয়া হয়েছে। সবাই কম্পিউটার, বিএড ও লাইব্রেরিয়ান সনদধারী।

ডিআইএ কর্মকর্তারা বলছেন, সারা দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক, প্রশাসনিক, একাডেমিক ও নিয়োগের বিষয়াদি নিয়মিত অডিট করা হয়। এসময় শিক্ষকদের সনদ যাচাই করতে গিয়ে প্রচুর শিক্ষকের সনদ ভুয়া বা জাল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি সরকার থেকে পাওয়া প্রাপ্ত অর্থ সরকারী কোষাগারে জমা দেয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় ও মাউশি’র বিশেষ কারণে তা আটকে যায়। উল্লেখযোগ্য কারও বিরুদ্ধে তেমন কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। এতে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা জলে যাচ্ছে।

 

সৌজন্যে: জনকণ্ঠ

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0033681392669678