বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেকেই পরীক্ষার সিজিপিএ জিজ্ঞেস করেন। আরেকজনকে পরীক্ষার সিজিপিএ জিজ্ঞেস করা সাধারণত আমেরিকা ও ইউরোপসহ এশিয়ার অনেক দেশেও এক ধরনের অশোভন আচরণের মধ্যে পড়ে। এ জন্য ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয় অনলাইনে নিজস্ব অ্যাকাউন্টে অথবা খামের মাধ্যমে। যাতে একজন আরেকজনের ফলাফল দেখতে না পারে।
আরেকটি বিশেষ ব্যাপার লক্ষণীয়, শিক্ষক যখন শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতা দেন, খাতাটি এমনভাবে দেন যাতে করে একজনের গ্রেড আরেক জনে না দেখেন। একজন শিক্ষক যদি পাবলিকলি একজনের গ্রেড আরেকজনকে বলেন তাহলে শিক্ষার্থী শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবার অধিকার রাখেন।
এখন ব্যাপার হলো, কেন গ্রেড বা সিজিপিএ নিয়ে এত লুকোচুরি? আমাদের দেশের জন্য এটা অনেকটা হাস্যকর। কারণ দেশের যে কটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বছর সেমিস্টার ফাইনাল বা ইয়ার ফাইনালে যে ভাইভা কোর্সটি থাকে, সেখানে শিক্ষকেরা সবাইকে প্রথমেই পূর্ববর্তী পরীক্ষার সিজিপিএ জিজ্ঞেস করে থাকেন। আপনার সিজিপিএ যদি খুব ভালো হয় বলতে তেমন কোনো অসুবিধা হয় না। উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষক কখনোই কারও সিজিপিএ জিজ্ঞেস করেন না। কারণ এতে ছাত্রের পূর্ববর্তী ফলাফল বর্তমান মার্কিংয়ের ক্ষেত্রে বিরাট প্রভাব ফেলতে পারে।
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনার্সের সব বর্ষের ফলাফল বিভাগের নোটিশ বোর্ডে নাম ও পজিশনসহ পাবলিকলি টানিয়ে দেওয়া হয়। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে হলের নোটিশ বোর্ডেও তা টাঙানো হয়। জানি না কত বছর আগের নিয়ম এটি। ব্রিটিশ আমলে হয়তো এমন নিয়ম হয়েছিল। তবে ব্রিটিশরা তাদের নিয়ম পরিবর্তন করেছে। আমাদের আর পরিবর্তন করা হয়নি। বুয়েট ও আর দু-একটা বিশ্ববিদ্যালয় এ নিয়মের ব্যতিক্রম।
একটা ক্লাসে অবশ্যই প্রথম থাকবে, লাস্ট থাকবে, ভালো সিজিপিএ, খারাপ সিজিপিএ সবই থাকবে। আর খারাপ সিজিপিএ আছে বলেই তো ভালো সিজিপিএধারীর এত বাহাদুরি। না হলে সবাই এক ক্যাটাগরির হয়ে যেতো। ৪ থেকে শুরু করে ২.৬০ পাওয়া সব শিক্ষার্থীর সিজিপিএ যদি হলের নোটিশ বোর্ডে টানানো থাকে, যে ছেলেটি ব্যাচে লাস্ট হয়েছে, আগে যেটাকে থার্ড ক্লাস বলত বিশ্ববিদ্যালয়ে, হল ও বন্ধু মহলে শিক্ষার্থীটি কতটা হীনমন্যতায় ভোগেন? হলের ক্যানটিনের ছেলেটিও এসে অমুক ভাইয়ের সিজিপিএ চেক করতে পারে। অথচ আরেকজনের ব্যক্তিগত তথ্য থাকার কথা গোপন, শুধুই গোপন। আর এই পাবলিকলি ফলাফল প্রকাশের কারণে ১৪ বছর পরেও কারও কারও মনে থাকে অমুক আমার ক্লাসের একমাত্র থার্ড ক্লাস ছিল।
প্রকাশ্যে নোটিশ বোর্ডে ফলাফল প্রকাশ একজন শিক্ষার্থীকে সামাজিকভাবে যেমন হেয় প্রতিপন্ন করে, তেমনি তার হতাশাও বাড়িয়ে দেয়। আর বন্ধু মহলেও তার গ্রহণযোগ্যতা নানাভাবে কমিয়ে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক অবশ্যই ছাত্রজীবনে ভালো সিজিপিএর অধিকারী হয়ে থাকেন,।তাই তিনি ক্লাসের শেষ ছেলেটির এই হতাশাটি বুঝবেন কিনা সেটা চিন্তার বিষয়। আমাদের দেশের ইউরোপ-আমেরিকা ফেরত শ্রদ্ধেয় শিক্ষকেরা সবাই বিদেশের এই সুন্দর নিয়মের সঙ্গে পরিচিত। তাদের সদিচ্ছায় নিয়মটি পরিবর্তিত হতে পারে। আর না হলে বছর বছর প্রত্যেক ব্যাচে নীরবে নিভৃতে হতাশাগ্রস্তের সংখ্যা বাড়বে।
*রেজাউল হক নাঈম, পিএইচডি শিক্ষার্থী, পার্ডু বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়েস্ট লাফায়াতে, ইন্ডিয়ানা, যুক্তরাষ্ট্র।