সাম্প্রতিককালে শিক্ষা নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে। বাংলাদেশে শিক্ষার যেমন বিস্তার ঘটেছে, তেমনি প্রশ্ন উঠেছে তার মান নিয়ে। সবার সাধারণ অভিযোগ, শিক্ষার মানের ক্রমাবনতি শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের সংখ্যাগত সাফল্যকে ম্লান করে দিচ্ছে। এজন্য গোটা শিক্ষাব্যবস্থা এখন কাঠগড়ায়। শিক্ষানীতি, কারিকুলাম, সিলেবাস, পাঠ্যবই, প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা, পাঠদান পদ্ধতি, পরীক্ষা পদ্ধতি (সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি, বহু নির্বাচনী অভীক্ষা, ব্যবহারিক পরীক্ষা), প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মার্কিং, ফল প্রকাশ সবকিছুই এখন প্রশ্নের মুখে। শিক্ষকের যোগ্যতা, সততাও প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার। শুধু তাই নয়, কী পড়ানো হচ্ছে, কেন পড়ানো হচ্ছে, কার স্বার্থে কোন স্তরে কোন বিষয় পড়ানো হচ্ছে, কারিগরি শিক্ষা কতটা দক্ষ জনসম্পদ তৈরি করছে, উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সার্টিফিকেটধারী বেকার তৈরির কারখানায় পরিণত হচ্ছে কি-না, এসব প্রশ্ন ক্রমশ জোরদার হচ্ছে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা দুর্বোধ্য ও লক্ষ্যহীন। প্রাথমিক থেকে স্নাতক পর্যন্ত এখন পাসের হার দুনিয়ার যে কোনো দেশের তুলনায় অবিশ্বাস্য রকমের বেশি। নম্বরও পাচ্ছে অবিশ্বাস্য রকমের বেশি। অথচ তাদের জ্ঞান ও দক্ষতা এতই কম যে, তারা ক্রমেই সমাজের জন্য বোঝা হয়ে উঠছে। এই স্ববিরোধিতার উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেশের গুণীজন নাকাল। তারা কয়েকটি প্রধান সমস্যা চিহ্নিত করেছেন। সমাজে শিক্ষকের অমর্যাদা, শিক্ষা খাতে লজ্জাজনক নিম্ন বরাদ্দ, শিক্ষকের প্রতি রাষ্ট্রের অভাবনীয় তাচ্ছিল্য প্রকাশ, উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব, নিয়োগে নির্লজ্জ দলীয়করণ ও দুর্নীতি, শিক্ষকের পেশাগত উন্নয়নে ও ভালো বই প্রণয়নে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা, সার্টিফিকেটসর্বস্ব শিক্ষা, ভ্রান্ত প্রশ্ন পদ্ধতি ও মূল্যায়ন ইত্যাকার নানা কারণে বাংলাদেশে গোটা শিক্ষাব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে।
অবশ্য এসব সমস্যার শিকার সাধারণ জনগণ। সমাজের উচ্চ কোটির সন্তানদের জন্য আছে ভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা। সমাজ রসাতলে গেলে তাদের পোয়াবারো। পাসের অবিশ্বাস্য উচ্চ হারের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মানে আকাশ-পাতাল ফারাক। অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশে এখনকার একজন গ্র্যাজুয়েটের শিক্ষার গড় মান হলো ব্রিটিশ আমলের চতুর্থ শ্রেণি আর পাকিস্তান আমলের সপ্তম শ্রেণির সমতুল্য। হয়তো অতিরঞ্জন আছে; কিন্তু এ কথা যে সর্বাংশে মিথ্যা নয়, তা স্পষ্ট হয় সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায়। একটি টেলিভিশন চ্যানেলের রিপোর্টে আরও ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। সেখানে দেখা যায়, জিপিএ ৫ পাওয়া বিপুল শিক্ষার্থীর বাংলাদেশ সম্পর্কেই মৌলিক ধারণা নেই!
শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য জ্ঞান ও প্রায়োগিক দক্ষতা অর্জন, মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ও সামাজিক দায়বদ্ধতা। চিন্তার বাহন ভাষা। তাই ভাষায় দক্ষতা অর্জন জ্ঞানের প্রাথমিক শর্ত। অন্যদিকে, দক্ষতা হলো কাজ করার যোগ্যতা। দক্ষতা অর্জন ব্যতিরেকে কোনো কাজই করা যায় না। তাই কর্মে দক্ষতা অর্জন শিক্ষার অপরিহার্য লক্ষ্য। ভালো ভাষাজ্ঞান ভালো দক্ষতা অর্জনে সহায়ক। আবার শুধু জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জিত হলেই চলে না। সে জ্ঞান এবং দক্ষতা মূল্যবোধ (সততা, নিষ্ঠা, কর্তব্যপরায়ণতা, দেশপ্রেম, দায়বদ্ধতা, জবাবদিহি, অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, শ্রমের মর্যাদা ইত্যাদি) দ্বারা পরিশীলিত ও আচরিত হতে হয়। সর্বোপরি জ্ঞান, দক্ষতা ও মূল্যবোধ সমাজের (প্রকৃতি, মানুষ, সমাজ, রাষ্ট্র ইত্যাদি) সবকিছুর মঙ্গলে নিবেদিত হলেই শিক্ষা পরিপূর্ণ হয়েছে বলে গণ্য হয়।
দেশে বর্তমান পরীক্ষা ব্যবস্থায় প্রশ্নপত্রে দুটি ভাগ থাকে_ সৃজনশীল ও নৈর্ব্যক্তিক। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়, আইসিটি, কৃষিশিক্ষা ইত্যাদি কিছু বিষয়ে আরেক ভাগ হলো ব্যবহারিক পরীক্ষা। গত ২ জুন ২০১৬ তারিখে সৃজনশীল প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ শুধু বহু নির্বাচনী অভীক্ষা ও ব্যবহারিক পরীক্ষা নিয়ে আলোচনা করা হলো।
বহু নির্বাচনী অভীক্ষা :পাবলিক পরীক্ষায় বহু নির্বাচনী (নৈর্ব্যক্তিক) অভীক্ষার বিরুদ্ধে সোচ্চার এখন দেশের সুধী মহল। সবার অভিযোগ, এই ব্যবস্থা শিক্ষার মানের মারাত্মক অবনতি ঘটিয়েছে। প্রতিবছর জুনিয়র, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কয়েক লাখ শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পাচ্ছে, যার অর্থ প্রত্যেক বিষয়ে তাদের প্রাপ্ত নম্বর শতকরা ৮০ বা তার ঊধর্ে্ব। কিন্তু এত উচ্চ নম্বর পাওয়া সত্ত্বেও তাদের অধিকাংশের ভাষা, গাণিতিক, সাধারণ বিজ্ঞান, প্রকৃতি ও সমাজ সম্পর্কিত জ্ঞান এতই সীমিত যে, সমাজে তারা এক ধরনের উপহাসের পাত্রে পরিণত হচ্ছে।
যত দূর মনে পড়ে, এ দেশে মাধ্যমিকে অবজেক্টিভ বা নৈর্বাচনিক অভীক্ষা শুরু হয় ১৯৬৯ সালে, ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনামলে। নির্বাচিত কিছু বিষয়ে মাত্র ১৫ নম্বরের অবজেক্টিভ প্রশ্নের জবাব দিতে হতো। তবে শুধু টিকচিহ্ন দেওয়ার রেওয়াজ তখন ছিল না। দুই ধরনের প্রশ্ন করা হতো। প্রথম ধরনের ১০ নম্বরের প্রশ্নের উত্তর হতো খুবই সংক্ষিপ্ত, দুয়েকটা ছোট বাক্যে। বাকি পাঁচ নম্বরের বহু নির্বাচনী প্রশ্ন, চারটি উত্তরের মধ্যে সঠিক উত্তরটি বেছে নিয়ে তা পুরো বাক্যের শূন্যস্থানে খাতায় লিখতে হতো। কেউ কেউ পরামর্শ দিতেন, প্রশ্নের ক, খ, গ বা ঘ লিখে উত্তর দেওয়ার। তবে আমাদের যারা শিক্ষক ছিলেন, তারা তা নিরুৎসাহিত করতেন। বলতেন, যত বেশি লিখবে, তত বেশি শিখবে। আমরা তা মান্য করেছি পুরো বাক্য খাতায় লিখে। তবে সময় ফুরিয়ে গেলে এবং পুরো বাক্য লেখার সময় না থাকলে কেউ কেউ ক বা খ ইত্যাদি লিখে প্রশ্নের উত্তর দিত। এমন উত্তরে নম্বর পাওয়া নির্ভর করত পরীক্ষকের মর্জির ওপর।
১৯৯৪ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের নিবন্ধন ও ফল তৈরিতে কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু হয়। ওএমআর (অপটিক্যাল মেশিন রিডিং) প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষা বোর্ডের কাজে যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হয়। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগে কি-না জানি না, পরীক্ষায় বহু নির্বাচনী পরীক্ষার নম্বর বাড়িয়ে বিষয়ভেদে ৩৫-৫০ করা হয়। পরীক্ষার্থীরা টিকচিহ্নের পরিবর্তে বৃত্ত ভরাট করবে। পাস নম্বর প্রথমে প্রচলিত ৩৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৪০ শতাংশ। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সারাদেশে প্রবল আন্দোলন শুরু হলে তৎকালীন সরকার আপস করে পাস নম্বর কমিয়ে আবার ৩৩ শতাংশে আনে। দুর্যোগের সেই শুরু।
