প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধে তরুণদের আকুতি - দৈনিকশিক্ষা

প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধে তরুণদের আকুতি

শরিফুল হাসান |

বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণদের আকুতি কে শুনবে? তরুণদের এই প্রশ্ন তোলার কারণ, সরকারি একটা চাকরির জন্য তাঁরা যখন তীব্র লড়াই করছেন, তখন একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস তাঁদের হতাশায় ডুবিয়ে দিচ্ছে।

এই তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হলো অগ্রণী ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষা। গত শুক্রবার সকাল-বিকেল এই পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সকালে পরীক্ষা শুরুর আগেই ব্যাপক হারে প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে পড়ে। তারপরও ফাঁস হওয়া সেই প্রশ্নপত্রেই অনুষ্ঠিত হয় পরীক্ষা। অবশ্য বিকেলের পরীক্ষাটি স্থগিত করা হয়েছে।

অগ্রণী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসারের ২৬২টি পদের বিপরীতে আবেদন করেছিলেন ২ লাখ ৩ হাজার পরীক্ষার্থী। অর্থাৎ, প্রতিটি পদের জন্য ৭৭৪ জন প্রার্থী। এমন তীব্র প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় যেখানে ১-২ নম্বরই ভাগ্য বদলে দেয়, সেখানে যদি পুরো প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়, তাহলে প্রতিযোগিতা করার সুযোগটা কোথায়?

শুধু অগ্রণী ব্যাংকই নয়, গত ২১ এপ্রিল জনতা ব্যাংকের নির্বাহী কর্মকর্তা পদের লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়েছে। এই পরীক্ষার প্রাথমিক বাছাই পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন আড়াই লাখ পরীক্ষার্থী। লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের পরও পরীক্ষা বাতিল না হওয়ায় বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ এই পরীক্ষা নিয়েছে। গত ২০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় কৃষি ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পদের নিয়োগ পরীক্ষা। তাতেও পৌনে দুই লাখ প্রার্থী অংশ নেন। ওই পরীক্ষা শেষেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ তোলেন পরীক্ষার্থীরা।

এই যে কয়েক শ পদের বিপরীতে লাখ লাখ আবেদনকারী, এই সংখ্যাই বলে দিচ্ছে বাংলাদেশে বেকারত্বের পরিস্থিতি কতটা তীব্র। ওয়াশিংটন পোস্ট-এ শুক্রবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে স্নাতক শেষ করা শিক্ষিত বেকারদের সংখ্যা খুবই বেশি। বিশ্বব্যাংকের ২০১৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে ৭৮ শতাংশ বেকার। আর এসব কারণেই বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণদের লেখাপড়া শেষ হওয়ার পর প্রধান স্বপ্ন হয় একটা চাকরি। প্রতি শুক্র ও শনিবার ঢাকার স্কুল-কলেজগুলোর সামনে গেলেই অবশ্য নিয়োগ পরীক্ষার্থীদের সেই যুদ্ধ দেখা যায়। লাখ লাখ আবেদনকারী, পদ সীমিত। এরপর আবার সরকারি চাকরিতে আছে ৫৫ শতাংশ কোটা।

গত ২ মার্চ একটি দৈনিকে ‘নিয়োগ পরীক্ষার খবর নেই, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ৩০ লাখ চাকরিপ্রার্থীর আবেদন’ শিরোনামে একটি সংবাদ ছাপা হয়। তাতে দেখা যায়, সোনালী, জনতা, অগ্রণী, কৃষি, রূপালীসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ৭ হাজার পদের বিপরীতে আবেদন পড়েছে প্রায় ৩০ লাখ। বেসরকারি চাকরিতে সীমিতসংখ্যক ছেলেমেয়ে ডাক পান বলে সবাই সরকারি চাকরির পরীক্ষা দেন। কিন্তু পিএসসি ছাড়া বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক প্রার্থীর মেধা যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশে কোনো কার্যকর প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। ফলে বেশির ভাগ নিয়োগ পরীক্ষা হয় এই আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে।

