প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন প্রসঙ্গে - দৈনিকশিক্ষা

প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন প্রসঙ্গে

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

শিক্ষার্থীর অর্জিত জ্ঞান বা মেধা যাচাইয়ের জন্য পৃথিবীর সকল দেশেই পরীক্ষা পদ্ধতি প্রচলিত । জ্ঞান বা মেধা যাচাই করার জন্য এর চেয়ে ভাল অন্য কোন উপায় আজ পর্যন্ত আবিস্কৃত হয়নি । তবে পরীক্ষার ধরণ ও কলা কৌশল সব দেশে এক রকম নয় ।

পরীক্ষার সাথে যে বিষয় গুলো একান্ত অপরিহার্য ভাবে সম্পৃক্ত,সেগুলোর মধ্যে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও উত্তরপত্র মূল্যায়নের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও উত্তরপত্র মূল্যায়নে সর্বাপেক্ষা অগ্রাধিকার প্রদান করতে হয় । প্রশ্নপত্রের গ্রহণযোগ্যতা ( Validity) এবং উত্তরপত্র মূল্যায়নের যথার্থতা (Reliability) নিশ্চিত করতে না পারলে পরীক্ষার কোন অর্থ থাকে না । দূর্ভাগ্য বশতঃ আমাদের দেশে পরীক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আজ নানা কথা উঠছে । বিশেষ করে আমাদের প্রশ্নপত্রের ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং যেনতেন ভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়ণের কারণে পরীক্ষা নিয়ে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্ঠি হচ্ছে ।

প্রশ্নপত্র প্রণয়ন একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজ । এ কাজটি যদি যথাযথ ভাবে সম্পাদন করা না হয়, তবে পরীক্ষা গ্রহণ বা আয়োজনের কোন মানে থাকে না । আমাদের শিক্ষার সব স্তরে দু’ ধরণের পরীক্ষা নেয়া হয় । একটি আভ্যন্তরীণ এবং অন্যটি চূড়ান্ত বা ফাইন্যাল পরীক্ষা । আভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় তো বটে, ফাইন্যাল পরীক্ষায় পর্যন্ত দায়সারা গোছের প্রশ্ন আমাদের পরীক্ষা ব্যবস্থাকে দিন দিন যেন অর্থহীন করে তুলছে ।

আমাদের বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্নের কলেবর আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে । উদাহরণ স্বরুপ, শিক্ষা জীবনের প্রথম ও প্রারম্ভিক পরীক্ষা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর প্রশ্নপত্রের দিকে আলোকপাত করা যায় । এতে মোট ছয়টি বিষয় । প্রশ্নপত্রের সাইজ ও আকার এসএসসি কিংবা এইচএসসি’ র প্রশ্নপত্রের চেয়ে কোন অংশে কম নয় । প্রতিটি বিষয়ের প্রশ্নপত্রে চারটি করে পৃষ্ঠা। প্রতিটি পৃষ্ঠা নানা ধরণের প্রশ্নে (সৃজনশীল, গতানুগতিক,বহুনির্বাচনি,শুন্যস্থান পূরণ,সত্য মিথ্যা, seen, unseen আরো কত কী ! ) ভরা । ইংরেজি,গণিত,বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ের প্রশ্নের স্টান্ডারিটি (!) কোন অংশে আগেকার এন্ট্রান্স কিংবা প্রবেশিকা পরীক্ষার চেয়ে কম নয় । কোন কোন বিষয়ের প্রশ্নপত্রের আকারের চেয়ে উত্তরপত্রের আকার ছোট হয়ে থাকে । উদাহরণ স্বরুপ-প্রাথমিক,মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ইংরেজি বিষয়ে অনেক ক্ষেত্রে পাঁচটি word লিখে পাঁচ নম্বর পাওয়া যায় । মাত্র কয়েকটি sentence এবং কয়েকটি word লিখলে grammar কিংবা seen/unseen portion কাভার হয়ে যায় । আবার এ সব ক্ষেত্রে কোন কোন প্রশ্নের উত্তরের জন্য clue দেয়া থাকে বলে এ সবের উত্তর খুঁজে বের করতে শিক্ষার্থীদের কোন কষ্ট হয় না । কোন কোন সময় একজনে পারলে কক্ষ পরিদর্শককে ফাঁকি দিয়ে দশজনের কাছে সে উত্তর চলে যায় । বহুনির্বাচনী (MCQ)’র বেলায় ও প্রায়শঃই তাই ঘটে যাবার সুযোগ ও সম্ভাবনা থাকে । সৃজনশীলের প্রতিটি প্রশ্নের ক,খ,গ ও ঘ- মোট চারটি অংশে যথাক্রমে ১,২,৩ ও ৪ নম্বর করে মোট ১০ নম্বর। তাতে কেবল ক-এর উত্তর সঠিক না হলে কেটে ০ (শুন্য) নম্বর দেবার অবকাশ থাকে । অন্যগুলোর উত্তর যেনতেন করে লিখলে ও কম করে ১ নম্বর না দিয়ে পারা যায় না । এভাবে প্রতিটি প্রশ্নে কম করে ৩ নম্বর পাবার সুযোগ এক রকম উন্মুক্তই বলা যায় । ফলে কম পড়াশুনা করে ও পরীক্ষা পাসের অবারিত সুযোগ । পরীক্ষার কারণে জ্ঞানার্জনের সুযোগ প্রসারিত না হয়ে তা কেবলি সংকুচিত হলে জাতির ভবিষ্যত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে-সে কেবল ভবিতব্যই জানে । প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করার সময় এর নীতিমালা সমূহ কতটুকু অনুসরণ করা হয় – সে আরেক বিরাট প্রশ্ন । নোট-গাইড থেকে অনেক সময় হুবহু প্রশ্ন উঠিয়ে দেয়া হয় । প্রশ্নপত্র প্রণয়নে বিষয় ভিত্তিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ করা প্রয়োজন । প্রশ্ন প্রণয়ন নিঃসন্দেহে এক কঠিন কাজ । যাকে ইচ্ছে তাকে দিয়ে এ কাজ করানো ঠিক হয় না । অনুরুপ, প্রশ্নপত্র যারা পরিশোধন করেন তাদের আরো বেশী অভিজ্ঞ ও দক্ষ হওয়া চাই । এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন প্রণয়নকারী ও মডারেটরদের জবাবদিহিতা দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত করা আবশ্যক ।

