দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ও সাক্ষরতার চিত্র - Dainikshiksha

দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ও সাক্ষরতার চিত্র

মাছুম বিল্লাহ |

সরকার সাক্ষরতার হার ৭০ শতাংশের বেশি বললেও বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযানের এক গবেষণা জরিপে বলা হয়েছে, দেশে এখন ১১ বছরের বেশি বয়সীদের সাক্ষরতার হার ৫১.৩ শতাংশ। পঞ্চম শ্রেণি সম্পন্ন করার পরও ৩২ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী সাক্ষরতা অর্জন করতে পারছে না। সাক্ষরতা অগ্রগতির হার বছরে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। এ হারে চলতে থাকলে বাংলাদেশকে সাক্ষরতা দক্ষতার প্রাথমিক স্তরে পৌঁছাতে আরো ৪৪ বছর সময় লাগবে। আর অগ্রসর পর্যায়ে উন্নীত হতে লাগবে ৭৮ বছর। দেশের ২৭০টি গ্রাম বা মহল্লা থেকে তিন হাজার ৫১০টি থানায় জরিপকাজ পরিচালনা করা হয়।

এসব থানার ১১ বছর থেকে তার বেশি বয়সী ১১ হাজার ২৮০ জনের ওপর জরিপ পরিচালনা করা হয়। এদের মধ্যে ৫৩ দশমিক ৬ শতাংশ নারী পড়া, লেখা ও গাণিতিক দক্ষতা এবং এই দক্ষতাগুলোর প্রয়োগ কতটুকু হচ্ছে সেটা জানার চেষ্টা করা হয়েছে এই জরিপে। মৌখিক ও লিখিত উভয় পদ্ধতির সমন্বয়ে এই গবেষণা জরিপ করা হয়। সাক্ষরতার হার নিয়ে পাঁচ বছর ধরেই বিতর্ক চলছে। একেকবার একেক তথ্য দেওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বলেছিলেন, দেশে সাক্ষরতার হার ৭১ শতাংশ। ওই সময় সাক্ষরতা দিবস পালন অনুষ্ঠানেও একই তথ্য দেওয়া হয়। সাক্ষরতার সংজ্ঞায় পার্থক্য থাকার ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, ১০ বছর পর হয়তো বলতে পারে মন্ত্রী শিক্ষিত নয়। কারণ ইন্টারনেট জানে না। এ নিয়ে বাহাস করার কিছু নেই।

গণসাক্ষরতা অভিযানের ২০০২ সালের তথ্য অনুযায়ী দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ৪১.৪ শতাংশ। সেটা বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ৫১.৩ শতাংশ। তাদের মধ্যে ২৬ শতাংশ উচ্চতর স্তরের সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন এবং ২৫.৩ শতাংশ প্রারম্ভিক স্তরের সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। এ ছাড়া ৩৯ শতাংশ একেবারেই নিরক্ষর এবং ৯.৮ শতাংশ প্রাক-সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। তবে ইতিবাচক দিক হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়, তরুণ বয়সীদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ভালো। এর মধ্যে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের সাক্ষরতার হার প্রায় ৭৫ শতাংশ।

জরিপে অংশগ্রহণকারীদের এক পাশের ঘরে বিড়াল ও লাঙলের ছবি দিয়ে অন্য পাশের ঘরে এগুলোর নাম লিখতে বলা হয়েছিল। জেলেরা নদীতে মাছ ধরে এবং পতাকার রং সবুজ ও লাল—এ দুটি বাক্য লিখে দিয়ে শব্দ করে পড়তে বলা হয়েছে তাদের। এ ছাড়া ৭৯ থেকে ৩৪ এবং ৪২ থেকে ৪-এর বিয়োগফল জানতে চাওয়া হয়। এ ধরনের ২৪টি প্রশ্নসংবলিত একটি অভীক্ষাপত্রের মাধ্যমে দেশের জনগোষ্ঠীর সাক্ষরতা পরিমাপ করেছে গণসাক্ষরতা অভিযান। পঠন, লিখন, গাণিতিক দক্ষতা ও এই দক্ষতাগুলোর প্রয়োগের সমন্বয়ে তৈরি অভীক্ষায় মোট নম্বর ছিল ১০০। প্রচলিত ধারার সাক্ষর ও সাক্ষর নয় এই দুই ভাগের বাইরে এসে এ গবেষণায় চারটি স্তরে সাক্ষরতার পরিমাপ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে : অ-সাক্ষর, প্রাক-সাক্ষর, প্রারম্ভিক সাক্ষর ও উচ্চতার স্তরের সাক্ষর। ২৫ শতাংশের কম পেয়েছে তাদের অ-সাক্ষর, ২৫ থেকে ৪৯ শতাংশ নম্বরপ্রাপ্তদের প্রাক-সাক্ষর, ৫০ থেকে ৭৪ শতাংশ নম্বরপ্রাপ্তদের প্রারম্ভিক স্তরের সাক্ষর এবং ৭৫ শতাংশ বা তার বেশি নম্বরপ্রাপ্তদের উচ্চতার সাক্ষর পর্যায়ে রাখা হয়েছে।

