মাদ্রাসার কয়েকটি পাঠ্যপুস্তক ও এর সহায়ক হিসেবে লেখা পাঁচটি প্রকাশনীর গাইড বইয়ে জঙ্গিবাদ উসকে দেওয়ার এবং অপব্যাখ্যা করার মতো লেখা রয়েছে। সাধারণ শিক্ষার কোনো কোনো বইয়েও জিহাদ সম্পর্কে এমনভাবে লেখা রয়েছে, যা সঠিক নয় বলে মনে করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এনসিটিবির এক যাচাই প্রতিবেদনে এসব তথ্য রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ওই যাচাই করা হয়। গত বুধবার প্রতিবেদনটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনসিটিবির সদস্য রতন সিদ্দিকী। এনসিটিবির সূত্র বলেছে, প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত যেসব পাঠ্যপুস্তকে জঙ্গিবাদ-সংশ্লিষ্ট বিষয় থাকতে পারে বলে অনুমিত, তেমন ৩০টিরও বেশি পাঠ্যপুস্তক এনসিটিবি কমিটি গঠন করে যাচাই করেছে। যাচাইয়ে কয়েকটিতে উসকানিমূলক ও অপব্যাখ্যা করার মতো তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশও করা হয়েছে। এখন মন্ত্রণালয় পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ জমিয়াতুল উলামার সভাপতি ও শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দীন মাসঊদ বলেন, জিহাদ সম্পর্কে শিশুপর্যায়ের বইগুলোতে যেভাবে বলা হয়েছে, তা কোনোভাবেই হওয়া উচিত নয়। শিশুর মানসিকতা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকার কারণেই এমনটি হয়েছে। এ জন্য তিনি এনসিটিবিসহ যাঁরা এসব পাঠ্যপুস্তক তৈরির সঙ্গে জড়িত, তাঁদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এনসিটিবির প্রতিবেদনে বলা হয়, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক ‘আল আকায়েদ ওয়াল ফিকহ’-তে জঙ্গিবাদ ও জিহাদ-সংশ্লিষ্ট বিষয় রয়েছে। পুস্তকের ৩৯ নম্বর পৃষ্ঠায় সশস্ত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে, যা থেকে অপব্যাখ্যার সুযোগ রয়েছে। মাদ্রাসার নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক ‘কুরআন মাজিদ ও তাজভিদ’-এ একটি পৃষ্ঠায় জিহাদ নিয়ে যা বলা হয়েছে তা সঠিক কি না, তা যাচাই হওয়া প্রয়োজন।
সাধারণ শিক্ষার নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’-তে ‘জিহাদ’ নামে পাঠ রয়েছে। তাতে জিহাদের সর্বোচ্চ স্তর নিয়ে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তা সঠিক হয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এনসিটিবি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড প্রণীত ও প্রকাশিত পাঠ্যপুস্তকে থাকা জিহাদ-সংশ্লিষ্ট পাঠের ভিত্তিতে রচিত বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের গাইডগুলোতে এমন কিছু ‘উদ্দীপক’ বা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, যা থেকে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা জঙ্গিবাদে উৎসাহিত হতে পারে। মাদ্রাসা বোর্ডের পাঠ্যপুস্তকের ভিত্তিতে গাইড লেখার কাজে জড়িত লেখকদের মধ্যে কেউ কেউ থাকতে পারেন, যাঁরা নিজেরাই জঙ্গিবাদী মানসিকতা ধারণ করছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আল ফাতাহ পাবলিকেশন, আল ফালাহ পাবলিকেশনস, ইসলামিয়া পাবলিকেশনস, ইসলামিয়া কুতুবখানা, আল ইসলাম প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত গাইড ও বইয়ে জিহাদ বিষয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেখান থেকে জঙ্গিবাদ উসকে যেতে পারে।
অবশ্য মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান এ কে এম ছায়েফ উল্ল্যাহ দাবি করেন, মাদ্রাসার পাঠ্যবইয়ে জঙ্গিবাদ উসকে দেওয়ার মতো লেখা নেই। তিনি বলেন, এরপরও যাতে কোনো লেখার কারণে শিশুদের মনে উসকানির সৃষ্টি না হয়, সে জন্য বইগুলো পরিমার্জন করে সুপারিশ এনসিটিবির কাছে দেওয়া হচ্ছে; যাতে ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীরা পরিমার্জিত বই পায়। ২০১৭ সালের বই ছাপার কাজ এখন শেষ পর্যায়ে। এ ছাড়া কোন গাইডে কী লেখা হয়েছে তা দেখার দায়িত্ব মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের নয়।
সুপারিশ: এনসিটিবির প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে, কোনটি জিহাদ আর কোনটি জঙ্গিবাদ তা পাঠ্যপুস্তকগুলোতে স্পষ্ট করা হয়নি। তাই বিষয়টি স্পষ্ট করে ২০১৮ সালের শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ করা দরকার। এ ছাড়া পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের (শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক ও প্রশ্নপত্র প্রণয়ন) কাজে বিশেষজ্ঞ নির্ধারণে সতর্কতা অবলম্বন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ ও দেশপ্রেমিক লেখক প্যানেল তৈরি করা, মাদ্রাসা বোর্ড প্রণীত পাঠ্যপুস্তকে জিহাদ-সংশ্লিষ্ট পাঠ পুনর্লেখন, জিহাদ ও জঙ্গিবাদ এক বিষয় নয়—এমন অধ্যায় সংযোজন, জঙ্গিবাদ উসকে দেয় বা শিক্ষার্থীকে জঙ্গিবাদে প্ররোচিত করে এমন গাইডগুলো বাজার থেকে প্রত্যাহার, এ ধরনের কাজে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের চিহ্নিত করে পাঠদান থেকে বিরত রাখার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া যেসব প্রকাশনী সচেতনভাবে জঙ্গিবাদকে উসকে দেওয়ার মতো বিষয় গাইড বা পাঠ্যপুস্তকে সংযুক্ত করেছে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশও করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খান বলেন, শিশুদের কাছে ছাপা বিষয় ভুল মনে হয় না। তাই এসব বিষয় উল্লেখ করতেই হলে খুবই চিন্তাভাবনা ও সতর্ক হয়ে করা উচিত। না হয় অপব্যাখ্যার সুযোগ থাকে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রুহী রহমান বলেন, এখনো তাঁরা প্রতিবেদনটি হাতে পাননি। হাতে পাওয়ার পর এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সূত্র: প্রথম আলো।