পঞ্চম শ্রেণীর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় টাকার বিনিময়ে জিপিএ-৫ দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ অভিযোগ রাজধানীর তিনটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে। অভিযুক্ত স্কুলগুলোর প্রধান শিক্ষক, থানা শিক্ষা কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশে গত কয়েক বছর ধরেই খুদে শিক্ষার্থীদের ইচ্ছেমতো নম্বর টেম্পারিং হয়ে আসছে বলে অভিযোগে বলা হয়েছে। অসাধু অভিভাবকরা টাকার বিনিময়ে অনৈতিক পন্থায় সন্তানদের ফল পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছেন।
অভিযোগে বলা হয়েছে, যে শিশু ইংরেজিতে ৩৪ নম্বর পেয়েছে, তাকে পরবর্তীতে খাতা টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে দেয়া হয়েছে ৮০ নম্বর। আবার কোন শিক্ষার্থী বাংলা ও গণিতে ৪০ বা ৫০ নম্বর পেলেও এদের খাতা টেম্বারিংয়ের মাধ্যমে ৮০ ও এর বেশি নম্বর দিয়ে জিপিএ-৫ (গ্রেড পয়েন্ট এভারেজ) নিশ্চিত করা হয়েছে।
বিগত কয়েক বছর ধরেই রাজধানীর এক শ্রেণীর প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তা এই ধরনের অনৈতিক কাজ করে আসছে বলে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ করেছেন ঢাকার গুলশান থানার কয়েকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে কোন শিক্ষার্থীর নম্বর কমানোর অভিযোগ পাওয়া যায়নি।
অভিযোগ অনুযায়ী, ২০১৬ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় রাজধানীর গুলশান থানার কালাচাঁদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মোট ২১ জন ছাত্রছাত্রীর ইংরেজি বিষয়ের নম্বর টেম্বারিং করে এ-প্লাস নম্বর (৮০ নম্বরের কম নয়) দেয়া হয়েছে।
ওই স্কুলের খাতা মূল্যায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল রাজধানীর ডেমরা থানা শিক্ষা অফিসকে। ডেমরা থানা থেকে পাঠানো ইংরেজি বিষয়ের মূল মার্কশিটে (নম্বরপত্র) দেখা গেছে, কালাচাঁদপুর স্কুলে ইংরেজি বিষয়ে এ-প্লাস পেয়েছে ১৫ জন শিক্ষার্থী। কিন্তু পরবর্তীতে একটি সংযুক্ত মার্কশিট থেকে দেখা যায়, ওই স্কুলে ইংরেজি বিষয়ে এ-প্লাস পেয়েছে ৩৬ জন শিক্ষার্থী। নম্বর টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে ৩৬ জন শিক্ষার্থীকে এ-প্লাস ফলাফল দেয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে কালাচাঁদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান গত ১৬ মে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আমার কাছে কোন তথ্য নেই।’
তবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই) এ বিষয়ে দু’বার তদন্ত করেছে কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, তারা দু’বার তদন্ত করেছে। কিন্তু তদন্তের ফলাফল আমাদের জানায়নি।’
দুদক চেয়ারম্যান বরাবর দেয়া অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, কালাচাঁদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, গুলশান থানা শিক্ষা কর্মকর্তার যোগসাজশে প্রতি বছর নম্বরপত্র পরিবর্তন বা টেম্পারিং করে পছন্দের ছাত্রছাত্রীদের নম্বর বাড়ানো হয়। