ঢাকা বোর্ডে ৭ দুর্নীতিবাজের সিন্ডিকেট, চেয়ারম্যান পদ নিলামে - দৈনিকশিক্ষা

ঢাকা বোর্ডে ৭ দুর্নীতিবাজের সিন্ডিকেট, চেয়ারম্যান পদ নিলামে

নিজস্ব প্রতিবেদক |

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে সাত সদস্যের একটি শক্তিশালী দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা সবাই বি সি এস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের। তারাই বোর্ডের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। মন্ত্রণালয়ের এদের আশ্রয়দাতা একজন অতিরিক্ত সচিব।

তিনিও বি সি  এস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত। সরকারি চাকরিতে প্রেষণ পদে সর্বোচ্চ তিন বছর চাকরির বিধান থাকলেও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে ১০ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত চাকরি করছেন এই চক্রের সদস্যরা। এ সুযোগে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থের মালিক বনে গেছেন কেউ কেউ। যেন দুর্নীতির হাট বসেছে এখানে।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদটি খালি গত ৬ জানুয়ারি থেকে। ঢাকার একটি সরকারি কলেজের একজন অধ্যক্ষকে চেয়ারম্যান বানানোর পায়ঁতারা করে অবশ্য ব্যর্থ হয়েছে এই সিন্ডিকেট। গতমাসে দৈনিকশিক্ষায় প্রতিবেদন প্রকাশের পর সেই পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। নতুন করে গতকাল সোমবার আবার একজনের নামের প্রস্তাব গেছে। এই প্রস্তাবটি মন্ত্রণালয়ে পৌঁছানোর আগে নিলামে ওঠে। ঢাকা বোর্ডে রয়েছে কোটি কোটি টাকার কেনাকাটা ও পরীক্ষা কেন্দ্র ও জিপিএ ফাইভ বিক্রির ব্যবসা। কামাল উদ্দিন নামের শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তাকে সোমবার দিনভর নিলাম নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। নায়েমের মহাপরিচালক পদটিও নিলামে তোলার পরিকল্পনা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

নজিরবিহীনভাবে ঢাকা বোর্ডের সচিব মো. শাহেদুল খবির চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।তিনি বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের সহযোগী অধ্যাপক। অথচ বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সচিব- উভয় পদেই অধ্যাপকদের পদায়নের রেওয়াজ চলে আসছে যুগ যুগ যাবত। ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদাধিকারবলে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির সভাপতি। অধ্যাপক না হওয়া সত্ত্বেও শাহেদুল খবির চৌধুরীকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়ায় পদটির অমর্যাদা হচ্ছে বলে একাধিক বোর্ডের চেয়ারম্যান অভিযোগ করেন। তারা আরও বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ আরও কিছু সিদ্ধান্তের ইস্যুতে তারা শাহেদুল খবিরের সঙ্গে বৈঠক করতেও বিব্রত হচ্ছেন। দেশের বাকি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানরা প্রত্যেকেই জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক। বিষয়টি জিইয়ে রেখেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেই অতিরিক্ত সচিব। শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সচিবের নিচের কলেজ ও স্কুল পরিদর্শক পদ দুটিও অধ্যাপক পদমর্যাদার। পূর্ণ অধ্যাপক হয়েও কলেজ পরিদর্শক ড. আশফাকুস সালেহীন ও বিদ্যালয় পরিদর্শক এ টি এম মইনুল হোসেনকে একজন সহযোগী অধ্যাপকের অধীনে চাকরি করতে হচ্ছে। জানা গেছে, জুনিয়রকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়ায় ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ অনেকেই।

অভিযোগ রয়েছে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহেদুল খবির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ওই সময়ে ‘জা’ আদ্যাক্ষরের একই সংগঠনের এক বড় ভাইয়ের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন তিনি। বর্তমানে ওই বড় ভাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব। তিনিই তাকে বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বে বসিয়েছেন। ওই কর্মকর্তা তাকে দিয়েই বোর্ড চালাতে চাইছেন। এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ এই পদে অন্য কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে না। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অনভিজ্ঞ হওয়ায় চলমান এসএসসি পরীক্ষায় ধারাবাহিকভাবে প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতেও ব্যর্থ হয়েছে ঢাকা বোর্ড। ঢাকার একটি পাঁচ তারকা হোটেল থেকে রাত সাড়ে বারোটায় কথিত সভা করে বের হওয়ার পর গুলিবিদ্ধ হন শাহেদুল খবির। কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও তদন্ত শেষ হয়নি তার গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনার। জানা যায়, ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথমে তিনি বোর্ডের স্কুল পরিদর্শক হিসেবে প্রেষণে দায়িত্ব পান। পরে হন ভারপ্রাপ্ত সচিব। সেখান থেকে সচিব হন। অর্থাৎ টানা নয় বছর এই বোর্ডে প্রেষণে আছেন। চাকরিবিধি অনুযায়ী তিন বছরের বেশি সরকারি কর্মকর্তারা প্রেষণে থাকার নিয়ম নেই। এ বিধি লঙ্ঘন করেই তিনি বোর্ডে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। অভিযোগ রয়েছে, দুর্নীতিবাজ এই সিন্ডিকেটকে খুশি না করলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠদানের অনুমোদন, স্বীকৃতি, পরীক্ষার কেন্দ্র, প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর আসন নির্ধারণ, পরীক্ষক, প্রধান পরীক্ষক নিয়োগসহ বোর্ডের কোনো সেবা মেলে না।

