পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা - দৈনিকশিক্ষা

পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

অর্জিত জ্ঞান ও মেধা যাচাইয়ের জন্য পরীক্ষা ব্যবস্থা সব দেশেই  গ্রহণযোগ্য ও স্বীকৃত উপায় । আমাদের দেশে ও তাই । কিন্তু দুঃখের বিষয়-আমাদের এখানে পরীক্ষা ব্যবস্থা নানা কারণে বিতর্কের জালে জড়িয়ে পড়েছে । একটা সময় ‘নকল’-এর দুর্নামে ডুবে গিয়েছিলাম আমরা । সেটি এখন আর তেমন নেই বললে চলে। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু হবার কারণে সে দুর্নাম অনেকটা ঘুচে গেছে । এ পদ্ধতি চালু হবার পূর্বে কয়েক বছর আমাদের পরীক্ষায় নকলের জয় জয়কার ছিল।

এরপর গত কয়েকটা বছর ‘প্রশ্ন ফাঁস’-এর দুর্নামে আমাদের পরীক্ষা ব্যবস্থা নানা ভাবে বিতর্কিত হয়েছে । ইদানিং সরকার এ বিষয়ে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করায় এ বদনামটা ও মোটোমুটি কেটে উঠবার পথে আমরা । কিন্তু- বর্তমান সময়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের অনেকে পরীক্ষার খাতায় যা তা লিখে ভাল নম্বর পেয়ে পাস করে , আবার কেউ কেউ অত্যন্ত ভাল লিখে ও সঠিক নম্বর থেকে বঞ্চিত হয় । তাতে ফলাফলে পরিলক্ষিত হয় নানা অসঙ্গতি । যে শিক্ষার্থী  নরম্যাল জিপিএ-৫ ও পাবার কথা নয় , সে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পর্যন্ত পেয়ে যায় । আবার অনেক ভাল শিক্ষার্থী যে জিপিএ- ৫ তো বটে ; গোল্ডেন পর্যন্ত পাবার কথা, সে ও ফেল করে বসে । এ দিকে পাসের হার বৃদ্ধির এক অশুভ প্রতিযোগিতায় আমরা নেমে পড়েছি । শিক্ষাবোর্ড যেমন, তেমনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনকি অভিভাবকদের মধ্যে ও কেবল পাসের হার বৃদ্ধির

এ অশুভ প্রতিযোগিতার প্রবণতাটি দিনে দিনে স্পষ্ট হয়ে ওঠছে । এর ফলে জ্ঞানার্জনের প্রতিযোগিতার পথ হারিয়ে আমরা পরীক্ষা পাসের প্রতিযোগিতার পথে কেবলি হেঁটে চলেছি । আর এ জন্য আমাদের প্রজন্মটি আজ অনেকটা মেধাশুন্য হয়ে বেড়ে ওঠছে । সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির মত এক অতি উত্তম পদ্ধতি নানা বিতর্কের মুখে পড়ে মাঠে মারা যেতে বসেছে । সারা পৃথিবী যেখানে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির সুফল ঘরে তুলছে, সেখানে আমাদের এ নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব । এ আমাদের জাতির জন্য কোনমতে শুভ নয় ।

সময় ইতোমধ্যে অনেক পেরিয়ে গেছে । নতুন প্রজন্মকে বাঁচাতে সেদিকে নজর দেবার এখনই উপযুক্ত সময় । সর্বপ্রথম আমাদের পরীক্ষার খাতায় নির্ভরযোগ্য (Reliable) নম্বর প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে । সে কী করে সম্ভব ? সুখের বিষয় যে , বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট ( বিইডিইউ ) এ বিষয়ে সম্প্রতি কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে । সেসিপ (SESIP) এ কার্যক্রমে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে এগিয়ে এসেছে। আমাদের শিক্ষার মান বৃদ্ধি ও পরীক্ষার দুর্নাম ঘুচাতে দেশের সকল স্তরের শিক্ষকদের এগিয়ে আসতে হবে । শিক্ষাবোর্ড সমূহকে ও কার্যকর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।

আমাদের সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু করবার সময় যে ভাবে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল , সে ভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়নে নির্ভরযোগ্যতা আনয়নের জন্য প্রত্যেক শিক্ষককে অন্ততঃ তিন দিনের একটা প্রশিক্ষণ প্রদান করা অপরিহার্য ।

আরেকটা বিষয় ভেবে দেখা যেতে পারে । পরীক্ষার প্রতিটি বিষয়ে প্রশ্নের সংখ্যা হ্রাস করা প্রয়োজন। তিন ঘন্টার পরিবর্তে দেড় কিংবা দু’ ঘন্টা সময়ে ৪০ অথবা ৫০ নম্বরের পরীক্ষা নেয়া যায় । ১০ কিংবা ২০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা ও নেয়া যেতে পারে । এসবিএ কিংবা সিএ পদ্ধতিতে মূল্যায়ন জোরদার করলে সুফল অবশ্যই আশা করা যায় । অনেক বিষয়ের পরীক্ষা নিতে গেলে একদিকে যেমন অনেকগুলো শিক্ষা দিবসের অপচয় হয়, তেমনি মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ও জট সৃষ্টি হয় । তাই আমাদের শিক্ষায় বিষয় সংখ্যা কমিয়ে আনা প্রয়োজন । আজে বাজে  বিষয় দিয়ে শিক্ষাকে ভারাক্রান্ত করার মানে হয় না । অতিরিক্ত বিষয়ের কারণে মূল্যায়নের বিষয়টি জটে আটকা পড়ে । এ ক্ষেত্রে কেবল মাতৃভাষা, ইংরেজি, গণিত, আইসিটি ও কারিগরি শিক্ষা সম্বন্ধীয় বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা যায়।

