চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় সারা দেশে জিপিএ ৫ পেয়েছে ৩৭ হাজার ৭২৬। এর মধ্যে ৮টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে জিপিএ ৫ পেয়েছে ৩৩ হাজার ২৪১ জন। মাদ্রাসা বোর্ডে জিপিএ ৫ পেয়েছে এক হাজার ৮১৫ জন শিক্ষার্থী। আর কারিগরিতে জিপিএ ৫ পেয়েছে ২ হাজার ৬৬৯ জন শিক্ষার্থী। অভিনন্দন সবাইকে। তবে এই পর্যায় শিক্ষাজীবনের একটি ধাপ; জীবনের ভিত্তিটা রচিত হবে এর পরের স্তরেই। অন্তত আমাদের দেশীয় পরিপ্রেক্ষিতে সেটাই বিবেচনা করা হয়। আমি সে প্রেক্ষাপট থেকেই ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থার কথাই বুঝাতে চাচ্ছি।
কঠিন এক প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে এই স্তরে স্থান করে নিতে হবে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে। সাধারণভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা আলোচনা করি যদি, তবে চিত্রটা মোটেও শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল মাত্র চারটি; বিশেষায়িত দুটি মিলে মোট ছয়টি। বর্তমানে সে সংখ্যা দেড়শ’র ঘর ছুঁই ছুঁই করছে। কিছুদিন আগে জাতীয় সংসদে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, বর্তমানে দেশে ১৩৪টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ৩৯টি সরকারি এবং ৯৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির (¯œাতক পর্যায়ে) জন্য ৬ লাখ ২৬ হাজার ৩৫৮টি আসন রয়েছে। ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ এবং ‘শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে আরো দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের লক্ষ্যে মন্ত্রিপরিষদে আইন অনুমোদিত হয়েছে।
বর্তমানে বিলটি রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলরের অনুমোদনের জন্য অর্থ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। এর আগে ৩ মে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দেশের প্রতিটি জেলায় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে একটি করে সাধারণ-বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। এ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে কুষ্টিয়া জেলায় ‘রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও পরিচালনার সাময়িক অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। এর কিছুদিন পরেই আরো একটি চমকপ্রদ খবর আসে। গত ২৯ জুন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ জানান, সবার জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে সাধারণ-বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। সংসদে সরকারি দলের সদস্য বেগম পিনু খানের এক লিখিত প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা বিবেচনায় আসন পর্যালোচনা করি এবার।
যে হারে শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়ছে সেই হারে বিশ্ববিদ্যালয় বাড়বে কি না, আজকের আলোচ্য প্রসঙ্গ সেটাই। বাকি শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দিতে হলে ৩ লাখেরও বেশি আসন বাড়াতে হবে, যা রাতারাতি সম্ভব নয়। এ প্রেক্ষাপটে বড় একটি সংখ্যায় শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের জন্য আসন সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ফলে বিদ্যমান আসনের জন্য জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদেরই ভর্তিযুদ্ধে অংশ নিতে হবে। সরকার ও শিক্ষাবিদরা উচ্চশিক্ষার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কলেজগুলোর বিশাল সংখ্যক আসনের কথা বলেন। বাস্তবে শিক্ষার্থীরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য। সেখানে ব্যর্থ হলে তবেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে পা বাড়ায়।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান ও পরিবেশ শিক্ষার্থীদের জন্য খুব একটা সুখকর নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অগ্নিমূল্যে বিদ্যা কিনবার সামর্থ্য নেই অনেক বাবা-মায়ের। সেই মেহনতি শ্রমজীবীর মুক্তিই জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জীবনের আদর্শ ছিল। এমন বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি জেলা পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে, উচ্চশিক্ষার দ্বার আরো প্রশস্ত করার। এ লক্ষ্যেই নিকট ভবিষ্যতে উপজেলা পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের এখন নানা কষ্ট করে রাজধানী বা বিভাগীয় শহরে যেতে হবে না।
বিশ্ববিদ্যালয় একটি সর্বজনীন এবং সর্বপ্রকার সংকীর্ণতামুক্ত সামাজিক শিক্ষামূলক সংগঠন। এ প্রসঙ্গে প্রয়াত হুমায়ূন আজাদকে উদ্ধৃত করছি, ‘ব্যাংক, বীমাসংস্থা, আমদানি-রপ্তানি কেন্দ্র ও অজ¯্র পার্থিবতামুখী প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, কিন্তু তার সঙ্গে মহত্ত্বের, পবিত্রতার সম্পর্ক কেউ খোঁজে না। উপাসনালয়ের সঙ্গে পবিত্রতার ধারণা জড়িত হয়ে আছে প্রথাগতভাবে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় তারও ঊর্ধ্বে, কেননা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বমানবের, মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও অজ¯্র ধর্মাবলম্বীর, বর্ণের, গোত্রের ও শ্রেণীর।’ উপজেলা পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা সম্ভব হলে উচ্চশিক্ষা কেবল সমাজের একটি অংশের জন্য আটকে থাকবে না। বরং সবাই সুযোগ পাবে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের। বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান, এটি বিশ্বজনীনও। আঞ্চলিকতা, জাতীয়তা, রাষ্ট্র, সীমানা, সব কিছুর ঊর্ধ্বে এ বিদ্যাপীঠের স্থান।
