তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যুগে অনেক বাগ্ধারার প্রচলন লক্ষ করা যাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম দুটি বাগ্ধারা হচ্ছে, ‘মাতা পিতা গুগল্দেব’ এবং ‘ডিজিটাল নেটিভ ও ডিজিটাল ইমিগ্র্যান্ট’। শিক্ষা জগতে মা-বাবার পরে শিক্ষকের স্থান। সে হিসেবে বলা হতো ‘মাতা-পিতা ও গুরুদেব’। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির কল্যাণে গুগুল সার্চের মাধ্যমে এখন সবকিছুই পাওয়া সম্ভব তাই ‘শিক্ষক’ বা ‘গুরুদেব’-এর স্থান দখল করছে ‘গুগল’। বলা হচ্ছে, ‘মাতা-পিতা গুগল্দেব’। অপরপক্ষে, ‘ডিজিটাল নেটিভ, ডিজিটাল ইমিগ্র্যান্ট’ বাগ্ধারাটি মার্ক প্রেনসকির একটি নিবন্ধে লক্ষ করা যায়। এমসিবি ইউনিভার্সিটি কর্তৃক প্রকাশিত ‘অন দ্য হরাইজন’-এর ভলিউম ৯, সংখ্যা ৫, অক্টোবর ২০০১ সংখ্যায় মার্ক প্রেনসকি’র ‘ডিজিটাল নেটিভস, ডিজিটাল ইমিগ্র্যান্টস’ নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল। শিক্ষা এবং শেখার জগতে প্রেনসকি হচ্ছেন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিন্তা-নেতা, বক্তা, লেখক, কনসালট্যান্ট এবং গেইম ডিজাইনার। তিনি ‘ডিজিটাল গেইম-বেইজ্ড লার্নিং’ শীর্ষক বইয়ের লেখক, খেলাভিত্তিক শেখার কোম্পানি ‘গেইমসটুট্রেন’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও এবং বিশ্বব্যাপী শিক্ষার ক্ষেত্রে ডিজিটাল বিভক্তি (ডিজিটাল ডিভাইড) নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে উৎসর্গীকৃত একটি সংগঠন ‘দ্য ডিজিটাল মাল্টিপ্লাইয়ার’-এর প্রতিষ্ঠাতা। এছাড়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত আরো অনেক কিছুর সঙ্গে প্রেনসকি জড়িত।
এটি একটি বিস্ময়কর ব্যাপার যে, শিক্ষা সম্পর্কিত সব ধরনের উত্তেজনাকর কথাবার্তা ও কর্মকাণ্ডের মধ্যে এসবকিছুর সবচেয়ে মৌলিক কারণটি অবজ্ঞা করা হচ্ছে। এটি বলাই বাহুল্য যে, আমাদের শিক্ষার্থীরা চরমভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা যে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেয়ার লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছিল ‘আজকের শিক্ষার্থী’ কোনো ক্রমেই আর সেই লোক নয়। আজকের শিক্ষার্থীরা অতীত থেকে শুধু ক্রমবর্ধমান হারেই পরিবর্তিত হয়নি, অতীত প্রজন্মে ¯øাং, কাপড়-চোপড়, দেহের ভূষণ, অথবা স্টাইল প্রভৃতির ক্ষেত্রে যা ঘটেছিল শুধু তা থেকেই বর্তমান প্রজন্ম ভিন্ন নয়। আসলেই একটি বিরাট বিচ্ছিন্নতা ঘটে গিয়েছে। এটিকে ‘সিঙ্গুলারিটি’ বা অস্বাভাবিক কোনো কিছু হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে, এমন একটি ঘটনা যা বিষয়গুলোকে এমনভাবে পরিবর্তিত করেছে যা থেকে পিছিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই তথাকথিত ‘আস্বাভাবিক ঘটনা’, বিগত বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকগুলোতে আগত ও দ্রুত বিস্তৃত ডিজিটাল প্রযুক্তি।
আজকের শিক্ষার্থীরা কলেজের শুরুর বছর থেকে এই নতুন প্রযুক্তিতে বেড়ে ওঠা প্রথম প্রজন্মকে প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। তারা কম্পিউটার, ভিডিও গেইমস, ডিজিটাল মিউজিক প্লেয়ার্স, ভিডিও ক্যামেরা, সেল ফোন, এবং ডিজিটাল যুগের সব খেলনা ও যন্ত্রপাতির দ্বারা পরিবেষ্টিত থেকে ও সেগুলো ব্যবহার করে তাদের জীবন অতিবাহিত হচ্ছে। এটি এখন স্পষ্ট যে এই সর্বব্যাপী পরিবেশের ফলশ্রæতিতে এবং এগুলোর সঙ্গে তাদের নিছক মিথস্ক্রিয়ার