লেখালেখির কারণেই দেশের বিভিন্ন জেলার নন-এমপিও শিক্ষকদের সাথে পরিচয় হয়েছে। কেমন আছেন তাঁরা? দেশের মানুষের ভাববার সময় নেই। তাঁরা কেমন আছেন জানতে চাইলে একটি উত্তরই পাই। তা হলো, আমাদের আর ভালো থাকা! মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কেটে যাচ্ছে। তবুও ভালো আছি কথাটুকু বলার মনোবল তাঁরা পাচ্ছেন না। আমার চাকরিতে যোগদানের পাঁচ মাস পর এমপিওভুক্ত হয়েছিলাম। বেতনবিহীন চাকরি কতটা দুর্বিসহ হতে পারে তা ঐ পাঁচ মাসে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। শুধু তাই নয়। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অবহেলার পাত্রও হয়ে থাকতে হয়। বেতন ছাড়া চাকরি এটা কি কোন কর্মজীবন হতে পারে?! নন-এমপিও শিক্ষকদের জীবনের কিছু বাস্তব চিত্র প্রিয় পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি।
বছর চারেক আগেই পড়াশোনা শেষ হয়েছে। চাকরির বাজারে বিজ্ঞাপনের অভাব ছিলনা, অভাব ছিল মামা-খালুর। তাই অভিশপ্ত বেকার জীবন। পাড়ার মুরুব্বি সামনে দেখলে পেছন ঘুরে অন্য পথে হাঁটা। বাবা ঘুমিয়ে যাবার পর বাড়ি ফেরা। রাস্তার মোড়ে চায়ের দোকানেও আর বসা হয় না। বন্ধুরা ফোন করলে রিসিভ না করা। প্রতিদিন দুঃস্বপ্নের জাল বোনা। এসব মিলেই একজন বেকারের দৈনন্দিন জীবন। অবশেষে অনেক ত্যাগ, কষ্টের ফসল শিক্ষকতার চাকরি। বসে থাকতে থাকতে জীবন যখন অতিষ্ট ঠিক তখন মিলল সৃষ্ট পদে শিক্ষকতার চাকরি। তখন তারা বোঝেননি এমপিও আর নন-এমপিওর কলাকৌশল।
এক সময় সমাজের সবচে’ সম্মানজনক পেশা ছিল শিক্ষকতা। যে সম্মান এখন উইপোকায় খেয়ে ফেলেছে। যা নন এমপিও শিক্ষকরা বুঝতে পারেননি। সারা দেশে আজ প্রায় দুই লাখের বেশি নন-এমপিও শিক্ষক বিদ্যমান। ভেবে দেখেছেন কখনও, তাদের জীবন কীভাবে চলছে? বেতনবিহীন চাকরি রক্তবিহীন শরীরের মতো। আর কতদিন এই যন্ত্রণা ? আর কতদিন তাদের কৃত্রিম হাসি হাসতে হবে? তাদের কাছ থেকে লাখ লাখ শিক্ষার্থী শিক্ষা নিচ্ছে প্রতিবছর।
একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষকের দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে যে অবদান, নন-এমপিও শিক্ষকদের সে অবদানের কি বিন্দুমাত্র কমতি আছে? শরীরের শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যারা শিক্ষাদান করে যাচ্ছেন তারাইতো প্রকৃত দেশপ্রেমিক। বইয়ে পড়েছি যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। জাতিকে উন্নতির চূড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য সারা দেশের নন-এমপিও শিক্ষকরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। সরকারের ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নিচ্ছেন। মাল্টিমিডিয়া পাঠদানের কন্টেন্ট তৈরির জন্য ধার-দেনা করে কম্পিউটার কিনছেন। তাঁরাও তো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ। তাঁদের কি হেয়প্রতিপন্ন করা হচ্ছে না? তাঁদের পেটের ক্ষুধা থাকলেও নির্লজ্জ হতে পারছেন না। কারণ তাঁরাও তো শিক্ষক। মানুষ গড়ার কারিগর! বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করছেন বলে তাঁদেরকে নন-সেন্স ভাববেন না। বরং তাঁদের সেন্স অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি কারণ তাঁরা অনেক ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়ে জাতির উন্নয়নের জন্য স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করে আসছেন। কিন্তু এভাবে কতদিন চলতে পারে একজন শিক্ষকের জীবন? সরকারি চাকরিজীবীরা কি পারবেন বেতনবিহীন একটি দিন পার করতে?!
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমার বিশ্বাস দেশের নন-এমপিও শিক্ষকদের কষ্টের জীবন দেখলে চোখের পানি ধরে রাখতে পারবেন না। আপনার একান্ত চেষ্টাতে বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চলেছে। আপনাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়ার দাবি উঠেছে। আমরা শিক্ষক সমাজ গর্বিত। আমরা মনেপ্রাণে চাই শান্তিতে নোবেল পুরস্কার আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীই পান। নন-এমপিও শিক্ষকদের মনের অশান্তিটুকু দয়া করে একটু ভেবে দেখুন। আপনার মহানুভবতায় অষ্টম পে-স্কেল কার্যকর হয়েছে। আপনার সামান্য দয়ায় আজ নন-এমপিও শিক্ষকরা হৃদয়বিদারক কষ্টের আহাজারি থেকে মুক্তি পেতে পারেন।
মোস্তাফিজুর রহমান শামীম: প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, ভেড়ামারা কলেজ , কুষ্টিয়া।
[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন]