ভোলা সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের জনতা বাজার এলাকায় পুলিশের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশ নিহত স্কুলছাত্র রোম্মান হোসেন জমদ্দার (নোমান) কে প্রধান আসামি করে উল্টো মামলা দায়ের করেছে। ওই মামলায় পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত কয়েকজনসহ ৭০০ গ্রামবাসীকে আসামি করা হয়েছে। এতে করে রাজাপুরে পুলিশের প্রতি নতুন করে ক্ষোভ দানা বাধছে।
পাশাপাশি এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্কও বিরাজ করছে। তাদের ধারণা, ওই মামলায় পুলিশ এলাকায় ফের চাঁদাবাজিতে মেতে উঠবে। পুলিশের গুলিতে স্কুলছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ি ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো হতাহতদের বিরুদ্ধে পুলিশের দায়ের করা মিথ্যা মামলায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা। অপরদিকে ঘটনার মূল হোতা টর্সাল সেল নামে খ্যাত পুলিশের অস্থায়ী ক্যাম্পের মালিক গ্রেপ্তারকৃত নাসির সর্দারের বিরুদ্ধে কোন মামলা না দিয়ে পুরানো মামলায় তাকে আজ শনিবার ভোলার আদালতে প্রেরণ করা হয়।
ভোলা সদর মডেল থানার ওসি মীর খায়রুল কবির জানান, বৃহস্পতিবার ভোলা সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের জনতা বাজার এলাকায় সংঘঠিত পুলিশের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত স্কুলছাত্র রোম্মান হোসেন জমদ্দার (নোমান) কে প্রধান আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। রাজাপুরের অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ নায়েক আবদুস সাত্তার বাদী হয়ে পুলিশ ক্যাম্পে হামলা-ভাঙচুর ও পুলিশ এসোল্টের অভিযোগে ওই মামলা দায়ের করেন। মামলায় পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত আমিরুননেছা (নিহত নোমানের মা), রাজাপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি মিজানুর রহমান (পুলিশের নির্যাতনে আহত)সহ ৭০০ গ্রামবাসীকে আসামি করা হয়েছে।
এদিকে পুলিশের গুলিতে স্কুলছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ি ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো হতাহতদের বিরুদ্ধে পুলিশের দায়ের করা মিথ্যা মামলায় পুলিশের প্রতি নতুন করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে এলাকার বিক্ষুব্ধ সারাণ মানুষ। পুলিশের গুলিতে স্কুলছাত্র নোমান নিহত ও আহত হওয়ার ঘটনায় পুলিশ মূল হোতা বিএনপি নেতা নাসির ও পুলিশ ক্যাম্পের পুলিশের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো নিহত ও আহতদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়ায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে রাজাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত বিডিআর সবুজ জমদ্দার ও আবদুল মতিনসহ স্থানীয়রা জানান, এতে পুলিশের প্রতি এলাকাবাসীর ক্ষোভ আরো তীব্র আকার ধারণ করতে পারে।
তারা আরো বলেন, যার বাড়িতে পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হলো সেই বাড়ির মালিক হত্যা, ধর্ষণ ও ডাকাতিসহ বহু মামলার আসামি বিএনপি নেতা নাসির সর্দার পুলিশের সহায়তায় এলাকায় ব্যাপক চাঁদাবাজি ও নির্যাতনসহ বিভিন্ন অপকর্ম চালাতো। নাসির সর্দারই পুলিশের হাত থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে স্কুলছাত্র নোমানকে গুলি করে হত্যা করেছে। আহত করেছে বহু নিরীহ মানুষকে। অথচ সেই মূল হোতা নাসির সর্দারের বিরুদ্ধে কোন মামলা না নিয়ে উল্টো নিহত স্কুলছাত্র নোমান ও আহতদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিলো পুলিশ। তারা প্রশ্ন তোলে বলেন, মৃত ব্যক্তির নামে কিভাবে মামলা হয়?
