পাঠ্যপুস্তকের বোঝা ও শ্রেণিকক্ষের ভীড় কমিয়ে ফেলুন - দৈনিকশিক্ষা

পাঠ্যপুস্তকের বোঝা ও শ্রেণিকক্ষের ভীড় কমিয়ে ফেলুন

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

আমাদের শিক্ষার মান নিয়ে কতো কথা শুনতে হয় । বিশ্বের নানা দেশে আমাদের শিক্ষা আজ তার গ্রহণযোগ্যতা অনেকটা হারিয়ে ফেলেছে । এমনকি আমাদের নিজ দেশে ও শিক্ষার মান নিয়ে নানা কথা উঠছে বিভিন্ন মহলে । আমাদের দেশে বি,এ কিংবা এম,এ পাস করে বিদেশ গিয়ে কতোজনে দারোয়ানের কাজ করে, তার হিসেব কে রাখে ? এ ক’বছরে আমাদের শিক্ষার মানের অধঃপতন ঘটেছে অকল্পনীয়ভাবে ।

আমাদের সিলেবাস, কারিকুলাম, পাঠ্যবই এমনকি পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই । আমাদের দেশে এম,এ পাস করে ও অনেকে ইংরেজিতে দু-চারটে কথা বলতে পারেন না । অথচ আমাদের প্রতিবেশী ভারতে সেকেন্ডারি পাস করে প্রায় সকলে অনর্গল ইংরেজি বলতে পারে । আমাদের শিক্ষিত জনশক্তি বিদেশে পানির মত সস্তা অথচ ভারত, পাকিস্তান কিংবা ফিলিপাইনের জনশক্তির সারা দুনিয়া জুড়ে কতো না চাহিদা ! আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠি বিদেশে কেবলি বেগার খাটে । এ সবের একমাত্র কারণ আমাদের শিক্ষার মানের ক্রমাবনতি এবং কারিগরি জ্ঞানের অভাব ।

আমাদের বর্তমান শিক্ষিত প্রজন্মের ছেলে পিলেরা কী রকম ভাবে যেন বেড়ে উঠছে ! বড়দের সম্মান কিংবা ছোটদের স্নেহ করতে তেমন একটা অভ্যস্ত নয় তারা । গরীব-দুঃখী মানুষের কষ্ট তাদের হৃদয়ে নাড়া দেয় না । নিজেদের বাবা-মা ও শিক্ষকদের প্রতি তাদের উদাসী মনোভাব । মানবতা ও মানবপ্রেমের শিক্ষাটুকু তারা পাচ্ছে না যেন ।ইদানিং তাদের হাতে থাকে সারাক্ষণ ভিন্ন ভিন্ন মডেলের মোবাইল সেট । তারা বিলক্ষণ ফেসবুক , মেসেঞ্জার , ইমো , ভাইবার , ইউটিউব, গুগলে লেগে থাকে । মুখের দাঁড়ি আর মাথার চুলে তাদের যত ঢং। বই পুস্তকের প্রতি তাদের কেমন এক অনীহা !

কেন আমাদের শিক্ষার মান দিনে দিনে কমে যাচ্ছে ? আমাদের শিক্ষার ভবিষ্যত এতো অন্ধকার বলে মনে হয় কেন ? কেন আমাদের শিক্ষার্থীরা কোন কিছু না শিখে কেবল পরীক্ষা পাস করছে বলে আমাদের মনে হয় ? এ সবের কারণ এখনই খুঁজে বের করার উপযুক্ত সময় নয় কী ?

লেখাপড়া করে একটা চাকরী জুটানো মূল টার্গেট হয়ে দাঁড়িয়েছে । শিক্ষার উদ্দেশ্য যেন আজ আর মানুষ হওয়া নয় । চাকুরীর সুবাদে ঘুষ বাণিজ্য করে সহজে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হবার আকাঙ্খা অনেকের ।কোন কোন শিক্ষক যখন শিক্ষাকে পণ্য বানিয়ে কোচিং সেন্টারে কিংবা নোট-গাইড বাণিজ্যে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন , তখন তার ছাত্রটি সবকিছুতে বাণিজ্যের গন্ধতো পাবেই । বেচারা শিক্ষককেই দোষ দেই কী করে ? সৎ ভাবে খাওয়া পরার ব্যবস্থা না থাকলে অসৎ পথে যে কেউ পা তো বাড়াবেই । স্ত্রী-সন্তান, পরিবার-পরিজন নিয়ে ভাল ভাবে বেঁচে থাকার প্রত্যয় নিয়ে সকলেই জীবনযাত্রা শুরু করে ।

আমাদের শিক্ষার্থীদের অনেক গুলো বিষয়ের অনেক বই পড়তে হয় । পাঠ্যপুস্তকের ভারে জর্জরিত তারা । তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে মূল বিষয় ছয়টি করে । অষ্টম শ্রেণিতে মূল বিষয় এগারোটি । চারু-কারু কিংবা সঙ্গীত জাতীয় বিষয় তো আরো আছেই । প্রতিটি বিষয়ে আবার নোট-গাইড লাগে । নোট-গাইড ছাড়া লেখাপড়া চলেনা । আমাদের অনেক শিক্ষক পর্যন্ত নোট- গাইড নির্ভর । নোট-গাইডের দেয়াল টপকানো আজ বড় কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে । এটি আমাদের শিক্ষাকে একদম কুরে কুরে খেয়ে ফেলছে । আমাদের শিক্ষা আজ জাহান্নামে যাচ্ছে কেবল নোট-গাইডের কারণে । এ সব নোট-গাইড বুঝি বন্ধ করবার শক্তি কারো নেই ? সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির শুভ উদ্যোগটি নোট গাইডের কারণে গোল্লায় যেতে বসেছে । নোট-গাইড বন্ধ থাকলে এতোদিনে আমরা সৃজনশীলের সুফল পেতে শুরু করতাম ।