ফলে আজকের শিক্ষার্থীরা মৌলিকভাবেই তাদের পূর্ব পুরুষদের থেকে তথ্যকে ভিন্নভাবে ‘চিন্তা ও প্রক্রিয়া’ করে থাকে। বেশিরভাগ শিক্ষাবিদরা যা সন্দেহ করে ও ধারণা করে তা থেকেও অনেক দূরে ও গভীরে এই পার্থক্যগুলোর উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এক্ষেত্রে বেইলর কলেজ অব মেডিসিন এর ডা. ব্রুস ডি. পেরি’র পর্যবেক্ষণ প্রণিধানযোগ্য। ডা. ব্রুস বলছেন, ‘বিভিন্ন প্রকারের অভিজ্ঞতা বিভিন্ন ব্রেইন কাঠামোর দিকে নিয়ে যায়’। তাদের বেড়ে ওঠার পদ্ধতির কারণে আমাদের থেকে তারা (নতুন প্রজন্ম) সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবে এগুলো আক্ষরিক অর্থেই সত্য কি না। আমরা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি যে তাদের (নতুন প্রজন্মের) চিন্তন প্যাটার্ন পরিবর্তিত হয়েছে। আজকের এই ‘নতুন’ শিক্ষার্থীদের আমরা কী বলব? কেউ কেউ তাদেরকে এন [নেট-এর এন] প্রজন্ম অথবা ডি [ডিজিটাল-এর ডি]-প্রজন্ম বলে থাকেন। তবে প্রেনসকি এই প্রজন্মকে ‘ডিজিটাল নেটিভ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কম্পিউটার, ভিডিও গেইমস এবং ইন্টারনেটের ভাষা বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষার্থীরা আজ ‘নেটিভ স্পিকার্স’। সুতরাং এটি আমাদের অবশিষ্টদের জন্য কী তৈরি করে? আমাদের যারা এই ডিজিটাল বিশ্বে জন্মগ্রহণ করিনি, পরবর্তীকালে আমাদের জীবনে এটিতে আসক্ত হয়ে এবং কাজে লাগিয়ে অথবা সামঞ্জস্য বিধান করে নতুন প্রযুক্তির অনেক অথবা অধিকাংশ বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছি এবং সব সময় তাদের (নতুন প্রজন্মের) সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছি, তাদের (নতুন প্রজন্মের) সঙ্গে তুলনা করলে, আমরা সব সময়ই ‘ডিজিটাল ইমিগ্রান্টস’।
এই পার্থক্যের গুরুত্ব হচ্ছে : একজন ডিজিটাল ইমিগ্র্যান্ট শেখে- যেমনটি অন্য শিক্ষার্থীরাও শিখে থাকেন। কেউ কেউ অন্যদের চেয়ে ভালোভাবে শিখতে পারেন, পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করতে পারেন, কিছু মাত্রায় তারা সব সময় চলমান থাকতে পারেন, তাদের ‘গুরুত্ব’, অর্থাৎ, তাদের পা অতীতে রেখে। ‘ডিজিটাল ইমিগ্র্যান্ট প্রজন্ম’-এর কাছে তথ্যের জন্য ইন্টারনেটের অবস্থান সব সময় ‘দ্বিতীয়’, এবং কোনো সময়েই ‘প্রথম’ নয় ! অথবা প্রোগ্রাম নিজেই আমাদের এর ব্যবহার শিখিয়ে নেয় এটি অনুধাবনের পরিবর্তে প্রোগ্রামের জন্য ম্যানুয়েল পড়া। আজকের অধিকতর বয়স্ক ব্যক্তিরা তাদের ছেলেমেয়েদের চেয়ে ভিন্নভাবে ‘সামাজিকীকৃত’ হয়ে থাকেন এবং এখন একটি নতুন ভাষা শেখার প্রক্রিয়ায় আছেন। আর জীবনের পরবর্তীকালে একটি ভাষা শেখার অর্থ হচ্ছে, বৈজ্ঞানিকরা বলেন, ব্রেইনের ভিন্ন একটি অংশে যায়।
ডিজিটাল ইমিগ্র্যান্ট কাজের শত শত উদাহরণ আছে। এগুলোর মধ্যে আছে আপনার ই-মেইলের প্রিন্টিং আউট (অথবা আপনার ই-মেইলটি প্রিন্ট করার জন্য সেক্রেটারিকে বলুন অথবা এর চেয়েও বেমানান ধরনের কথাবার্তা); এডিট করার জন্য কম্পিউটারে লিখিত একটি ডকুমেন্ট প্রিন্ট করা প্রয়োজন (শুধু স্ক্রিনে এডিট করার পরিবর্তে); এবং একটি ইন্টারেস্টিং ওয়েবসাইট পড়ার জন্য শারীরিকভাবে লোকজনকে অফিসে নিয়ে আসা (তাদের কাছে ইউআরএল পাঠিয়ে দেয়ার পরিবর্তে)। প্রেনসকি বলছেন, ‘আমি নিশ্চিত তেমন কোনো প্রচেষ্টা ছাড়াই এ ধরনের দু’একটি উদাহরণ আপনি চিন্তা করতে পারবেন।’ এক্ষেত্রে প্রেনসকির নিজের পছন্দের উদাহরণ হচ্ছে, ‘আপনি কি আমার ই-মেইলটি পেয়েছেন?’ ধরনের ফোন কল। আমাদের মধ্যে যারা ‘ডিজিটাল ইমিগ্র্যান্ট’ তারা হাসতে পারেন অথবা নিজেদের কাজের জন্যই তারা নিজেদের ‘গুরুত্ব’ চিন্তা করে হাসতে পারেন।