আউটসোর্স মানে, নিয়োগ পরীক্ষাগুলো নেবে আইবিএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ কিংবা ব্যাংকিং বিভাগ। বাংলাদেশ ব্যাংক এ জন্য দরপত্র ডাকে। একেকটি পরীক্ষা নেওয়ার জন্য দেড় থেকে দুই কোটি টাকা পায় বিভাগগুলো। আর সে কারণেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ তারা স্বীকার করতে চায় না।

অবশ্য এ দেশে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক সর্বত্রই প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়মিত বিষয়। ফলে এসব খবর আর মানুষকে আলোড়িত করে না। এর মধ্যেই নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠছে বারবার।

কয়েক বছর আগেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে নিয়োগপ্রক্রিয়া নিয়ে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ওঠে। এসব বন্ধ করে স্বচ্ছতা আনতে এবং একই মান রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চেয়ারম্যান করে ২০১৫ সালের শেষে গঠিত হয় ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি (বিএসসি)। কিন্তু দীর্ঘসূত্রতা, প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা অভিযোগে ইতিমধ্যেই এই প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে।

২১ এপ্রিল জনতা ব্যাংকের লিখিত পরীক্ষার পরপরই প্রশ্নপত্র ফাঁসের পর অনুসন্ধানে দেখা যায়, পরীক্ষা শুরুর আগের রাতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে পড়ে। প্রশ্নপত্র পেয়েছিলেন এমন কয়েকজন বিষয়টা স্বীকারও করেন। কিন্তু এই পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন দিব্যি এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় কিন্তু পরীক্ষা তো বাতিল হয় না।

অগ্রণী ব্যাংকের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ক্ষেত্রেও অস্বীকারের সংস্কৃতিই শুরুতে দেখা গেল। পরীক্ষা শুরুর আগে সর্বত্র প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে গেলেও কর্তৃপক্ষের সেই পুরোনো বুলি, পরীক্ষা শুরুর আগে তাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। কাজেই পরীক্ষা বাতিল হবে না। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে তাঁদের কথা কেউ শুনতে চান না। তাঁরা কার কাছে অভিযোগ করবেন? কোথায় করবেন? আর কেউ প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা জানালে তাঁকেই যে ফাঁসানো হবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়?

শুক্রবার বিকেল সাড়ে তিনটায় অগ্রণী ব্যাংকের আরেক ভাগের পরীক্ষা ছিল। সকালের মতোই সেই প্রশ্নও ফেসবুকে গণহারে ছড়িয়ে পড়লে বেলা দেড়টার দিকে পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা এল। কিন্তু এই পরীক্ষা দিতে সারা দেশ থেকে কষ্ট করে যে দুই লাখ পরীক্ষার্থী ঢাকায় এসেছিলেন, তাঁদের কী দোষ? এই তরুণদের সঙ্গে প্রহসনের মানে কী? তাঁদের কাছে কি ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন মনে করেছে কেউ?

অগ্রণী ব্যাংকের পরীক্ষা স্থগিতের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং বিভাগের একজন অধ্যাপক জানালেন, এভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে তরুণ প্রজন্ম হতাশায় ডুবে যাক, সেটা তাঁরাও চান না। তাই ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকার ক্ষতি হবে জেনেও তাঁরা বিকেলের পরীক্ষা স্থগিত করেছেন। কিন্তু শতভাগ ফাঁসের পরও সকালের পরীক্ষা কেন বাতিল হচ্ছে না, তা নিয়ে নিশ্চুপ তাঁরা।

প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে গত দুই দিনে অনেক পরীক্ষার্থী প্রচণ্ড হতাশা প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, শুক্রবার সকালের পরীক্ষার পাশাপাশি ফাঁস প্রশ্নে অনুষ্ঠিত যেকোনো পরীক্ষা বাতিল করতে হবে। ভবিষ্যতে যেকোনো মূল্যে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। তরুণদের এই যৌক্তিক দাবি কি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কানে আদৌ পৌঁছাবে?

সৌজন্যে: প্রথম আলো

প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0033690929412842