প্রশ্নপত্র প্রণয়নের ক্ষেত্রে এর যথার্থতা (Validity) সর্বাগ্রে নিশ্চিত করা প্রয়োজন । প্রশ্ন যথার্থ না হলে এর উত্তর মূল্যায়নে নির্ভরযোগ্য নম্বর প্রদান কঠিন হয়ে ওঠে ।

আমাদের পাবলিক পরীক্ষা সমূহে একেক জন পরীক্ষক চার-পাঁচশ’ খাতা মূল্যায়ন করে থাকেন । সময় দেয়া হয় মাত্র দশ থেকে পনর দিন । এ অল্প সময়ে এতগুলো খাতা একজন পরীক্ষকের পক্ষে মূল্যায়ন করা কী করে সম্ভব ? বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে যেন তেন ভাবে খাতা দেখে দায়সারা হবার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয় ।

আমাদের পরীক্ষা নিতে দেড় থেকে দু’ মাস সময় লেগে যায় । কিন্তু, খাতা মূল্যায়ন করে ফল দেবার জন্য তাড়াহুড়ো করার কী দরকার ?  একজন পরীক্ষককে সর্বোচ্চ দু’শ থেকে আড়াইশ উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতে দিয়ে কম করে কুড়ি-পঁচিশ দিন সময় হাতে দিলে ভাল হয় ।

উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে প্রধান পরীক্ষক কর্তৃক সরবরাহকৃত নম্বর প্রদান নির্দেশিকা ও নমুনা উত্তর

(Rubrics & Sample Answer) অনুসরণ করা যে কোন পরীক্ষকের জন্য অত্যন্ত সহায়ক হলে ও নমুনা উত্তরই (Sample Answer) একমাত্র সঠিক উত্তর মনে করা মোটে ও ঠিক নয় । যদি তা করা হয়, তবে তাতে নির্ভরযোগ্য নম্বর প্রদান বিঘ্নিত হবেই ।

আরেকটা বিষয় সকল পরীক্ষককে নিশ্চয় অনেকটা কষ্টে ফেলে দেয়। সেটি হচ্ছে- খাতার উত্তরপত্রের কভার পৃষ্ঠার অসংখ্য বৃত্ত ভরাটের কাজ । এ কাজটি যাতে সহজ ও সংক্ষিপ্ত করা যায় , সে পথ খোঁজে বের করা প্রয়োজন।

একজন প্রধান পরীক্ষক বেশ ক’ জন পরীক্ষকের কাজ তদারকি ও পর্যবেক্ষন করে থাকেন । তার ওপর প্রধান পরীক্ষককে যদি হাজার-পনর শ’ খাতা মূল্যায়ন করতে দেয়া হয়, তা হলে তার করার কী থাকে ?

আমার বোধগম্য হয় না, কেন এক বছরের পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের পারিশ্রমিক কিংবা সম্মানী আরেক বছর দেয়া হয় ? তাতে পরীক্ষক কিংবা প্রধান পরীক্ষকের কাজের উৎসাহে ভাটা পড়াই স্বাভাবিক । খাতা মূল্যায়নের সাথে সাথে সম্মানীর টাকা প্রদান করতে পারা না গেলে ও দশ-বিশ দিনের মধ্যে দেয়া যাবে না কেন ?  এ সব বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা মনযোগি হলে খাতা মূল্যায়নের বিষয়ে পরীক্ষকদের আগ্রহ অনেক বাড়বে ।

এক বিষয়ের সকল পরীক্ষক একই নম্বর প্রদান নির্দেশিকা ও নমুনা উত্তরপত্র (Rubrics & Sample Answer) অনুসরণ করে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করলে যে পাস করার সে পাস আর যে ফেল করার সে-ই ফেল করবে । একই উত্তরপত্র মূল্যায়নে ভিন্ন ভিন্ন পরীক্ষকের নম্বর প্রদানে তারতম্য হবে না ।

Randomize অর্থাৎ বিভিন্ন বান্ডিলের উত্তরপত্র মিলিয়ে এলোমেলো করে বান্ডিল প্রস্তুত করে সকল উত্তরপত্রের একই প্রশ্নের উত্তর এক সাথে মূল্যায়ন করলে নম্বরের হেরফের হবার সুযোগ যেমন কম থাকে, তেমনি নির্ভরযোগ্য নম্বর প্রদান নিশ্চিত হয় । আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ও পরীক্ষার দুর্নাম ঘুচিয়ে মেধাবী এক প্রজন্ম গড়তে এ কাজটি সর্বাগ্রে নিশ্চিত করতে হবে ।

[অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী: চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ও দৈনিকশিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।]
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0031278133392334