ওসি মীর খায়রুল কবির আরো জানান, এ ঘটনার মূল হোতা টর্সাল সেল নামে খ্যাত পুলিশের অস্থায়ী ক্যাম্পের মালিক গ্রেপ্তারকৃত নাসির সর্দারের বিরুদ্ধে পুরানো মামলায় তাকে আজ শনিবার ভোলার আদালতে প্রেরণ করা হয়।
এদিকে পুলিশের গুলিতে স্কুলছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ি ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো হতাহতদের বিরুদ্ধে পুলিশের দায়ের করা মিথ্যা মামলায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইট্স ডিফেন্ডার ফোরাম।
সংগঠনের ভোলা জেলা শাখার সভাপতি মোবাশ্বির উল্যাহ চৌধুরী শনিবার সকালে সংবাদ সম্মেলনে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ইউপি নির্বাচনোত্তর রাজাপুর ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী মিজান খাঁ একই দলের পরাজিত প্রার্থী মিঠু চৌধুরীর কর্মীদের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। মিজান খাঁ তার কর্মী নাসির সর্দারের মাধ্যমে পুলিশের সহায়তায় পরাজিত প্রার্থীর কর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে পুলিশ গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি শুরু করে।
রাজাপুরের ওই অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পটি এক পর্যায়ে স্থায়ী টর্সাল সেলে পরিণত হয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় গত বৃহস্পতিবার বিজয়ী চেয়ারম্যানের কর্মী ছাত্রদল নেতা মিজানুর রহমানকে পুলিশ ধরে নিয়ে বেদম মারধর করে। এতে স্থানীয়রা ক্ষিপ্ত হলে পুলিশ জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। সেই গুলিতে নিহত হয় স্কুলছাত্র নোমান ও গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয় অন্তত ৩০ জন।
তিনি আরো বলেন, চাঁদার দাবিতে গত বুধবার ভোলার বাংলাবাজার পুলিশ ফাঁড়ির পুলিশ তনুময় ওই এলাকার টিনের ব্যবসায়ী শাহজাহানকে সোনালী ব্যাংকের ভেতরে মারধর করে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। ওই ঘটনায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ক্ষুদ্ধ হয়ে মিছিল করে।
প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে জনতা বাজারস্থ অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পের কয়েকজন সাদাপোশাকে পুলিশ রাজাপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি মিজানুর রহমানকে আটকের পর জনতা বাজারে নিয়ে বেদম মারধর করে। পরে তাকে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। এ খবর পেয়ে ছাত্রদল নেতার স্বজনসহ স্থানীয় লোকজন লাঠিসোটা নিয়ে রাতে অস্থায়ী ওই পুলিশ ক্যাম্পে গিয়ে হামলা চালায়। তারা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে অস্থায়ী ক্যাম্পের দরজা-জানালা ভাঙচুর করে। এ সময় ক্যাম্পের কয়েকজন পুলিশ জনতাকে লক্ষ করে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি ছোরে। এ সময় অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পের ভেতরে অবস্থানরত ওই বাড়ির মালিক নাসির নিজেও পুলিশের হাত থেকে বন্ধুক নিয়ে জনতাকে লক্ষ করে গুলি ছোরে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। রাত ১০টা পর্যন্ত পুলিশের সঙ্গে জনতার দফায় দফায় এ সংঘর্ষ চলে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে স্কুলছাত্র নোমান (১৭) ঘটনাস্থলেই মারা যায়। এতে গুলিবিদ্ধসহ আহত হয় অন্তত ৩০জন। এর মধ্যে চারজন পুলিশ সদস্যও আহত হন। এরপরে রাতেই ভোলা সদর মডেল থানার ওসি মীর খায়রুল কবিরের নেতৃত্বে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ওই ঘটনার পর রাজাপুরের অস্থায়ী ক্যাম্পের ১০ পুলিশের মধ্যে সবাইকেই পুলিশ ক্যাম্পের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে ভোলা পুলিশ লাইনে ক্লোজড করা হয়। এ ঘটনায় অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পের মালিক নাসিরকে আটক করা হয়। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে বলেও পুলিশ জানিয়েছে।