আমাদের এ প্রজন্মকে বই-ভীতি বহু আগে পেয়ে বসেছে । সিলেবাস ও কারিকুলামে সঙ্গতি কম । বয়স , রুচি ও মেধার সাথে বিষয়বস্তুর মিল নেই। নৈতিক শিক্ষার ঘাটতি প্রকট । এর ওপর বইয়ের বোঝা । বয়স অনুপাতে বই বেশী । পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত তিনটি এবং অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঁচটি বই হলে যথেষ্ট হতো । আমাদের শিক্ষায় উল্টো কারবার । উচ্চতর শ্রেণিতে বিষয় ও বই কম কিন্তু নিম্নতর শ্রেণি গুলোতে পুস্তকের বহর । আমাদের কারিগরি শিক্ষা বা হাতে কলমে শেখার সুযোগ একেবারে কম । সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আজকাল তেমন লাভ নেই ।

কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হলে দেশে বেকারত্ব বাড়ার আশংকা থাকে না । আমাদের সাধারণ শিক্ষা কমিয়ে কারিগরি ও আইসিটি শিক্ষার ওপর জোর দিলে আমাদের জাতি লাভবান হবে । দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর চীন , জাপান প্রভৃতি দেশ কয়েক বছর সাধারণ শিক্ষা বন্ধ করে দিয়ে তাদের দেশে কেবল কারিগরি শিক্ষা চালু রেখেছিল । ফলে মাত্র কয়েক বছরে তারা শিল্প কারখানায় প্রভূত সাফল্য অর্জন করে । তাদের প্রতিটি পরিবার এক সময় হয়ে ওঠে একেকটি মিনি কারখানা । আজ তাই সারা দুনিয়া জুড়ে চীন ও জাপানের উৎপাদিত জিনিসপত্রের একচেটিয়া বাজার ।

আমাদের স্কুল , কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে শিক্ষার্থীদের উপচে পড়া ভীড় । শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাতে আকাশ-পাতাল ব্যবধান । আমাদের লোকসংখ্যা বেড়েছে অনেক। লেখাপড়ায় আমাদের জনসাধারণের আগ্রহ ও এখন প্রচুর । সরকার বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক ও উপবৃত্তি দেয় । তাই এখন প্রত্যেক বাবা-মা সন্তানকে স্কুলে পাঠায় । এ জন্য আজকাল একেকটা শ্রেণিতে ন্যূনতম শিক্ষার্থী সংখ্যা দেড় থেকে দু’শয়ের কম নয় । মাত্র ক’বছর আগে আমাদের স্কুলগুলো শিক্ষার্থী সমস্যায় জর্জরিত ছিল । আজ সে দূর্দিন আর নেই । নতুন স্কুল খুললে মাত্র দু’ বছরে শিক্ষার্থীতে ভরে যায় ।

ইদানিং আমাদের শ্রেণিকক্ষ গুলোর আয়তন বাড়তে বাড়তে এমন হয়েছে যে, একসাথে তিন-চারজন শিক্ষক মিলেও একটা শ্রেণি চালানো কঠিন । এ ক্ষেত্রে একজন শিক্ষক শ্রেণিতে একান্তই অসহায় ও নিরুপায়। আমাদের তো বেশ ক’বছর ধরে এ ভাবেই চলছে । শিক্ষকঃশিক্ষার্থী কমিয়ে আনার কোন উদ্যোগ নেই । অতিরিক্ত শ্রেণি শাখা খোলার সুযোগ কোথায় ? অনুমতি মিললেও অতিরিক্ত শ্রেণি শাখা শিক্ষের বেতন নেই । এ ভাবে চলে কী করে ? নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলে কী হবে ? পাঠের অনুমতি, স্বীকৃতি পেতে পেতে কতকাল পেরিয়ে যায় ।

আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতে স্কুল-কলেজ গড়ে ওঠে নাই । স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের উপচে পড়া ভীড় । পর্যাপ্ত শিক্ষক আর শ্রেণিকক্ষ নেই । শ্রেণিকক্ষে সিনেমা হলের দর্শকদের মতো উপচে পড়া ভীড় । শ্রেণি কক্ষগুলো হলরুমে রুপান্তরিত আজ । একটি শ্রেণিকক্ষে একজন শিক্ষক সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৫০ জন শিক্ষার্থীকে পাঠদান করতে পারেন । এর বেশী হলে পাঠদান কী করে সম্ভব? একত্রে দেড়-দু’শ শিক্ষার্থীর সাথে গল্প গুজব করে সময় কাটানো যায়, এর বেশি কিছু নয় । আমাদের দেশে তা-ই হচ্ছে আজকাল ।

আমাদের দেশের শিক্ষাকে বিশ্বমানে উন্নীত করতে হলে আমাদের শিক্ষার্থীদের পুস্তক-ভীতি দূর করতে হবে । এ জন্য অনাবশ্যক বই পুস্তক ও নোট-গাইড অবিলম্বে বন্ধ করা অপরিহার্য । কারিগরি ও আইসিটি শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে । শ্রেণিকক্ষের অনাকাঙ্খিত চাপ কমাতে হবে । আর সেই সাথে শিক্ষা জাতীয়করণের বিষয়টি মাথায় রেখে তা বাস্তবায়নের সত্ত্বর কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে । অন্যথায় আমাদের শিক্ষাকে বাঁচানো কঠিন হবে ।

লেখক : অধ্যক্ষ , চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ।

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036671161651611