তবে এটি শুধু কৌতুক নয়। এটি একটি খুব সিরিয়াস ব্যাপার, কারণ আজকের ‘শিক্ষা’র সবচেয়ে বড় একক সমস্যা হচ্ছে আমাদের ডিজিটাল ইমিগ্র্যান্ট শিক্ষকরা, যারা আউটডেটেড ভাষায় কথা বলেন (প্রাক-ডিজিটাল যুগের), এমন একটি প্রজন্মকে শিক্ষাদানের জন্য চেষ্টা করছেন যারা পুরোপুরিভাবে একটি নতুন ভাষায় কথা বলে থাকে। এটি স্পষ্টত ‘ডিজিটাল নেটিভ’-দের জন্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এমনসব ভারি গুরুত্বসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গকে নিয়োগদান করে সন্তুষ্ট থাকে একথা মনে করে যে তারা একটা খুব ভালো কাজ করেছে। কিন্তু বাস্তবে ‘ডিজিটাল নেটিভদের’ উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করার লক্ষ্যে নির্বোধ বিদেশিদের নিয়োগ দিয়ে থাকেন। ‘ডিজিটাল ইমিগ্র্যান্টরা’ কী বলছেন ‘ডিজিটাল নেটিভরা’ তা প্রায়শ বুঝতে পারেন না।
দুই. বিশ্বব্যাপী এই পরিবর্তনের হাওয়া ইতোমধ্যে বাংলাদেশের প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশ এখন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি তথা উন্নয়নের মহাসড়ক অতিক্রম করছে। তবে সমাজ ব্যবস্থা কতটুকু অগ্রসর হতে পেরেছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ইতোমধ্যে অবশ্য, বাংলাদেশে একটি বিষয় নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ‘যেকোনো ধরনের গুরুত্বপূর্ণ’ সিদ্ধান্তগুলো নেয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভূমিকা খুবই নগণ্য এবং গৌণ! এটি হচ্ছে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে। অপরদিকে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রাক্-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে অবস্থাটা কেমন? সে সম্পর্কেও এদেশে কোনো গবেষণা নেই। তবে যেমনটি প্রায়ই লক্ষ্য করা যায় যে শিক্ষক যদি উদ্ভাবনী বা সৃজনশীল না হন, বা সুযোগ-সুবিধার জন্য গাতানুগতিক এবং বিদ্যমান পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেন তাহলে শিক্ষার্থীরা গুগল সার্চ দিয়ে সেখান থেকে ‘কপি-পেস্ট’ বা ‘কাটিং-পেস্টিং’ করে এসাইনমেন্ট থেকে শুরু করে যা যা প্রয়োজন তা করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। এভাবে শিক্ষার্থীরা যখন দেখছে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চললে লেখাপড়া থেকে শুরু করে সবকিছুই শিক্ষককে ফাঁকি দিয়ে চালানো সম্ভব। তখন তারা নিজেদের ইচ্ছামতো চলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। ইতোমধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগে মাস্টার্স প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষার তারিখ ঘোষণার পর দেখা গেল ঘোষিত সময় অনুযায়ী পরীক্ষা হলে দু’একজন শিক্ষার্থীর অসুবিধা হচ্ছে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেল, একটি ছাত্র সংগঠনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সম্মেলন হয়েছে কিন্তু এখনো কমিটি হয়নি। তাই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রয়োজনে দিন-রাত সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে দেখা করতে হয়।
