গত বছরের ১৪ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছিল। একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে এক্ষেত্রে কিছু মতামত তুলে ধরতে চাই।
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার অন্যতম প্রধান যুক্তি হচ্ছে পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের সময়, শ্রম ও অর্থ সাশ্রয়। শিক্ষার মানোন্নয়ন কিন্তু এক্ষেত্রে মানদণ্ড নয়। শুধু সামান্য কয়েকটি দিন সাশ্রয় ও কয়েক হাজার টাকা বাঁচানোর জন্য প্রচলিত কার্যকর একটি পদ্ধতি থেকে আরেকটি পদ্ধতিতে যাওয়া কোনো যৌক্তিক কথা হতে পারে না। পরীক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারাটাও কিন্তু বড় একটি বিষয়। সুতরাং, সময় ও অর্থ সাশ্রয়ই যদি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করার প্রধান যুক্তি হয়ে থাকে, তা কিন্তু ধোপে টেকে না। বিশ্বায়নের এই যুগে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা যখন উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপ আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে সেখানে দেশের মধ্যেই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাতায়াতে সামান্য অসুবিধার বিষয়টিকে ফোকাস করে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করার যুক্তি কতটুকু যৌক্তিক তা ভেবে দেখা দরকার।
এছাড়াও দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমধর্মী নয়। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। পাঠ্য বিষয়গুলোতেও রয়েছে অনেক বৈচিত্র্য। তাছাড়া সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং করতে হবে, যা অত্যন্ত জটিল বিষয়। এক ধরনের প্রশ্নপত্র দিয়ে সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়াটাও এই পদ্ধতি চালু করার প্রধান অন্তরায়। ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কোন বিশ্ববিদ্যালয় প্রণয়ন করবে সেটা নিয়েও জটিলতা দেখা দিতে পারে।
অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে মেডিক্যাল কলেজগুলোতে যদি সমন্বিতভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া যায় তাহলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কেন নয়? মেডিক্যাল কলেজগুলোর পড়াশোনার ধরন, সিলেবাস সমধর্মী হওয়াতে সমন্বিতভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া গেলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলায় সে সুযোগ খুবই কম। আর ফি বছর সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোর ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টিও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। দশ থেকে বিশ লক্ষ টাকার বিনিময়ে মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন বেচাকেনার বিষয়টি ওপেন সিক্রেট বিষয়ে পরিণত হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় নানা পদক্ষেপ নিয়েও প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে পারছে না। তাই সামান্য কিছুটা ভোগান্তি লাঘব করতে গিয়ে পুরো ভর্তি প্রক্রিয়া বিষয়টিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না।
সর্বোপরি, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতিতে একজন পরীক্ষার্থী মাত্র একবারই পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাবেন। যেখানে বর্তমানে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা আলাদা পরীক্ষা হওয়াতে একজন কয়েকবার পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পান। এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পেলেও অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ থাকে যা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা চালু হলে থাকবে না। বরং তাড়াহুড়ো করে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করলে দুর্নীতি ও কোচিং সেন্টারের দৌরাত্ম্য আরো বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যা ইতোমধ্যে মেডিক্যালে ভর্তির ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
পরিশেষে, প্রচলিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতিকে আরো কার্যকর করার জন্য কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হলো—
১) সময় বাঁচানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একই দিনের সকাল-বিকেলে পরীক্ষা নিতে পারে।
২) অর্থ সাশ্রয়ের জন্য নামমাত্র মূল্যে অথবা বিনামূল্যে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
৩) উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে ও প্রচলিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতিকে আরো কার্যকর করার জন্য উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন করা যেতে পারে।
প্রচলিত ভর্তি পরীক্ষার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তা মন্দের ভালো। কিন্তু মাথা ব্যথা হলে ওষুধ না দিয়ে মাথা কেটে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। রাতারাতি কোনো পদ্ধতি চাপিয়ে না দিয়ে বরং দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা করেই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের মতো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত হবে।
লেখক : সাবেক শিক্ষার্থী, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়