আমার অনুজপ্রতিম শিক্ষাবিদ এবং সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক জাফর ইকবালকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। একা কথাটা বলার বা লেখার সাহস পাচ্ছিলাম না। দেশে স্কুল-কলেজের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, ফেসবুকে চলে আসাটা মহামারীর আকার ধারণ করেছে। কেউ তা ঠেকাতে পারছে না। কেমন করে ঠেকানো যাবে তাও কেউ বলতে পারছেন না। রব উঠেছে শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদের পদত্যাগ চাই। তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করলে প্রধানমন্ত্রী তাকে পদচ্যুত করুন। এই দাবির ব্যাপারে অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেছেন, মন্ত্রীর পদত্যাগ দ্বারা প্রশ্নপত্র ফাঁসের কেলেঙ্কারির অবসান অথবা সমস্যার সমাধান হবে না। এই সত্য কথাটি বলার জন্য তাকে আমি সাধুবাদ দেই।
বাংলাদেশ সত্যই হুজুগের দেশ। একটা হুজুগ উঠলেই সেই হুজুগে গলা মেলাতে লোকের অভাব হয় না। মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিটি জাতীয় সংসদে পর্যন্ত উঠেছে। তুলেছেন জাতীয় পার্টির (এরশাদ) এক সদস্য। তিনি হয়ত ভাবছেন, এই দাবিটি তুলে আগামী নির্বাচনের আগে নিজের পপুলারিটি আরো বাড়াতে পারবেন। নিশ্চিত হতে চান আগামী নির্বাচনেও তার জয় অনিবার্য হবে। কিন্তু এই সমস্যার সমাধান কী, তিনি নিজে শিক্ষামন্ত্রী হলে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন, তা বলতে পারেননি।
ভারতে একবার একটি ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা হয়। নেহেরু মন্ত্রিসভায় তখন রেলমন্ত্রী ছিলেন লালবাহাদুর শাস্ত্রী। এই দুর্ঘটনা রোধে ব্যর্থতার জন্য রেলমন্ত্রী শাস্ত্রীর পদত্যাগের দাবি ওঠে। যে পার্লামেন্ট সদস্য এই দাবি তুলেছিলেন, তাকে প্রধানমন্ত্রী নেহেরু জিজ্ঞাসা করেন, রেল দুর্ঘটনাটি ভয়াবহ সন্দেহ নেই। কিন্তু আপনি রেলমন্ত্রী থাকলে কিভাবে দুর্ঘটনাটি এড়াতেন, তা বলবেন কি? পার্লামেন্ট সদস্য নেহেরুর কথার জবাব দিতে পারেননি। নেহেরু তখন তাকে বলেন, এই দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান, এর পেছনে কোনো সাবোটাজ আছে কিনা তা না জানার আগে আমি শাস্ত্রীকে পদত্যাগের কথা বলতে পারি না। প্রধানমন্ত্রীর এ কথার পরেও লালবাহাদুর শাস্ত্রী পদত্যাগ করেছিলেন। তার আত্মমর্যাদাবোধ ছিল অসাধারণ। সেজন্যেই নেহেরুর মৃত্যুর পর তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে সংসদে ফিরে এসেছিলেন।
বাংলাদেশেও প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা কেলেঙ্কারিতে শিক্ষামন্ত্রীর এপিএস ও মন্ত্রকের কিছু অফিসার জড়িত বলে অভিযুক্ত হয়েছেন। এই কেলেঙ্কারি নিয়ে নানা গুজব পল্লবিত হচ্ছে। কিন্তু এ যাবত্ সরকারি তদন্তেও এই কেলেঙ্কারির মূল হোতা কারা তা জানা যায়নি এবং প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া অব্যাহত রয়েছে। এটা যদি আমাদের তদন্তকারী গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা বলে ধরে নেওয়া যায় তাহলে এই ব্যর্থতার দায়-দায়িত্ব কিছুটা আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের উপরেও কি বর্তায় না? এই ব্যাপারে কঠোর এবং ব্যাপক তদন্ত দরকার। তাতে যদি ধরা পড়ে এই কেলেঙ্কারিতে শিক্ষা মন্ত্রক জড়িত এবং শিক্ষামন্ত্রী তার মন্ত্রকের দোষী কর্মকর্তাদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণে অক্ষমতা বা ব্যর্থতা দেখিয়েছেন, তখন তাকে অপসারণের কথা উঠতে পারে।