যে কোনো অঞ্চলের, যে কোনো দেশের, ভাষা, বর্ণ, জাতীয়তার শিক্ষার্থীই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবে। বিচিত্র বিষয়ের বিস্তর জ্ঞান অর্জনের অবারিত ও সীমাহীন সুযোগ কেবল বিশ্ববিদ্যালয়েই পাওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আরো বিজ্ঞ, উদার, সংস্কৃতিমনা। অজ্ঞতা, কুসংস্কার, সংকীর্ণ মানসিকতার ঊর্ধ্বে উঠে শিক্ষকরা জাতি গঠনে ব্রতী হন। তাদের চিন্তায় কেবল দেশ ও জাতির স্বার্থই প্রাধান্য পায়। কোনো নির্দিষ্ট বেড়াজালের আবরণ তাদের জ্ঞান অর্জন ও জ্ঞান পরিবেশনে বাধা তৈরি করতে পারে না। তিনি শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট বিষয়ে পড়ানোর পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সভা, সিম্পোজিয়াম, কর্মশালা, সেমিনারে অংশ নেবেন। নিজে গবেষণা করবেন, শিক্ষার্থীদের গবেষণায় উৎসাহিত করবেন। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে নিজের জ্ঞানকে সময়োপযোগী করবেন, বিলিয়ে দেবেন শিক্ষার্থীদের মাঝে। উদ্যমী ও প্রত্যয়ী প্রজন্ম গড়ে তুলবেন শিক্ষকরা। নতুন জ্ঞান, উদ্ভাবনী ভাবনা, বিশ্বজনীনতা, আইনের অনুশাসন, দক্ষ জনশক্তি, সামাজিক ন্যায়বিচার, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লে, এসব মূল্যবোধের বিস্তৃতিও বাড়বে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ক্ষেত্রে কতকগুলো বিষয়ে দৃষ্টিপাত জরুরি।
বিশ্বজনীনতার যুগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তন ও উন্নয়ন হচ্ছে। প্রতি বছর সফটওয়্যার নতুন ভার্সন পাচ্ছে, নতুন নতুন প্যাকেজ ও টুলস বের হচ্ছে। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু থেকেই এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। এসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সর্বশেষ আর্টিকেল, বই, রিপোর্ট সম্পর্কে অবগত থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান উৎপাদনের বৈশি^ক প্রতিযোগিতায় আমাদের জয় অবশ্যম্ভাবী।
আমাদের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েই গবেষণারত শিক্ষার্থীদের আবাসন ব্যবস্থা নেই; হলে থাকার নিয়ম নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হল থাকার পরও পিএইচডি লেভেলে শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থা না থাকাটা সুষ্ঠু গবেষণার জন্য অন্তরায়। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন আর মৌলিক কোনো গবেষণা হয় না বললেই চলে। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যদিও এসব ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তীক্ষè নজরদারি রয়েছে, এটা আশার দিক। বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া উচিত অগাধ জ্ঞানের আধার। দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনায় গড়ে উঠবে শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধসহ জাতীয় ও ঐতিহ্যগত নানা স্থাপনা। মুক্ত জ্ঞান ও সংস্কৃতিচর্চাকেন্দ্র শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিশ্বজনীন করে গড়ে তুলবে। থাকবে উন্মুক্ত পাঠাগার, আধুনিক সাইবার ক্যাফে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর গড়ে উঠবে ক্যাফেটেরিয়া, স্টেশনারি, ফটোকপি, প্রিন্টিং-টাইপিং, খাবারের দোকানসহ বিভিন্ন ধরনের শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় দোকানপাট। এসব বিষয়ে পরিকল্পনা থাকতে হবে। আদর্শ শিক্ষক-গবেষক জাতির মূল্যবান সম্পদ, অনুসরণীয় আদর্শ।
শিক্ষক-গবেষকদের জ্ঞান, দক্ষতা ও প্রজ্ঞা ভবিষ্যৎ জাতি গঠনের অন্যতম নিয়ামক শক্তি। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য ও গবেষণাপ্রবণ শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার ধারা ফল্গুগতিতে বিস্তৃত হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একক উদ্যোগ, বিচক্ষণ নির্দেশনা আর দূরদৃষ্টি থেকেই শিক্ষা ক্ষেত্রে ইতিবাচক উদ্যোগ গৃহীত হচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে, নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই আমরা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করতে পারব। মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরিত হবে আমাদের দেশ, ২০২১ সালের মধ্যেই।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দায়িত্ব হচ্ছে, দায়িত্বশীল আদর্শ ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরি করা। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটবে দেশজুড়ে। উচ্চশিক্ষিত ও দক্ষ জনবলের চাহিদা পূরণ হবে। দক্ষ জনবল দেশের বাইরে গিয়ে আমাদের রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়াবে। এগিয়ে যাবে দেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের চিন্তা কেবল ইতিবাচকই নয়, বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ও দেশীয় প্রেক্ষাপটে খুবই জরুরি। সেই সঙ্গে জাতির স্বপ্নদ্রষ্টার আসনে তিনি নিজেই আসীন হন তার কাযক্রমের জন্য। প্রগতির ধারায় জাতিকে পরিচালিত করতে সার্টিফিকেটের পরিবর্তে জ্ঞানের প্রবাহটিও আবশ্যক হবে। আশা করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুবিবেচনায় তাও রয়েছে। তার নেতৃত্বে আরো দীর্ঘদিন বাংলাদেশ সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হোক- এটাই আজকের প্রত্যাশা।
ড. শরীফ এনামুল কবির : সদস্য, পাবলিক সার্ভিস কমিশন
সাবেক ভিসি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।