২০০৯ খ্রিস্টাব্দে উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হয়ে বোর্ডে আসেন তপন কুমার সরকার। বর্তমানে তিনি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক। এই পদেও অধ্যাপকদের পদায়ন হয়েছে যুগ যুগ যাবত। তপন কুমার সহযোগী অধ্যাপক। ঢাকা বোর্ডের অধীন রাজধানীর শিক্ষা ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠানসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে কেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছেন। এটিও প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি। চলমান এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হলে তাকে সাংবাদিকরা জানালেও তিনি কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে প্রতিদিনই কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছেন। প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সঙ্গে তার জড়িত থাকার অভিযোগ সংবাদকর্মীদের কাছে তুলেছেন তারই সহকর্মীরা। বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে তপন কুমার সরকারকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক এ টি এম মইনুল হোসেন ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রেষণে কর্মরত। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রথমে মাউশি অধিদপ্তরের উপপরিচালক (কলেজ-১) পদে কর্মরত ছিলেন। ওই পদে থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে জাতীয়করণ পরিদর্শনে ব্যাপক ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছিল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই সহযোগী অধ্যাপক সম্প্রতি পদোন্নতি পেয়ে অধ্যাপক হয়েছেন।

বাংলা বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক মাসুদা বেগম ঢাকা বোর্ডে ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (সনদ) পদে কর্মরত আছেন। তার বিরুদ্ধে এ পদে থেকে টেম্পারিং করে নিজের সন্তানের পরীক্ষার ফল বদলে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। মাসুদা বেগমের বিরুদ্ধে বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ পদ ব্যবহার করে রাজধানীর আনন্দময়ী বালিকা বিদ্যালয়ের গভর্নিংবডির সভাপতির পদটি বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। নিজ বাসার হাউস টিউটরকে আনন্দময়ী স্কুলে চাকরি, ওই বিদ্যালয় থেকে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার জন্য এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে স্কুলের তহবিলের টাকা রাখাসহ ওই স্কুলের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি। তবে, বি সি এস শিক্ষা সমিতির নেতা হওয়ায় তদন্ত কর্মকর্তাকে প্রভাবিত করিয়ে তদন্ত রিপোর্ট  সফট করা হয়। এসএসসি পরীক্ষা চলাকালে স্মার্টফোন নিয়ে আনন্দময়ীর শিক্ষক সাদ আহমদ ধরা পড়লেও বহিষ্কার বা অব্যাহতি পাননি।

শিক্ষামন্ত্রীর সাবেক সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈ মনি ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে বোর্ডের উপ-কলেজ পরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

উপ-পরিচালক (হিসাব ও নিরীক্ষা) মো. ফজলে এলাহী ২০১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান পদে আছেন। বিভিন্ন পদে তিনি বোর্ডে একাদিক্রমে আছেন প্রায় ১৫ বছর ধরে। অর্থনীতি বিষয়ের এই সহযোগী অধ্যাপকের বিরুদ্ধেও আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

বোর্ডের সবচেয়ে নবীন কর্মকর্তা হলেন উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তারেক বিন আজির। তিনিও তিন বছর বোর্ডে পার করতে যাচ্ছেন।

বোর্ডের স্থায়ী কর্মকর্তারা জানান, উল্লিখিত সব কর্মকর্তাই বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের।সেনা শাসক জিয়াউর রহমান সস্তা জনপ্রিয়তার আশায় সরকারি কলেজ শিক্ষকদের ক্যাডারভুক্ত করে কর্মকর্তার তকমা লাগিয়ে দেন। যেটা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। শিক্ষা ক্যাডার সদস্যদের মূল কাজ সরকারি কলেজে অধ্যাপনা হলেও তারা কিছুতেই সে কাজে যেতে ইচ্ছুক নন। সবাই নিজেদের কর্মকর্তা ভাবতে পছন্দ করেন। ঘুরেফিরে শিক্ষা খাতের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ আঁকড়ে থাকছেন। গত বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, তিন বছরের বেশি কোনো শিক্ষক প্রশাসনিক পদে থাকতে পারবেন না। অথচ মন্ত্রণালয়ই এসব কর্মকর্তাকে বদলি করছে না।

জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0043590068817139