প্রাচীন জনপদ নয় শুধু, গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সাক্ষী নরসিংদী। রাজধানীর লাগোয়া জনপদ নরসিংদীতে সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল কয়েক হাজার বছর আগে। নরসিংদীতে আবিষ্কৃত ওয়ারী বটেশ্বরের প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন প্রমাণ করে হাজার হাজার বছর আগেও এই জনপদে নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। মধ্যযুগেও নরসিংদী মসলিন উৎপাদনের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হতো। এখনো এ জেলার গুরুত্ব দেশের বস্ত্রশিল্পের ‘রাজধানী’ হিসেবে। নরসিংদীতে জন্মগ্রহণ করেছেন দেশসেরা কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিক ও গুণীজনরা। মুক্তিযুদ্ধে দেশের যেসব এলাকা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে তার সামনের কাতারে রয়েছে এ জেলার নাম।
কিন্তু ঐতিহ্যমণ্ডিত এ জেলার ঐতিহ্য ও সুনামের মুখে চুনকালি লাগাচ্ছে টেঁটাযুদ্ধের জনপদ হিসেবে নরসিংদীর পরিচিত। জেলার চরাঞ্চলে টেঁটাযুদ্ধের নামে বছরের পর বছর ধরে যে নৃশংসতার চর্চা চলছে তা আইয়ামে জাহেলিয়াকেও হার মানায়। চরাঞ্চলের মানুষের মধ্যে পান থেকে চুন খসলেই বেধে যায় সংঘর্ষ। এলাকায় এলাকায় পূর্ব ঘোষণা দিয়ে টেঁটা-বল্লম-দা-ঢাল নিয়ে মরণযুদ্ধে একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর এসব সংঘর্ষে যোগ দিতে আশপাশের ২০-২৫ গ্রাম থেকেও স্ব-স্ব লোকজন এসে হাজির হয়।
কখনো কখনো পরপর দুই-তিন দিন ধরে চলে সংঘর্ষ। প্রতিপক্ষের হামলা-মামলায় সর্বস্ব হারায় শত শত পরিবার। তবু তারা সর্বনাশা টেঁটাযুদ্ধ থেকে সরে দাঁড়ায় না। যারা নিহত হন, তাদের রক্তের প্রতিশোধ নিতে পাল্টা খুন আর মামলা চলে। সংঘর্ষ অনেকটা যেন স্থানীয়দের নেশায় পরিণত হয়েছে। কোনো কোনো চরের ৯৫ ভাগ পরিবারই টেঁটাযুদ্ধে জড়িত। এই মরণখেলায় শুধু পুরুষই নয়: শিশু ও নারীরাও থাকেন সম্মুখ সারিতে।
টেঁটাযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় কিশোর অপরাধের ধরন পাল্টাচ্ছে। বাড়ছে খুন-ধর্ষণে জড়ানোর প্রবণতা। সমাজে অপরাধ সংস্কৃতির নানা মাত্রা ভয়ংকর হয়ে উঠছে। আনসার, পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, সেনাবাহিনী দিয়েও এই মরণ খেলা বন্ধ করা যাচ্ছে না। এই মরণ খেলায় যারা জড়িত অধিকাংশ অর্ধ শিক্ষিত এসএসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। বেকার তরুণরা তাদের মেধা, শ্রম সমাজ বিনির্মাণের পরিবর্তে অপকর্মে ব্যবহার করছে। তরুণ প্রজন্ম আমাদের অগ্রসর শক্তি।
প্রাচীন সভ্যতার জনপদ নরিসংদীর একাংশের এহেন চিত্র লজ্জা ও অপমানের। এ লজ্জা ঝেড়ে ফেলতে একদিকে যেমন জেলার সব বিবেকবান মানুষকে সক্রিয় হতে হবে তেমন সরকারকেও শক্ত হাতে চরাঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এগিয়ে আসবে হবে। যোগ আরোগ্য থেকে প্রতিরোধকে উত্তম নীতি গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষাই আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের সহায়ক শক্তি। নরসিংদীতে একটি আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হলে এসব ভাগ্যহত তরুণরা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে পরিবার সমাজ, দেশ গঠনে জীবন উৎসর্গ করতে পারত। এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
জান্নাতুল ফেরদৌস: তথ্য গবেষণা সম্পাদক, নরসিংদী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন পরিষদ
সূত্র: দৈনিক সংবাদ