মাদারীপুর সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম সাইফুল আলমকে দুর্নীতির অভিযোগে বদলি করা হয়েছে পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলায়। গতকাল রবিবার মাদারীপুর সদর উপজেলা থেকে তার বিমুক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু তা না করে তিনি নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের কাছে ঢাকায় ছুটে আসেন। বদলি বাতিলসহ মাদারীপুরে থাকার জন্য মন্ত্রীর কাছে শুরু করেন তদ্বির। দুর্নীতিবাজ এই শিক্ষা কর্মকর্তার ‘আবদারে’ বিগলিত হয়ে মন্ত্রীও মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. মাহাবুবুর রহমানের কাছে ফোন করে বদলি বাতিল করার দাবি জানান।
জানতে চাইলে শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম সাইফুল আলম গতকাল বলেন, বদলি ঠেকানোর জন্য নৌ-পরিবহনমন্ত্রীর কাছে আমি যাইনি। মাদারীপুরের কয়েকজন শিক্ষক গিয়েছিলেন। বদলি কি রদ করা হয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, না রে ভাই। বদলি স্থগিত না হওয়ায় সোমবার রিলিজ অর্ডার নিয়ে নতুন জায়গায় যোগ দেব। ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে কুড়িগ্রামের জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা খন্দকার আলাউদ্দীন আল আজাদকেও গত বৃহস্পতিবার বরগুনা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা পদে বদলি করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। তিনিও গতকাল পর্যন্ত নতুন জায়গায় যোগ না দিয়ে স্থানীয় এক সংসদ সদস্যের মাধ্যমে মাউশিতে তদ্বির শুরু করেন। মূলত তার আবদারে রংপুর অঞ্চলের ওই সংসদ সদস্য গতকাল মাউশি মহাপরিচালকের সঙ্গে দেখা করেন। মাউশি মহাপরিচালককে উদ্দেশ করে ওই সংসদ সদস্য বলেন, কুড়িগ্রামের জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ভালো লোক। তাকে বদলি করা যাবে না।
সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে বলা হয়েছে শিক্ষা প্রশাসনের মাঠপর্যায়ে কর্মরত অনিয়ম-দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন ৮৬ কর্মকর্তা। তাদের বদলি করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এদের বদলির জন্য তালিকাটি মাউশিতে পাঠিয়ে দেয়। মাউশি ওই তালিকা ধরে গত বৃহস্পতিবার উল্লিখিত দুজনসহ মোট ১৩ জনকে প্রথম দফায় বদলি করে।
বদলি হওয়া কর্মকর্তাদের উদ্দেশে মাউশি থেকে জারি করা আদেশে বলা হয়, গত রবিবারের মধ্যে নতুন জায়গায় যোগদান করতে। কিন্তু এরা গতকাল পর্যন্ত যোগ না দিয়ে বদলির আদেশ বাতিল করানোর জন্য এমপি-মন্ত্রীদের দিয়ে মাউশিতে তদ্বির শুরু করেন।
দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বদলি করার পর আদেশগুলো স্থগিত করাতে এমপি-মন্ত্রীদের তদ্বিরের চাপে বিপাকে পড়েছে মাউশি। এ বিষয়ে মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. মাহাবুবুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন শুরু হয়েছে। যতই চাপ আসুক না কেন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা রেহাই পাবেন না। তিনি বলেন, এমপিওভুক্তির কার্যক্রমে দুর্নীতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রথম দফায় ১৩ জনকে বদলি করা হয়েছে। বদলি হওয়া কর্মকর্তাদের নতুন জায়গায় যেতেই হবে। পর্যায়ক্রমে আরো বদলি হবে। এরপর তাদের বিরুদ্ধে শোকজ ও বিভাগীয় মামলা করা হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ঘুষ-দুর্নীতি ও হয়রানি বন্ধ করতে ২০১৫ সালে এমপিওভুক্তি বিকেন্দ্রীকরণ ও অনলাইনে প্রক্রিয়া শুরু করে সরকার। কিন্তু ঘুষের হার ও স্তর বেড়ে যাওয়ায় এর সুফল পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থার দুটি প্রতিবেদনে এমপিওভুক্তিতে কীভাবে দুর্নীতি হয়, কারা জড়িত, কারা ঘুষ দেয়, কারা ঘুষ দিয়েও স্বীকার করে না এসব বিষয় উঠে আসে। ঘুষ-দুর্নীতিরোধে কিছু মন্তব্য ও সুপারিশ করা হয়েছে সংস্থাটির প্রতিবেদন দুটিতে।
এমন প্রতিবেদনের রেশ ধরেই কর্মকর্তাদের বদলি শুরু হয়। বদলিকৃত মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের মধ্যে চারজনকে পাঠানো হয়েছে খাগড়াছড়িসহ পার্বত্যাঞ্চলে। বাকিদের অপেক্ষাকৃত পিছিয়েপড়া ও দুর্গম অঞ্চলে পাঠানো হয়েছে। কাউকে বদলি করা হয়েছে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো উপপরিচালকের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ব্যবস্থা নেয়নি।
বদলির আদেশপ্রাপ্ত জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা হলেন- কুড়িগ্রামের খন্দকার আলাউদ্দীন আল আজাদকে পাঠানো হয়েছে বরগুনায়। ঝালকাঠির প্রাণ গোপাল দে’কে পদাবনতি ঘটিয়ে ভোলার তজুমদ্দিন সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে বদলি করা হয়েছে। ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শাহীন আকতারকে যেতে হবে মেহেরপুরে একই পদে। সাতক্ষীরার এস এম ছায়েদুর রহমানকে পাঠানো হয়েছে ফেনীতে। আর সাতক্ষীরা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার শূন্যপদে দেয়া হয়েছে সাতক্ষীরা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এস এম আবদুল্লাহ আল মামুনকে। বদলির আদেশ পাওয়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা হলেন- নেত্রকোনার কলমাকান্দার এস এম আবদুল ওয়াজেদ তালুকদারকে পাঠানো হয়েছে লক্ষীপুরের কমলনগরে। ময়মনসিংহের ত্রিশালের ঝিল্লুর রহমান আনমকে খাগড়াছড়ির গুইমারায় পাঠানো হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের কাজী আ. মোকিমকে শরীয়তপুরের ডামুড্যায় পাঠানো হয়েছে। মাদারীপুর সদরের এস এম সাইফুল আলমকে যেতে হবে পটুয়াখালীর দুমকিতে। কালকিনির আবদুল জলিলকে পাঠানো হয়েছে নওগাঁর রানীনগরে। রাজৈরের সনজিব কুমার বালাকে বান্দরবানের রুয়াংছড়িতে, শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জের মনিরুজ্জামান চৌধুরীকে রাঙ্গামাটির কাউখালীতে, ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জের মো. আরিফুল্লাহকে পাঠানো হয়েছে কক্সবাজারের রামুতে। বরিশালের বানারীপাড়ার আলী আহাদকে বদলি করা হয়েছে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলায়।
জানতে চাইলে মাউশি পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক ড. সরকার আবদুল মান্নান বলেন, বদলি হওয়া কর্মকর্তাদের নতুন স্টেশনে যেতেই হবে। বদলির পর এক ধরনের চাপ আসবেই। সব চাপ মোকাবেলা করেই কাজ করতে হবে বলে তিনি জানান।
সৌজন্যে: ভোরের কাগজ