গ্রুপিং, লবিং করতে হয়। পরীক্ষার কারণে এসব কাজে উপস্থিত না থাকলে তারা অসন্ন কমিটি থেকে বাদ পড়ে যেতে পারে। কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত না হতে পারার আশঙ্কা থেকে তারা তাই অন্যদের উদ্বুদ্ধ করছে কর্তৃপক্ষের কাছে এসে পরীক্ষা পেছানোর দাবি করার জন্য। হচ্ছেও তাই। এখানে দেখা যাচ্ছে, এমনকি পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণের ক্ষেত্রেও শিক্ষকদের বা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত টিকছে না। তাহলে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তে শিক্ষক অগুরুত্বপূর্ণ, শিক্ষার্থীদের সময় মতো কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে শিক্ষক অসহায় এবং সর্বোপরি ‘কাটিং পেস্টিংয়ের’ প্রবণতার কারণে সেখানেও শিক্ষকের কোনো ভূমিকা গ্রহণের সম্ভাবনা থাকে না। এই অবস্থায়, ‘শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকাই প্রধান’ বক্তব্যটি শুধু কথার কথা হিসেবেই থাকছে (!), অন্য কিছু নয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তাই ‘গুগলের’ জায়গা দখল করেছে ‘রাজনীতি’। অথবা বলা চলে রাজনীতি দ্বারা পরিচালিত ‘গুগল’।
ইতোমধ্যে বিশ্ব অর্থনীতি কৃষি যুগ থেকে শিল্প যুগ এবং শিল্প যুগ থেকে ‘তথ্যপ্রযুক্তির যুগে’ প্রবেশ করেছে। ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির’ এই যুগে শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। এখন ফেসবুক, ট্যুইটার প্রভৃতি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে মানুষ পরস্পরের সঙ্গে ভাব বিনিময় করে থাকে। সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশের বাঙালিদের মন-মানসিকতার কোন অংশ কতটুকু বদলিয়েছে- তা নিয়ে গবেষণার অবকাশ আছে। এ ধরনের গবেষণা এখনো হয়নি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন রিচার্ড রিলে। রিলে একবার বলেছিলেন, ‘এমনকি এখনো যেসব সমস্যা আমার জানি না তেমন সব সমস্যা সমাধান করতে আমরা বর্তমানে শিক্ষার্থীদের, যেসব প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়নি, সেগুলো ব্যবহার করে চাকরির জন্য প্রস্তুত করছি, যার অস্তিত্ব এখনো নেই।’
কোনো ধরনের হৈহুল্লোড় বা আতশবাজির আলোর রোশনাই ছাড়া মানব সমাজে ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি’ খাতের প্রাধান্য সূচিত হয়েছিল। ১৯৯১ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিল্প যুগের পণ্যাদি- যেমন কৃষি, খনি, নির্মাণ, ম্যানুফ্যাকাচারিং, পরিবহন, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং এ ধরনের পণ্যাদি উৎপাদনের জন্য মোট ব্যয়িত অর্থের চেয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, যেমন কম্পিউটার, সার্ভার্স, প্রিন্টার্স, সফটঅয়্যার, ফোন, নেটওয়ার্কিং ডিভাউস ও সিস্টেমস এবং এ ধরনের পণ্যাদি উৎপাদনের পেছনে বেশি অর্থ ব্যয়িত হয়েছিল। আর এর ফলে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জ্ঞান যুগের ব্যয় শিল্প যুগের ব্যয়কে ৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায় (১১২ বিলিয়ন বনাম ১০৭ বিলিয়ন ডলার)। সেই বছরটিকে (অর্থাৎ ১৯৯১ সালকে) তথ্য, জ্ঞান ও উদ্ভাবনের নতুন যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তখন থেকে, বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রগুলো বস্তুগত বিশ্বের অনু ও মলিকিউলের ব্যবস্থাপনার চেয়ে ক্রমবর্ধমান হারে তথ্যের বিটস ও বাইটস