নারীর সমঅধিকারের আন্দোলন প্রসঙ্গ - দৈনিকশিক্ষা

নারীর সমঅধিকারের আন্দোলন প্রসঙ্গ

মো. রহমত উল্লাহ্ |

Rahamat Ullahসমান অধিকারের অর্থ হচ্ছে যোগ্যতা অনুযায়ী অধিকার বা যোগ্যাধিকার। কোনো কিছু করার বা পাওয়ার যোগ্যতা সমান হলে অধিকার সমান হওয়া আবশ্যক। যোগ্যতার অসমতার যুক্তিযুক্ত কারণেই সব ক্ষেত্রে সবার অধিকার সমান নয়। এই কঠিন সত্যটি শুধু নারী-পুরুষের মধ্যে নয়; পুরুষ-পুরুষ, নারী-নারী তথা সবার জন্যই প্রযোজ্য। তাই কোনো নির্দিষ্ট যোগ্যতা সমান হওয়া সত্ত্বেও সেই যোগ্যতার প্রাপ্যাধিকার সমান না হলে আন্দোলন অপরিহার্য।

পারিবারিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ইত্যাদি অধিকারের ক্ষেত্রভিত্তিক আলোচনা করলেই সুস্পষ্ট হবে- আমাদের দেশে নারীরা কোন অধিকার যোগ্যতা অনুযায়ী ভোগ করছেন, কোন অধিকার ভোগের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বঞ্চিত হচ্ছেন, কোন অধিকার যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও দাবি করছেন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভোগ করছেন।

পারিবারিক ক্ষেত্রে সন্তান ধারণ, স্তন্যদান, লালন-পালন ইত্যাদি অপূরণীয় ত্যাগের জন্য মায়ের থাকা উচিত সন্তানের ওপর একচ্ছত্র অধিকার। অথচ ছেলের বউ, মেয়ের জামাই এসে ভাগ বসাচ্ছেন সেই অধিকারে। পিতা-মাতার সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট নারীদের অনীহা (নিজের পৈতৃক সম্পত্তির সুবিধা স্বামী-সন্তানকে ভোগ করতে না দিয়ে কেবল স্বামীর ও স্বামীর পৈতৃক সম্পত্তি ভোগের মানসিকতা) এবং সৎসাহসের অভাবই (বাপ/ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকার ও স্বামী/সন্তান কর্তৃক সম্পত্তি হাতছাড়া হওয়ার ভয়) প্রধান কারণ। নারীর এরূপ মানসিকতা ও ভূমিকা সমান অধিকারের পরিপন্থী হলেও কিছু অতি লোভী পুরুষ এর জন্য দায়ী। শুধু নারী কেন, দাবি না করলে পৈতৃক সম্পত্তির অধিকার পুরুষও পায় না সঠিকভাবে। সমাজে চলমান রীতি-নীতি থেকে সৃষ্ট কিছু অযৌক্তিক ধ্যান-ধারণার কারণে, ধনী দরিদ্র শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব পরিবারেই বয়োজ্যেষ্ঠ নারী-পুরুষদের দ্বারা অধিক অবমূল্যায়িত কন্যা সন্তানেরা। বিশেষ করে অশিক্ষিত/আধা শিক্ষিত পরিবারে মেয়েদের বিয়েসহ বিভিন্ন ব্যক্তিগত বিষয়ে তাদের মতামত উপেক্ষা করা হচ্ছে প্রায়শই। কোনো কারণে ক্ষিপ্ত হলে সাধারণত নারীরা মানসিকভাবে এবং পুরুষরা শারীরিকভাবে পরস্পরকে আঘাত করে থাকে। শারীরিক শক্তি (যোগ্যতা) কম-বেশি না হলে কেমন হতো এই চিত্র? আসলে অপরকে আঘাত করার অধিকার কারোরই নেই।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈধ কর্ম সম্পাদন, পারিশ্রমিক দাবি, পেনশন লাভ ইত্যাদি অধিকার সরকারি পর্যায়ে নারী-পুরুষের একই রকম। বেসরকারি ও পারিবারিক ক্ষেত্রে বৈষম্য বিদ্যমান। অনেক যোগ্য নারীকেই বাইরে চাকরি করা থেকে বিরত রাখা হয় সাংসারিক কর্মের প্রয়োজনে। অথচ সংসার কর্মের জন্য যথাযথ মূল্যায়ন করা হয় না তাকে। এ ক্ষেত্রে নারীর প্রতি নারীর (মা, বোন, শাশুড়ি, জা, ননদ) সহায়ক ভূমিকার অভাব লক্ষণীয়। গৃহকর্মীদের আর্থিক ও অনার্থিক সুবিধা একেবারেই নগণ্য; যেটি নির্ধারণ করে থাকেন মহিলারাই। গার্মেন্টসের মতো প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের পারিশ্রমিক অত্যন্ত কম। এসব ক্ষেত্রে যথাযথ পারিশ্রমিক চাওয়া-পাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু বেকারের সংখ্যাধিক্যের কারণে এটি অর্জিত হচ্ছে না। এক্ষেত্রে শুধু আন্দোলন নয়, কর্মক্ষেত্র বৃদ্ধি জরুরি। তাই উদ্যোক্তা হয়ে এগিয়ে আসতে হবে শিক্ষিত নারীদের।

সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সব নারী তুলনামূলক কম সুবিধা ভোগ করে; এই কথা সর্বাংশে সত্য নয়। জীবনধারণ, স্বাধীন চলাফেরা, পরিবার গঠন, চুক্তি সম্পাদন, শিক্ষালাভ, মাতৃভাষা, স্বাধীন চিন্তা, ধর্ম পালন, সম্পত্তি অর্জন-ভোগ-দান-বিক্রি, সভা-সমিতি করা ইত্যাদি সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার বর্তমানে শিক্ষিত নারীদের নাগালের খুব বেশি বাইরে নয়। তা ছাড়া রাজনীতি ও এনজিও সম্পৃক্ত শিক্ষিত/আধা শিক্ষিত নারীরা এসব অধিকার এখন নিয়মিতই ভোগ করছেন। নিরাপদে বেঁচে থাকা ও স্বাধীন চলাফেরার জন্য যতটুকু নিরাপত্তার প্রয়োজন তা আমাদের রাষ্ট্র দিতে ব্যর্থ।

এটি শুধু নারীদের ক্ষেত্রে নয়, পুরুষদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য কম/বেশি। একান্তভাবে স্বধর্ম পালনের অধিকার সাধারণত নারীদের ছিল, আছে এখনো। যদিও নারীরাই তা মানছেন না পুরোপুরি! স্বামীকে তালাক দেয়ার অধিকার, গণ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অধিকার, খোলামেলা পোশাক পরে প্রকাশ্যে চলাফেরা করার অধিকার ইত্যাদি ইসলাম ধর্মে না থাকলেও মুসলমান পরিবারের অনেক নারীই তা ভোগ করছেন। আবার এই আধুনিক (?) নারীরাই ইসলাম ধর্মে প্রদত্ত অধিকার বলে বিয়ের সময় ধার্য ও আদায় করছেন দেনমোহরানার অর্থ (বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বামীর সঙ্গতির অতিরিক্ত) এবং তাদের কেউ কেউ স্বামীর সংসারে এসে বলছেন- ‘জানো না, স্ত্রীর ভরণপোষণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব স্বামীর। আমার যা যা লাগে সব তোমার দিতে হবে। ছেলেমেয়ে মানুষ করার দায়িত্ব তোমার। তোমাকেই দিতে হবে কাজের মেয়ের টাকা। তোমার বেতনে না হলে, তুমি চুরি করবে না ডাকাতি করবে সেটি তোমার ব্যাপার! আমার উপার্জিত অর্থ দাবি করার কোনো অধিকার তোমার নেই। আমার টাকা দিয়ে আমার যা ইচ্ছা তা-ই করব।’ আবার তালাকের প্রশ্ন এলে দাবিও আদায় করছেন খোরপোশের অর্থ (উপার্জনক্ষম হলেও)। যেসব আধুনিক (?) নারী ইসলাম ধর্মের বিধান অনুসারে জীবনযাপন করে না, তাদের জন্য এসব অধিকার অগ্রাধিকার নয় কি? শিক্ষিত চাকুরে ছেলেরা তুলনামূলক কম শিক্ষিত বেকার মেয়েদের সংসার সঙ্গী করতে দ্বিধা করে না। কিন্তু শিক্ষিত চাকুরে (কোটায় প্রাপ্ত) মেয়েরা মেনে নেন না এমনটি। আবার কর্তৃত্বও মানতে চান না; করতে চান। করেও কেউ কেউ। অথচ তুলনামূলক কম যোগ্য ছেলে বিয়ে করেই মেয়েরা অর্জন করতে পারেন পারিবারিক কর্তৃত্ব করার অধিকার। ভেঙে দিতে পারেন পুরুষ শাসিত সমাজ।

