এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীগণ আর কত না পাবার বেদনায় জর্জরিত হবেন ? আর কত দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলতে হবে তাদের ? জাতীয় বেতন স্কেলের অন্তর্গত আর কে আছে – যে ইনক্রিমেন্ট ও বৈশাখি ভাতা আজ পর্যন্ত পায় নাই ? জানা মতে , কেউ আর বাকী নেই । সকলেই পেয়ে গেছে।
কেবলি না পাবার যন্ত্রণা সহ্য করে বেঁচে থাকা একটি সম্প্রদায় হচ্ছেন দেশের বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীগণ ।
আমাদের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছেন এরাই । দেশের পঁচানব্বই শতাংশ স্কুল-কলেজ তারা চালান । শতকরা আটানব্বই জন শিক্ষার্থী তাদের কাছে পড়াশুনা করে । জাতির যে কোন প্রয়োজনে তারা থাকেন সামনের কাতারে ।
জেএসসি , এসএসসি ও এইচএসসি’র মতো তিনটি পাবলিক পরীক্ষা সামাল দিয়ে থাকেন তারা । জাতীয় সকল নির্বাচন অনুষ্ঠানে সর্বাগ্রে ডাক পড়ে এই শ্রেণির শিক্ষকগণের । আমাদের এ গ্রাম প্রধান দেশে এমপিওভুক্ত বেশীর ভাগ শিক্ষক গ্রামাঞ্চলে বসবাস করেন । গ্রামে সুখ ও শান্তিময় সমাজ এরাই গড়ে তোলেন । শিক্ষকেরাই গ্রামীন সমাজে সকলের কাছে মান্য গন্য হন । ঝগড়া-বিবাদ মীমাংসা ও সালিশ বৈঠকে সর্বাগ্রে ডাক পড়ে শিক্ষকের । খেয়ে না খেয়ে পরের সন্তানকে নিজের সন্তানের মত পরম স্নেহে মানুষ করার প্রত্যয়ে এগিয়ে চলে জীবন তাদের । এ করে করে অনেকের এখন কেবল পেশা নয়, শিক্ষকতা হয়ে উঠেছে পরম এক নেশার বিষয় ।
কিন্তু, হলে কী হবে ? একজন বেসরকারি শিক্ষক মানে এক সাগর বঞ্চনা নিয়ে বেঁচে থাকা একজন মানুষ । ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত এক অতি ভদ্র ও নীরিহ মানুষের প্রতিচ্ছবি । নিজের সন্তান-সন্ততি ও পরিবার পরিজন নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে কেবলি হেঁটে চলা একজন অসহায় মানুষের আকুতি । এরা ভাষাগত পুরস্কারে অহর্নিশ ভূষিত হন । কত সালাম ও সম্মান পান বলে কেউ কেউ খোটা আর খোচা দু’টোই দেয় । সালামে কী পেট ভরে কারো ? হায় বেসরকারি শিক্ষক ! হায় পোড়া কপাল এদের ! বেসরকারি স্কুল-কলেজের কর্মচারীদের কথা বলি । তাদের সালাম কিংবা শ্রদ্ধা ক’জনে করে? ‘পিয়ন’ বা ‘চৌকিদার’ বলে কতজনে উপহাস করে তাদের । সবাই দশটায় কাজ শুরু করলে ও তাদের কাজ আরো আগে শুরু হয় নিত্যদিন । স্কুল-কলেজের সবাই ছুটি হলে যার যার বাড়ি চলে যায়। কিন্তু, এরা সবকিছু গুছিয়ে রেখে আরো অনেক পরে প্রায় সন্ধ্যে হলে বাড়ি ফেরে । শিক্ষকগণ ভাষাগত মৌখিক সম্মানে ভূষিত হলে ও তাদের সেটুকু ও নেই । ভাগ্যিস, কী করে একবার সরকারের সুনজর পড়েছিল এদের ওপর । তাই এরা নিজের বেতন স্কেলের ৫০% উৎসব বোনাস (!) পেয়ে যাচ্ছে আজ ও । সারাদিন খাটুনি খেটে এবং ঘন্টা পিটিয়ে এরা নিজের জীবনের বঞ্চনার করুণ কাহিনী ক’জনকে জানান দিতে পেরেছে ? তাদের নিয়ে কে ভাবে ? তাদের শিক্ষকদের নিয়ে সরকারের কোন ভাবনা নেই। আর তাদের কথা ? বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা এতই বেদরকারি বুঝি !
সবার আগে তাদের ইনক্রিমেন্ট ও বৈশাখি ভাতা দিয়ে দেয়াই সমীচিন ছিল । সকলের সাথে দিয়ে শিক্ষকদের সম্মান জানাবার সুযোগটা নিতে পারত ওরা । ওরা শিক্ষা ও শিক্ষক বিদ্বেষী আমলা । নতুন জাতীয় স্কেলে শিক্ষক-কর্মচারীদের অন্তর্ভুক্ত করার সময় ওদের টালবাহানা ও অহেতুক কাল ক্ষেপন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি । এ ক্ষেত্রে ও আবার সে একই আলামত স্পষ্ট ।
৫% ইনক্রিমেন্ট এবং বৈশাখি ভাতা এ দেশের পাঁচ লাখ এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীর প্রাণের দাবী- ন্যায্য অধিকার । এ দাবী দু’টি পুরণ করা না হলে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হবে । তর্জনে-গর্জনে, বর্ষণে-বজ্রপাতে ধরণী চুরমার হবে ।
এখন ফেব্রুয়ারি । বাঙ্গালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামের শপথ নেবার মাস । আসছে বোশেখ । বজ্রপাত-বজ্রাঘাত আর বিদ্যুতের চমকে অস্থির হবে আমাদের আবহাওয়া । নতুন বৃষ্টির ছোয়ায় ধরণী সাফ-সুন্দর হবে ।চাকচিক্যময় হয়ে ওঠবে আমাদের বসবাস ।
একদিন না একদিন অবসান হবে সব বঞ্চনা আর বৈষম্যের ।প্রবৃদ্ধি আর বৈশাখী ভাতা একদিন এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের দিতেই হবে । আমাদের জাতির জনক একটি বঞ্চনা ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ চেয়েছিলেন । শিক্ষায় তার সে স্বপ্নটা আরো বেশী মাত্রায় ছিল । সে স্বপ্ন পূরণের দায় আমার , আপনার এবং সবার । ‘শীঘ্রং শুভঃ’। যত শীঘ্র, তত মঙ্গল ।
[অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী: চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ও দৈনিকশিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।]