ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি প্রসঙ্গে - Dainikshiksha

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি প্রসঙ্গে

মাছুম বিল্লাহ |

আমাদের দেশের সরকারি-বেসরকারি কলেজগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিভুক্ত ছিল। সেশনজট, পরীক্ষাজট, ফল প্রকাশজটসহ নানা রকম জটিলতার মধ্যে ছিল অধিভুক্ত কলেজগুলো। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের পরীক্ষা, একাডেমিক, প্রশাসনিক কাজসহ অন্যান্য কাজ নিয়েই হিমশিম খেত। তাই প্রতিষ্ঠা করা হলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এসব কলেজ ন্যস্ত করা হলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। মুক্তি দেওয়া হলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে, যাতে তারা সঠিকভাবে এবং নিয়মিত নিজেদের কাজ করতে পারে, শিক্ষার মান উন্নত করতে পারে, গবেষণার দিকে বেশি মনোযোগী হতে পারে। কিন্তু কোনোটিরই অবস্থা আশানুরূপ হলো না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হলো সনদ দেওয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাঠের উন্নয়ন, শিক্ষার মান, শিক্ষকদের মান উন্নয়ন, গবেষণা—কোনোটিই হলো না।

এদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কলেজগুলো থেকে ভারমুক্ত হওয়ার পরও নিজেদের মান উন্নয়ন কিংবা ডিসিপ্লিনের ক্ষেত্রে উদাহরণ দেওয়ার মতো কিছু করে দেখাতে পারেনি। ছাত্ররাজনীতি ও শিক্ষকরাজনীতি আরো যেন জাঁকিয়ে বসল। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বহু লেখালেখি, বহু আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছুই হচ্ছে না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতা দেখার ইতিহাসও আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির এক বক্তব্যে এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে মিডিয়ার মাধ্যমে শুনেছি। খাতা পরীক্ষকের কাছে থাকা অবস্থায়ই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ফল ঘোষণা করেছে—অর্থাৎ খাতা না দেখেই নম্বর প্রদান ও ফল ঘোষণা করা হয়েছে। এজাতীয় হাজারো ঘটনা ও অনিয়ম আমরা বিশ্ববিদ্যালয়টি সম্পর্কে অহরহ শুনতে পাই। তাই আবারও প্রশ্ন উঠেছে, এতগুলো কলেজ (দুই হাজারের অধিক) একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা কতটা যুক্তিসংগত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান যেহেতু তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, তাই অনেক শিক্ষাবিদ মতামত প্রকাশ করেছেন যে দেশের কলেজগুলোকে আবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধীনে ন্যস্ত করা হোক, তাহলে শিক্ষার মান আবার ধীরে ধীরে ফিরে আসবে। সম্ভবত সেই চিন্তা থেকেই ঢাকা সিটির সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয় এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে।

এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা কলেজ, তিতুমীর কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা কলেজ, কবি নজরুল ইসলাম কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও মিরপুর বাঙলা কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। এগুলো সবই সরকারি কলেজ এবং এগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল। ওই ঘোষণা পর্যন্তই। তার পর থেকে এখন পর্যন্ত তাদের পাঠ্যসূচি, পাঠ্যক্রম, পরীক্ষার দিন-তারিখ ও পদ্ধতি—কিছুই শিক্ষার্থীদের স্পষ্ট করে জানানো হয়নি। তারা অনেকটাই অন্ধকারে। লেখাপড়া ও ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছিল শিক্ষার্থীরা। তারা বহুবার কলেজগুলোকে তাগিদ দেওয়ার পরও এসব ব্যাপারে কোনো সুরাহা হয়নি। বাধ্য হয়ে দ্রুত পরীক্ষা নেওয়াসহ সাত দফা দাবিতে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। সাতটি কলেজের কয়েক শ শিক্ষার্থী জড়ো হয় শাহবাগে। সমস্যা হলো, আমাদের দেশের কর্তৃপক্ষ সামনের বিষয় নিয়ে কখনোই যেন ভাবার সময় পায় না। কলেজগুলো অধিভুক্ত ঘোষণা দিয়ে দিলেই তো আর সব হয়ে গেল না। কিভাবে কী করা হবে, সেসব বিষয় নিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। বিষয়গুলো স্পষ্ট করতে হবে। কতগুলো প্রশ্ন আমাদের মনেও জাগে। যেমন—এই কলেজগুলোর পরীক্ষা কারা পরিচালনা করবে, প্রশ্ন কারা করবেন, প্রশাসনিক কাজগুলো কবে থেকে এবং কিভাবে পরিচালিত হবে ইত্যাদি। যারা এসব কলেজের শিক্ষার্থী, তাদের তো হাজারো প্রশ্ন থাকবেই, তাদের মধ্যে অস্থিরতা থাকবেই। তাদের প্রশ্নের উত্তর, জিজ্ঞাস্য—সব কিছুর উত্তর সঠিক সময়ে দিতে হবে, তা না হলে তারা তো রাস্তায় নেমে আসবেই।

পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়া তাড়াহুড়া করে কলেজগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। ফলে কোনো পরীক্ষা শুরু করা যাচ্ছে না। একই সঙ্গে থাকা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত অন্য কলেজগুলোর কয়েকটি বর্ষের পরীক্ষা হয়েছে। কোনো কোনো পরীক্ষার ফলও প্রকাশ করা হয়ে গেছে। কিন্তু এসব কলেজের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা না হওয়ায় শিক্ষাজীবন থেকে তারা পিছিয়ে পড়ছে। চাকরির ক্ষেত্রেও তাদের সমস্যা হবে—অর্থাৎ চাকরিতে দরখাস্ত করতে পারবে না। অনেকের বয়স শেষ হয়ে যাবে, অনেকে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০ হাজার শিক্ষার্থী। তাদের সীমিত লোকবল দ্বারা সব ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হিমশিম খাচ্ছে। সেমিস্টার পদ্ধতিতে একটি বর্ষে প্রতি দুই সেমিস্টারে চারটি করে আটটি কোর্সে পাঠদান করা হয়। চার মাস পড়ানোর পর ফল প্রকাশ করতে হয় দুই মাসের মধ্যেই। ক্রমাগতভাবে বিভাগের সংখ্যা বাড়ায় পরীক্ষার হল ফাঁকা থাকে না। সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও পরীক্ষা নিতে হয়। পর্যাপ্ত জনবল ও প্রস্তুতি ছাড়াই সাতটি কলেজের বাড়তি দুই লাখ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা নেওয়া, খাতা মূল্যায়ন করা, ফল প্রকাশ, রেজিস্ট্রেশন ফরম পূরণসহ নানা ধরনের কাজ পরিচালনা করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে কতটা সম্ভব হবে, সেটাই এখন প্রশ্ন।

শিক্ষার্থীরা যেসব দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছে, সেগুলো হচ্ছে—(ক) কলেজগুলোর বিষয়ের ব্যাপারে নীতিমালা প্রণয়ন এবং প্রকাশ (একাডেমিক সিলেবাস, পরীক্ষা পদ্ধতি, প্রশ্নের ধরন, প্রশ্নের মান বণ্টন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কলেজগুলোর সম্পর্ক ইত্যাদি)। (খ) সম্মান দ্বিতীয় ও চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের মৌখিক বা ব্যবহারিক পরীক্ষা অল্প সময়ে নিয়ে দ্রুত ফল প্রকাশ, (গ) সম্মান তৃতীয় ও মাস্টার্স শেষ বর্ষের পরীক্ষা দ্রুত গ্রহণ, (ঘ) ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের মাস্টার্স শেষ পর্বের ভর্তি কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা, (ঙ) ডিগ্রির আটকে থাকা সব বর্ষের পরীক্ষা দ্রুত শেষ করা, (চ) অধিভুক্ত কলেজগুলোর সব তথ্যসংবলিত একটি ওয়েবসাইট তৈরি করা এবং (ছ) শিক্ষার মান উন্নয়ন ও সেশনজট নিরসনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ। শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর কোনোটিই কিন্তু অযৌক্তিক নয়।

শাহবাগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত হওয়া সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সহিংস আন্দোলনের মুখে অবশেষে বিভিন্ন বর্ষের পরীক্ষার সময়সূচি প্রকাশ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তড়িঘড়ি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধিভুক্ত সাত কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে মিটিংয়ে বসেন এবং মৌখিকভাবে বিভিন্ন পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেন। অর্থাৎ তাঁরা যেন অপেক্ষায়ই থাকেন যে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করুক, তারপর কাজ শুরু করা হবে। এখন থেকে অনার্সের খাতা মূল্যায়নে দুজন পরীক্ষক থাকবেন। এটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত। একজন পরীক্ষকের দেখা খাতা দিয়ে কখনো সঠিক মূল্যায়ন হয় না। কমপক্ষে দুজন দেখলে অন্তত কিছুটা ভালো হয়। একই সময়ে সাতটি কলেজে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। তবে এ ক্ষেত্রে পরীক্ষাকেন্দ্র ‘ইন্টার-চেঞ্জ’ হবে। এক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অন্য প্রতিষ্ঠানে গিয়ে পরীক্ষা দেবে। এ ছাড়া সাত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা ভর্তি পরীক্ষা হবে। শুধু এ বছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা আবেদন করতে পারবে। ফলে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থাকছে না। সাতটি কলেজের পরীক্ষা কেন্দ্রীয়ভাবে হবে। মাস্টার্স শেষ বর্ষের পরীক্ষা ১০ সেপ্টেম্বর, অনার্স তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা ১৬ অক্টোবর, ডিগ্রি প্রথম ও তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা আগামী ৪ নভেম্বর শুরু হবে। এ ছাড়া ডিগ্রি প্রথম বর্ষ, মাস্টার্স প্রথম ও শেষ পর্বের প্রাইভেট রেজিস্ট্রেশন পরীক্ষা ২৫ জুলাই থেকে ২৯ আগস্টের মধ্যে হতে পারে।

বিলম্বের বিষয় সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে যে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন, পরীক্ষা নেওয়াসহ আনুষঙ্গিক কাজ শুরু করতে তাদের ব্যাপারে তথ্য চেয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে কয়েক দফা চিঠি পাঠিয়েও পূর্ণাঙ্গ তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে তথ্য না থাকায় তাদের রেজিস্ট্রেশন ও পরীক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অধিভুক্ত হওয়ার আগে যাদের লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছে, তাদের টেবুলেশনশিট রয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলেজগুলো অধিভুক্তির পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টেবুলেশনশিট ও পরীক্ষার চূড়ান্ত নম্বর না পাওয়ায় তারা ফল প্রকাশ করতে পারছে না। এতে শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে। বিভিন্ন জটিলতার কারণে এসব কলেজের শিক্ষার্থীরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে ৯ মাস পিছিয়ে আছে। তাদের প্রশ্ন—তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়ে তাদের কী লাভ হলো? উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের এই প্রশ্নের জবাব সঠিকভাবে ও সঠিক সময়ে দেবে বলে আমরা আশা করি।

মাছুম বিল্লাহ: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক, ব্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ শিক্ষক।

মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি - dainik shiksha মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! - dainik shiksha খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ - dainik shiksha এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে - dainik shiksha মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা - dainik shiksha মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! - dainik shiksha মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0045969486236572