তৈরি, ম্যানিপ্যুলেটিং, ব্যবস্থাপনা এবং স্থানান্তরের জন্য ব্যয় করছে। শিল্প যুগের উৎপাদন থেকে জ্ঞান যুগের অর্থনীতিতে এই বিশাল বদল- তথ্য-চালিত, বৈশ্বিক নেটওয়ার্ককৃত- প্রায় চারশ বছর আগে কৃষি যুগ থেকে শিল্প যুগে বদলের মতো বিশ্ব পরিবর্তনীয় এবং জীবন পরিবর্তনীয়ের মতো ছিল। প্রাথমিকভাবে একটি নাট-বোল্ট কারখানা এবং ম্যানুফ্যাকচারিং অর্থনীতি হতে উপাত্ত, তথ্য, জ্ঞান এবং দক্ষতাভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হওয়া বিশ্ব অর্থনীতি ও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিরাট প্রভাব বিস্তার করে থাকে। একটি পণ্য অথবা সেবা উৎপন্ন করার পদক্ষেপগুলোর অনুক্রম, অর্থাৎ কাজের মূল্য পরম্পরা নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।
শিল্প অর্থনীতিগুলোর লক্ষ্য, লোহা এবং ক্রুড তেলের মতো প্রাকৃতিক সম্পদগুলোকে অটোমোবাইল এবং গ্যাসোলিনে রূপান্তরিত করার দিকে। অপরদিকে, জ্ঞান অর্থনীতির লক্ষ্য হচ্ছে তথ্য, দক্ষতা এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনগুলোকে সেবায় রূপান্তরিত করা। যেমন চিকিৎসাসেবা এবং সেল ফোন কভারেজের জন্য তথ্য ভাণ্ডারকে ব্যবহার করা। এর অর্থ এই নয় যে, শিল্প যুগ, জ্ঞানভিত্তিক যুগের সঙ্গে মিলে যাবে। এটি কিন্তু মোটেই তা নয়। কারণ আমাদের ম্যানুফ্যাকচারিং পণ্য সব সময়েই প্রয়োজন। এর অর্থ হচ্ছে ক্রমবর্ধমান অটোমেশন এবং ম্যানুফ্যাকচারিং (এবং পরিবেশগত প্রভাব) হতে স্বল্প মজুরি, শিল্পসমৃদ্ধ দেশ যেমন চীন, ভারত এবং ব্রাজিল প্রভৃতি দেশের ‘শিল্প অর্থনীতি’ ‘জ্ঞান অর্থনীতির’ সঙ্গে কাজ করতে থাকবে।
শিল্পযুগে মূল্য অনুক্রম: এক্সট্রাকশন > ম্যানুফ্যাকচারিং > সংযোজন > বাজারজাতকরণ> বণ্টন> উৎপাদিত পণ্য (এবং সেবা)।
জ্ঞানযুগে মূল্য অনুক্রম : উপাত্ত > তথ্য > জ্ঞান > দক্ষতা > বাজারজাতকরণ > উৎপাদিত সেবা (এবং পণ্য)।
একটি জাতির উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ভাণ্ডারে সহজ প্রবেশের সুযোগ এনে দিতে পারে তথ্যপ্রযুক্তি। সমগ্র বিশ্বব্যাপী বর্তমানে বড় বড় তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি খোলা হচ্ছে। এবং বিভিন্ন দেশ তথ্যপ্রযুক্তি প্লাটফর্ম খুলছে এবং তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের বিকাশ ও উন্নতির জন্য কাজ করছে। এশিয়ার দেশগুলোও এই সমৃদ্ধির স্টেকহোল্ডার। মাইক্রোসফ্ট, অ্যাপ্ল, স্যামসাং, প্রভৃতি কোম্পানিগুলো এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করছে। ভারত, মালয়েশিয়া এবং চীনের চেয়ে সস্তা শ্রম সমৃদ্ধ বাংলাদেশের আছে বিশাল অব্যবহৃত মানবসম্পদ। যা থেকে এদেশে লাভবান হতে পারে। ইতোমধ্যে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়েছে। আরো বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।
আধুনিক অর্থনীতি ও সমাজের উন্নয়নে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে থাকে। বিশ্ব যখন প্রযুক্তিগত বিপ্লব অতিক্রম করছে সেই সময় শিক্ষা ব্যবস্তায় নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেই ক্ষেত্রে ‘ডিজিটাল ইমিগ্র্যান্ট’ শিক্ষক যদি ‘ডিজিটাল নেটিভ’ শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছাতে চায় তাহলে (ইমিগ্র্যান্ট) শিক্ষকদের প্রধান কাজ হবে নিজেদের পরিবর্তন করা।
অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী : চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।