পৃথিবীর বহু দেশে সীমিত আকারে বহু নির্বাচনী অভীক্ষা প্রচলিত আছে। এই অভীক্ষায় কখনও মোট নন্বরের ১০-১৫ ভাগের বেশি হয় না। রয়েছে বেশ কিছু কঠোরতা। যেমন_ ভুল উত্তরের জন্য নম্বর কাটা। সঠিক উত্তর দিয়ে আলাদাভাবে ৬০-৭০ শতাংশ পেলে তবে পাস। কিছু বৈজ্ঞানিক সূত্র অনুসরণ করে বহু নির্বাচনী প্রশ্ন তৈরি করা হয়, যাতে শিক্ষার্থীরা অনুমানভিত্তিক উত্তর করতে না পারে। দুর্ভাগ্যক্রমে, বাংলাদেশে বহু নির্বাচনী অভীক্ষায় কোনো আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন অনুসরণ করা হয় না। এখানে যে বহু নির্বাচনী পরীক্ষা হয় তাতে যে কোনো পরীক্ষার্থী সব প্রশ্নের শুধু ক উত্তর সঠিক বলে চিহ্নিত করে ১০ নম্বর পেয়ে যায়। অথচ তার পাস করতে প্রয়োজন হয় মাত্র ১৩ নম্বর। পরীক্ষার হলে যে কোনো উপায়ে আরও তিনটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর সে পেয়ে যেতে পারে। ইতিহাস বলছে, প্রথম বছরেই (১৯৯৪) মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলে অভাবিতপূর্ব উচ্চ হারে শুধু পাসই করেনি, তাদের অধিকাংশই স্টার নম্বর (৭৫ শতাংশ) পেয়ে যায়। তখন বাজারে প্রচলিত হয়, ‘আকাশে যত তারা, বাংলাদেশে মাধ্যমিক পরীক্ষায়ও তত তারকা।’ কোনো কিছু না জেনেই অন্ধের মতো বৃত্ত ভরাট করে ১০ নম্বর পাওয়ার এমন আজগুবি ব্যবস্থা শুধু বাংলাদেশেই প্রচলিত হয়ে তা গত দুই দশক ধরে চলছে!
ব্যবহারিক পরীক্ষা :বাংলাদেশে পাবলিক পরীক্ষায় পাসের অতি উচ্চহারের অন্যতম কারণ ব্যবহারিক পরীক্ষা। বিজ্ঞানে ব্যবহারিক পরীক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবহারিক পরীক্ষা ছাড়া বিজ্ঞান পাঠ অর্থহীন। কিন্তু বাংলাদেশে অন্তত ৯০ ভাগ স্কুল-কলেজেই নামমাত্র ব্যবহারিক ক্লাসও হয় না। টাকার বিনিময়ে যে কোনো পরীক্ষার্থীই ব্যবহারিক পরীক্ষায় ৮০-১০০ শতাংশ নম্বর পায়! বাস্তবিকে ব্যবহারিক পরীক্ষা পাবলিক পরীক্ষার আরেকটা অভিশাপে পরিণত হয়েছে। আর এ জন্য দায়ী আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সর্বস্তরে দুর্নীতির রাহুগ্রাস ও মূল্যবোধের সীমাহীন অবক্ষয়।
আমাদের দুর্ভাগ্য, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বক্ষেত্রে আমরা এক অরাজক অবস্থার মুখোমুখি। এখানে সততা, নিষ্ঠা, মূল্যবোধ আজ আসামির কাঠগড়ায়, ‘সুবচন নির্বাসনে’। মসির চেয়ে ক্ষমতাবান এখন পেশিশক্তি। দুর্নীতি, মাস্তানি, মিথ্যাচার, শোষণ, লুণ্ঠন সর্বব্যাপী। মানবিকতা লাঞ্ছিত। উপেক্ষিত নাগরিক ও মানবাধিকার। যে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত, সেসব শহীদী আত্মা এখন ক্রন্দনরত।
শিক্ষা কোনো বিলাসিতা নয়। শিক্ষা হলো কঠোর সাধনার ফসল। পরীক্ষা পাসের উচ্চহারের নামে চলছে শিক্ষার সঙ্গে বেইনসাফি। সম্প্রতি বিশিষ্টজন বহু নির্বাচনী পরীক্ষা বাদ দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী হালে বলেছেন, ধীরে ধীরে বহু নির্বাচনী অভীক্ষা পাবলিক পরীক্ষা থেকে বাদ দেওয়া হবে। তিনি শিক্ষার মানের ক্রমাবনতির অভিযোগও কবুল করেছেন। আমরা সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানাই।
আজকের এই পরিস্থিতি শাসকশ্রেণিরই সৃষ্টি। তারাই দেশকে ভুলপথে পরিচালিত করে এখানে এনেছে। বাংলাদেশ এখন তারুণ্যে ভরপুর। উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ এখন দ্বারে করাঘাত করছে। দ্রুতই তা ফুরিয়ে গিয়ে বৃদ্ধদের দেশে পরিণত হবে। সময় এসেছে, জাতির কল্যাণে সাহসিকতার সঙ্গে কিছু অজনপ্রিয় কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার। পাসের উচ্চহার নয়, চাই বৈশ্বিক মানের শিক্ষা।
আমিরুল আলম খান : শিক্ষাবিদ; সাবেক চেয়ারম্যান যশোর শিক্ষা বোর্ড