আমার দেখে বিস্ময় লেগেছে, ব্যাপকভাবে পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই যে কেলেঙ্কারি যা বহুদিন যাবত্ অবাধে চলছে এবং চলতে থাকলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ও তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যত্ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে, তার প্রতিকার নিয়ে জাতীয় সংসদে বা সংসদের বাইরে আলোচনাকে আরও গুরুত্ব না দিয়ে কেবল শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ নিয়েই হুজুগে দাবি তোলা হচ্ছে। যেন শিক্ষামন্ত্রী বদল হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ভারতে রেলমন্ত্রী হিসেবে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর পদত্যাগের পরেও বড় এবং আরো ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা ঠেকানো যায়নি এবং সেজন্য পরবর্তী মন্ত্রীদের কেউ পদত্যাগ করেননি।
শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদের কাছে আমার অনুরোধ, এই কেলেঙ্কারি বন্ধ করার জন্য তিনি সরকারের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে মিলে তদন্তকে আরো ব্যাপক করে তুলুন। দোষী মনে হলে নিকটজনকেও রেহাই দেবেন না। জাতির কাছে তিনি প্রমাণ করুন, শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে তিনি ব্যর্থ নন। তিনি কঠোর হতে জানেন।
পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে যখন বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগে অর্থায়ন বন্ধ করে এবং অভিযোগের তীর ছোড়া হয় তত্কালীন যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী আবুল হোসেনের দিকে, তখনও কোনো প্রকার তদন্ত ও অনুসন্ধান ছাড়াই মন্ত্রীকে অপসারণের হুজুগে দাবি উঠেছিল। শেখ হাসিনা সেই হুজুগের কাছে মাথা নত করেননি। তিনি বিশ্বব্যাংকের অভিযোগকে মিথ্যা বলেছেন এবং মন্ত্রীকে তখনই অপসারণ করেননি। শেখ হাসিনার কথাই শেষ পর্যন্ত সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। ধরা পড়েছে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ মিথ্যা। এখন আমাদের অর্থমন্ত্রী পর্যন্ত বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের তখনকার বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ছিলেন একজন বাজে লোক, মিথ্যাবাদী এবং বদমায়েশ।
প্রশ্ন উঠতে পারে, শিক্ষামন্ত্রীর এপিএস, তার চারপাশের কিছু লোক যদি দুর্নীতির দায়ে ধরা পড়েন তাহলে সে দায় তিনি এড়াবেন কী করে? অবশ্যই তিনি দায় এড়াতে পারেন না। কিন্তু এ ব্যাপারে পরিস্থিতি ও নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে তিনি জনসাধারণের কাছে মুখ খুলতে পারেন, তিনি যদি মনে করেন তিনি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন, তাহলে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে পারেন। আমার কথা তাকে স্কেপগোট করে সরানো হলে বা পদত্যাগে বাধ্য করা হলে আসল সমস্যার সমাধান হবে না, যে কথা অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেছেন।
এই মুহূর্তের সমস্যা মন্ত্রী বদল নয়। মহামারীর মতো অবাধে প্রশ্নপত্র ফাঁসের যে রোগের বিস্তার ঘটছে, তাকে প্রতিরোধ করা। শিক্ষামন্ত্রীকেই এই ব্যাপারে আরো ব্যাপক ক্ষমতা ও দায়িত্ব দিতে হবে। আমার ধারণা প্রশ্নপত্র ফাঁস করার এই ব্যাপকতার পেছনে শুধু দুর্নীতি নয়, কূট-রাজনীতিও আছে।
হয়ত একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এর পেছনে কাজ করছে। শুধু অবৈধভাবে টাকা কামানো নয়, এর পেছনে রাজনৈতিক অভিসন্ধিও রয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী একজন ভালো মানুষ ও সত্ রাজনীতিক হিসেবে সমাজে পরিচিত। তাকে দুর্নীতির দায়ে কলঙ্কিত করতে পারলে গোটা সরকারেরই ভাবমূর্তি আরো নষ্ট করা যাবে। শিক্ষামন্ত্রীর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের এর সঙ্গে যুক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে বিস্মিত হব না। আমার আরো ধারণা, এই শক্তিশালী সিন্ডিকেটের ভেতরে এমন রাঘব বোয়ালেরা আছেন, পুলিশও যাদের গায়ে হাত দিতে সাহস পায় না। মন্ত্রী বদল সমস্যা নয়। সমস্যা হলো এই সিন্ডিকেট কী করে ভাঙা যাবে।