আমাদের পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে পরীক্ষকদের অতি উদার হবার বিষয়ে নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন । পরীক্ষার খাতায় যা তা লিখলেই যদি পাস নম্বর দিয়ে দেয়া হয়, তা হলে এতো টাকা অপচয় করে পরীক্ষা অনুষ্ঠানের কোন মানে থাকে না । এক সময় মাতৃ ভাষায় তিনটি শব্দের বানান ভুল হলে এক নম্বর কর্তন করা হতো । আজ আর তা নেই।

পরীক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ও বিষয় ভিত্তিক দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক দেখে নিয়োগ দেয়া একান্ত অপরিহার্য । আজকাল অনেকের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা দু’-তিন বছর ও হয়নি, অথচ তারা বোর্ডের পরীক্ষক কিংবা প্রধান পরীক্ষক ! অবশ্য এ কয়েক বছরে আমাদের পরীক্ষার্থীর সংখ্যা এত বেশী বেড়ে গেছে যে,যাচাই-বাছাই করে পরীক্ষক নিয়োগ দিতে গেলে এত পরীক্ষক পাওয়া ও অনেক কঠিন । তাই বলে বিজ্ঞানের শিক্ষক চারু ও কারুকলার প্রধান পরীক্ষক কিংবা সমাজের শিক্ষক কৃষি শিক্ষা বিষয়ের প্রধান পরীক্ষক হলে তো চলে না । আমাদের কিন্তু হচ্ছে তাই ।

উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতে গিয়ে একজন পরীক্ষককে মূল্যায়নের কাজ ছাড়া ও বাড়তি কিছু কাজ করা লাগে।যেমন OMR এর অনেকগুলো বৃত্ত ভরাট করতে গিয়ে একজন পরীক্ষককে হিমসিম খেতে হয় । ফলে উত্তরপত্র মূল্যায়ন অপেক্ষা বৃত্ত ভরাটে শিক্ষকের বেশী মনযোগ দেবার প্রয়োজন দেখা দেয় ।

আমাদের পরীক্ষার্থীর সংখ্যা দিনে দিনে কেবল বেড়েই চলেছে । তাই, প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির আশু সংস্কার একান্ত অপরিহার্য হয়ে ওঠেছে। বিশেষ করে আমাদের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও উত্তরপত্র মূল্যায়নে যথাক্রমে গ্রহণযোগ্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করতে না পারলে পরীক্ষার যাবতীয় আয়োজন যেমন ব্যর্থ হবে, তেমনি আমাদের শিক্ষায় এর নেতিবাচক প্রভাব আরো বেশী পড়তে থাকবে ।

মুজম্মিল আলী: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ও দৈনিকশিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0035431385040283