প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকে নানা ভুলভ্রান্তি ও অসংগতি নিয়ে যখন তোলপাড় চলছে—সাড়ে ১০ লাখ শিক্ষার্থীকে এখনো অপেক্ষা করতে হচ্ছে বইয়ের জন্য। পাঠ্যপুস্তক না পাওয়ায় চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীর অনেক স্কুলের শিক্ষার্থীরা বই উৎসব করতে পারেনি; জানুয়ারি মাসের এক-তৃতীয়াংশ পার হয়ে গেছে, এখনো নিশ্চিত নয় এসব শিশুর হাতে বই কবে পৌঁছবে।
সংশ্লিষ্ট অনেকে এ পরিস্থিতির জন্য ভারতের মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান ‘শেশা সাই’ জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ও দাতা সংস্থা সবাইকেই দায়ী করছেন।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘শেশা সাই’ যথাসময়েই কাজ শেষ করেছে। বই চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাসও হচ্ছে। তবে আমাদের এলসি খুলতে এবং এ ধরনের আনুষ্ঠানিকতায় কিছুটা সময় নষ্ট হয়েছে। ভারতীয় প্রতিষ্ঠান সময়ের মধ্যে বইয়ের চালান পাঠিয়ে থাকলে বন্দর থেকে খালাস হতে এত সময় কি লাগার কথা? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের কর্মকর্তারা সময়মতো এলসি খুললেন না কেন? ১ জানুয়ারির বই বিতরণ অনুষ্ঠানটি জাতীয় উৎসবে রূপ নিয়েছে—কোন অধিকারে ১০ লক্ষাধিক শিশুকে এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত করা হলো? সারা দেশে যখন পাঠদান শুরু করা হয়েছে, বঞ্চিত শিশুরা বইয়ের জন্য পথ চেয়ে আছে। যাদেরই গাফিলতিতে শিশুদের এই ক্ষতিতে পড়তে হলো, তাদের সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।
স্থানীয় কাগজ ও মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্বব্যাংকের মাত্র ৯ শতাংশ টাকা নেওয়ার কারণে প্রতিবছরই টেন্ডারের আগে নানা ঝামেলা পোহাতে হয়। তারা নানা শর্ত জুড়ে দেয়। ফলে প্রতিবছরই কার্যাদেশ দিতে দেরি হয়ে যায়। ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, বিশ্বব্যাংকের সাহায্যপুষ্ট প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি পিডিইপি-৪ থেকে কিছু শর্ত বাদ দিলে আর আন্তর্জাতিক টেন্ডারে যাওয়ার দরকার পড়বে না; এ ধরনের উটকো ঝামেলাও ঘাড়ে চাপবে না।
আমাদের কাগজ ও মুদ্রণশিল্প অবশ্যই এখন অনেক বেশি উন্নত ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। আন্তরিকতা ও সততার সঙ্গে কাজ করলে পাঠ্যপুস্তকের গুণগত মান খারাপ হওয়ার কথা নয়। কিন্তু দায়সারা গোছের কাজ যে হবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? এমন অনাস্থার জায়গা থেকেই দাতারা প্রকল্পে কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছিল। আমাদের মুদ্রণশিল্পকে সেই আস্থা অর্জন করতে হবে। সক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সততার যোগ হলেই আমাদের পরনির্ভর করার কোনো যুক্তি কেউ দাঁড় করাতে পারবে না।
বর্তমান সরকারের যেসব সাফল্য রয়েছে, শিক্ষা খাতের উন্নয়ন তার অন্যতম। বিনা মূল্যের বই, উপবৃত্তিসহ কিছু উদ্যোগ প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার কমিয়েছে। তথ্যগত ভুল ও মুদ্রণগত বিপত্তি বই উৎসবের আনন্দ এবার অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে। এই অব্যবস্থাপনার কারণগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। দায়ী ব্যক্তিদের ছাড় দেওয়া যাবে না। যে শিশুরা একদিন সমাজ ও রাষ্ট্রের ভার নেবে—তাদের শিক্ষার অধিকারের সঙ্গে কোনো ধরনের আপস চলে না।
সুত্র: কালের কণ্ঠ সম্পাদকীয়