উপমহাদেশের রাজনীতির একটা বড় সমস্যা হলো, দেশে কোনো সংকট দেখা দিলে সমস্যার গোড়ায় হাত না দিয়ে সমস্যাটির দায় চাপানোর জন্য আমরা কতজন স্কেপগোট বা বলির পাঁঠা খুঁজি। তার ঘাড়েই সব দোষ চাপিয়ে সমস্যার সমাধানের কোনো ব্যবস্থা করি না। তাকে ঝুলিয়ে রাখি। একথা বাংলাদেশের ব্যাপারেও সত্য। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটা বড় ধরনের অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটে। এর সঙ্গে ব্যাংেকর তরুণ এবং দক্ষ গভর্নর ড. আতিউর রহমানের কোনো সংশ্লিষ্টতাই ছিল না। পরে তা-ই প্রমাণ হয়েছে। তিনি ঘটনাটি জানার সঙ্গে সঙ্গে লোক জানাজানির আগেই অপহূত অর্থ উদ্ধারে উদ্যোগী হন। কিন্তু তাকে সফল হতে দেওয়া হয়নি। এই অর্থ কেলেঙ্কারির জন্য তাকে স্কেপগোট বানিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। তাতে অর্থের কতটা উদ্ধার হয়েছে তা জানি না। কিন্তু আমরা একজন তরুণ ও দক্ষ ব্যাংক কর্মকর্তাকে হারিয়েছি।
এখন জনতা ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারিতে দেশে তোলপাড় শুরু হয়েছে। অভিযোগ, ‘একক গ্রাহকের ঋণসীমা অমান্য করে তাকে ৫ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।’ এই দুর্নীতিও একক কোনো ব্যক্তির নয়, একটি গোষ্ঠীর। এই গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ করার আগেই এক ব্যক্তিকে স্কেপগোট করার চেষ্টা হচ্ছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হয়েছে “অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাতই ব্যাংকটি শেষ করে দিয়েছেন।” ড. আবুল বারাকাত ওই সময় জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। আমার কথা, জনতা ব্যাংকের কেলেঙ্কারির জন্য না হয় ড. বারাকাতকে স্কেপগোট করা গেল, কিন্তু দেশময় এই যে ভয়াবহ দুর্নীতির বিস্তার, হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারির জন্য কাদের স্কেপগোট বানানো হবে? দেশময় এই অর্থনৈতিক সার্বিক দুর্নীতি ঠেকানোর দায়িত্ব কি সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের নয়? এই ব্যাপারে পদত্যাগ দাবি করতে হলে কার পদত্যাগ দাবি করা উচিত? প্রশ্নটির জবাব কে দেবে?
প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানোর জন্য ড. জাফর ইকবাল একটি পরামর্শ দিয়েছেন। বলেছেন, ‘এটা ঠেকানোর জন্য কেবল ইন্টারনেট বন্ধ করার কথা না ভেবে প্রশ্নপত্র ছাপার বিকল্প জায়গা খুঁজতে হবে।’ আমি তার কথার সঙ্গে একটি কথা যোগ করতে চাই। প্রশ্নপত্র ছাপার বিকল্প জায়গা হিসেবে আমাদের কাগজের মুদ্রা ছাপানোর মতো সিকিউরিটি প্রেস প্রতিষ্ঠা এবং তা ফাঁস না হওয়ার কঠোর ও নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থা করতে হবে। তার আগে ভাঙতে হবে এই অসাধু এবং জাতি ধ্বংসকারী দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে যারাই যুক্ত থাকুন, প্রশ্নপত্রের রচনাকারী শিক্ষক, মুদ্রক, বিতরণকারী কর্তৃপক্ষ, ছাত্র, অভিভাবক তাদের গ্রেফতার করে কঠিন শাস্তি দিতে হবে। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য প্রতি সমস্যায় স্কেপগোট খোঁজা হলে সমস্যার সমাধান হবে না।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী: একুশ গানের রচয়িতা ও নিবন্ধকার।