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর ও এর ঢাকার বিভাগীয় উপ-পরিচালক দু’দফা তদন্ত করলেও কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি। এজন্য তদন্তের স্বার্থে ও প্রকৃত দোষীদের খুঁজে পেতে খাতা মূল্যায়নকারী ডেমরা থানা হতে পাঠানো ইংরেজি বিষয়ের মূল মার্কশিট সংগ্রহ এবং খাতা চেক করলে নম্বর টেম্পারিংয়ের প্রমাণ পাওয়া যাবে। এছাড়াও নম্বর টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে গুলশানের উদায়ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ভোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কিছু পরীক্ষার্থীর ফলাফলও পরিবর্তন করা হয়েছে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে গুলশান থানা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা খান মাহসুরা আক্তার টুইন বলেন, ‘অভিযোগ সঠিক নয়। কারণ এ বিষয়ে বিভাগীয় তদন্ত হয়েছে। কিন্তু কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।’
শিক্ষক ও অভিভাবকদের দলাদলি ও গ্রুপিংয়ের কারণেই এই ধরণের অভিযোগ উঠেছে বলে মন্তব্য করেন শিক্ষা কর্মকর্তা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিপিই’র ঢাকার বিভাগীয় উপ-পরিচালক ইন্দু ভূষণ দে গত ১৬ মে বলেন, ‘এ বিষয়ে অনেকদিন ধরেই তদন্ত চলছে। এটি এখনও শেষ হয়নি। আশা করছি- কিছুদিনের মধ্যে তদন্ত কার্যক্রম শেষ করতে পারবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।’
এখন পর্যন্ত অভিযোগের বিষয়ে কোন সত্যতা পাওয়া গেছে কীনা জানতে চাইলে উপ-পরিচালক বলেন, ‘তদন্ত কর্মকর্তারা আমাকে জানিয়েছেন- কিছু ফাইন্ডিস (তথ্য-প্রমাণ) পাওয়া গেছে। আরও কিছু ফাইন্ডিস যাচাই বাছাই করা হচ্ছে।’
ডেমরা থানা থেকে সংযুক্ত মার্কশিটের অনুরূপ ইংরেজি খাতার মার্কশিট উদ্ধার বা জব্দ করার পরামর্শ দিয়ে অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়েছে, ‘গুলশানের ঘোষিত ফলাফলের স্কুল ওয়াইজ কপি সংগ্রহ করতে হবে। থানার কম্পিউটার থেকে এ ফলাফলের কপি প্রিন্ট করা যাবে, যেখানে ৫১টি এ-প্লাস থাকে। থানার ডিআর থেকে পরীক্ষার্থীর নাম, বাবার নাম, মায়ের নাম মূল কপির সঙ্গে মিলানো প্রয়োজন। ডেমরার মার্কশিট, খাতা ও সংযুক্ত মার্কশিট মিলাতে হবে। ইতোমধ্যে খাতায় পুনরায় লেখা হয়ে থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার্থীর হাতের লেখা সংগ্রহ করে মিলানো প্রয়োজন এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী ও তার বাবা-মা’র সাক্ষাৎকার নেয়া যেতে পারে। পরীক্ষক, নিরীক্ষক ও প্রধান পরীক্ষকের সাক্ষাৎকার নিয়ে সত্যতা যাচাই করা যেতে পারে। ডাটা এট্রি অপারেটরদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে সঠিক তথ্য পাওয়া যেতে পারে’।
নম্বর টেম্পারিংয়ের নমুনা : গুলশান থানার কয়েকটি স্কুলের ইংরেজি বিষয়ের পরীক্ষার (২০১৬) নম্বরপত্রে দেখা গেছে, একটি শিশু (রোল-৪৫৬১৪৭৩্ত) ইংরেজিতে পেয়েছিল ৩৩ নম্বর, পরবর্তীতে সংযুক্ত নম্বরপত্রে তাকে দেয়া হয় ৮০ নম্বর। আরেকটি শিশু (রোল-৪৫৬১৪৭্ত) ইংরেজিতে পেয়েছিল ৭০ নম্বর, সংযুক্ত নম্বরপত্রে তাকে দেয়া হয় ৮০ নম্বর। আরেক শিক্ষার্থী (রোল-৪৫৬১৪৫্ত) ইংরেজিতে পেয়েছিল ৭০, সংযুক্ত নম্বরপত্রে তাকে দেয়া হয় ৮০ নম্বর। এক শিশু (রোল-৪৫৬১৪৬্ত) পেয়েছিল ৬০ নম্বর, সংযুক্ত নম্বরপত্রে তাকে দেয়া হয় ৮০ নম্বর। এভাবে মোট ৩৬ জন শিশু শিক্ষার্থীর নম্বর পরিবর্তন করে এদের এ-প্লাস নম্বর দেয়া হয়।