গণসাক্ষরতার জরিপের ফলাফলে দেশের সার্বিক সাক্ষরতার হারও তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, উচ্চতর স্তরের সাক্ষর রয়েছে ২৬ শতাংশ, প্রারম্ভিক স্তরের সাক্ষর ২৫ দশমিক ৩, প্রাক-সাক্ষর ৯ দশমিক ৮ এবং অ-সাক্ষর রয়েছে৩৯ শতাংশ। প্রতিবেদনটিতে শিক্ষাস্তর অনুযায়ী সাক্ষরতা পরিমাপের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, পঞ্চম শ্রেণি সম্পন্নকারীদের ৬৭ দশমিক ৮ শতাংশ, অষ্টম শ্রেণি সম্পন্নকারীদের ৯১ দশমিক ৮, দশম শ্রেণি সম্পন্নকারীদের ৯৮ দশমিক ৪ এবং উচ্চ মাধ্যমিক ও এর ওপরের ধাপের মানুষের মধ্যে ৯৯ দশমিক ৭ শতাংশ লোক সাক্ষরতা অর্জন করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বিদ্যালয়ের শিক্ষাই সাক্ষরতা অর্জনের প্রধান উৎস। কিন্তু বিদ্যালয়ে শিক্ষার নিম্নমান আবার সাক্ষরতা অগ্রগতিকে ব্যাহত করছে। ২০০২ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তকারীদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই ছিল অ-সাক্ষর। ২০১৬ সালে এসেও এ অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।

শোনা যাচ্ছে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উন্নয়নে বড় প্রকল্প আসছে। এতে ব্যয় হবে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। এ ধরনের দুটি পৃথক প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় তৈরি করা গাইডলাইন অনুযায়ী এ প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাহিদাভিত্তিক অবকাঠামো উন্নয়ন (প্রথম পর্যায়)’। প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ হাজার ১২ কোটি ৮৪ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। চাহিদাভিত্তিক নতুন জাতীয়করণকৃত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় উন্নয়ন (প্রথম পর্যায়) শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে পাঁচ হাজার ৭৪০ কোটি ৫৯ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। প্রাথমিক শিক্ষার অবকাঠামোগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ এই দুটি প্রকল্পের পুরো অর্থ ব্যয় হবে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একনেকে প্রকল্প দুটি অনুমোদন পেলে ২০২২ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর তা বাস্তবায়ন করবে। এ ছাড়া বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিদ্যালয়গুলোর তালিকা ও কাজের অগ্রগতি তদারক করা হবে।

বিদ্যালয়ভিত্তিক শিক্ষার মান অবশ্যই উন্নত করতে হবে, যেন তা প্রাথমিক শিক্ষার প্রারম্ভিক স্তরে শিক্ষার্থীদের সাক্ষরতার প্রাথমিক ধারণা প্রদান করতে পারে এবং পঞ্চম শ্রেণি শেষে তারা টেকসই সাক্ষরতা ও গাণিতিক দক্ষতা অর্জন করতে পারে। প্রাথমিক শিক্ষাক্রম, শিক্ষা উপকরণ, শিক্ষণ পদ্ধতি, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষণ সূচি ব্যবস্থাপনা এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পারদর্শিতা মূল্যায়ন সম্পর্কিত যাবতীয় মান উন্নয়নমূলক পদক্ষেপের ক্ষেত্রে সাক্ষরতা এবং গাণিতিক দক্ষতার বিষয়গুলো অধিকতর গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে। সাক্ষরতা এবং গাণিতিক দক্ষতাকে শিক্ষণের মাধ্যম ও ভিত্তিমূলক দক্ষতা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে সব শিশুর জন্য এ ভিত্তি সুদৃঢ়ভাবে স্থাপন করে দিতে হবে।

এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। এরই মধ্যে আমরা নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। সরকারের লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া। এ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এসডিজি অর্জনের জন্য এর চতুর্থ লক্ষ্য ‘সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা’ নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাই জাতীয় উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে এবং এসডিজির উন্নয়ন লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষাকে সবার দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার বিকল্প নেই। আমরা আশা করি, প্রাথমিকে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাস্তবে শতভাগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি ঝরে পড়ার হার শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসার এবং সাক্ষরতা পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নেবে, যাতে আমাদের ৪৪ কিংবা ৭৮ বছর অপেক্ষা করতে না হয়।

লেখক : শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করেন এবং বর্তমানে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ শিক্ষক।

 

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036640167236328