শিক্ষা লাভের অধিকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার। এই অধিকার অর্জনে সফল হলে অন্যান্য অধিকারের জন্য আন্দোলন তেমন প্রয়োজন পড়ে না। একমাত্র যোগ্যতাই দিতে পারে পূর্ণ অধিকার ও সম্মান। বর্তমানে মেয়েদের শিক্ষা উপ-বৃত্তিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ও উৎসাহ দেয়া হচ্ছে শিক্ষালাভের জন্য। যেটি ছেলেদেরও দেয়া উচিত সমানভাবে। অন্যথায় সমাজে তৈরি হবে বিপরীত বৈষম্য। ভোটাধিকার প্রয়োগ করা, নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া, বিচার দাবি করা, সরকারের সমালোচনা করা, যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারি কর্ম পাওয়া, এসব রাজনৈতিক অধিকার বর্তমানে আমাদের শিক্ষিত নারীরা যোগ্যতার তুলনায় বেশিও ভোগ করছেন ক্ষেত্রবিশেষে। সংসদে আসন সংরক্ষণ, নির্বাচনে ও চাকরিতে কোটা সংরক্ষণ, পত্রিকায় আলাদা পাতা নির্ধারণ, যানবাহনে পৃথক আসন সংরক্ষণ অবশ্যই অগ্রাধিকার।

যেসব শিক্ষিত মেয়েরা সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকারের কথা বলেন এবং আলোচিত/অনালোচিত কোনো কোনো ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভোগ করেন, তারা কিন্তু পুরুষদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আসছেন না সর্বক্ষেত্রে। অ্যাথলেটস ও খেলাধুলায় বিশ্বের সব দেশের মেয়েরাই প্রতিযোগিতা করছেন নিজেদের মধ্যে। এমন কি কার্ড ও দাবা খেলার মতো মানসিক (আই.কিউ.) প্রতিযোগিতায়ও তারা আলাদাই থাকছেন। দ্রুত মানবের রেকর্ড ভাঙতে পারেননি কোনো দ্রুত মানবী। অর্থাৎ প্রকৃতিগত কারণেই সবাই ভোগ করতে পারেন না, পারবেন না সব ক্ষেত্রে সমান অধিকার। যেমন- ভোটাধিকার নেই শিশুর ও পাগলের। সন্তান ধারণ করতে পারেন না পুরুষ। বলা যায় না এমন আরো অনেক কারণেই সর্বক্ষেত্রে সমান হতে পারে না নারী ও পুরুষের অধিকার। আমাদের পূর্বনারীরা তো কারণে-অকারণে বঞ্চিত হয়েছেন, আঘাত সয়েছেন অনেক। অতিরিক্ত অধিকার নিয়ে বা পাল্টা আঘাত দিয়ে সেসব কি আর উসুল করা যাবে এখন? কিংবা উসুল করা উচিত হবে বর্তমান অথবা ভবিষ্যৎ পুরুষদের ওপর?

বাস্তবে যারা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত তারা অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত। শিক্ষার সুযোগ লাভের দাবিতেই হওয়া উচিত আন্দোলন। নারীদের মনে রাখতে হবে, এই আন্দোলন জীবনসঙ্গী বা অন্য পুরুষদের বিরুদ্ধে নয়; নিজেদের কুসংস্কার, অশিক্ষা, অযোগ্যতা, হীনমন্যতা ও অদূরদর্শিতার বিরুদ্ধে। তাই জাগ্রত করতে হবে নিজের বিবেক। উপলব্ধি করতে হবে প্রকৃত মর্যাদা। অর্জন করতে হবে সুশিক্ষা। অধিকারের জন্য প্রয়োজন যোগ্যতা অর্জন ও দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পাদন। সমান অধিকারের দাবিতে অগ্রাধিকার নয়; বিদ্যমান ও অর্জিত যোগ্যতার শক্তিতেই ভোগ করতে হবে যোগ্যাধিকার।

লেখক: শিক্ষাবিদ এবং অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0064840316772461