ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষার আগের রাতে দুটি হলে প্রশাসনের সহযোগিতায় অভিযান চালায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এতে আটক করা হয় ছাত্রলীগের এক নেতা ও এক কর্মীকে।
তাদের কাছ থেকে বেশ কয়েকটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস উদ্ধার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরীক্ষা চলার সময় বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে ১৩ জনকে আটক করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এমনকি অন্যদের হাতেও চলে যায় একই প্রশ্ন। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখন প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাই অস্বীকার করছে। শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকরা এতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। প্রশ্ন ফাঁস না হয়ে থাকলে আগের রাতে কেন অভিযান চালিয়ে ছাত্রলীগের দুই নেতাকে আটক করে তাঁদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরে আরো ১৩ শিক্ষার্থীকে আটক করা হলো সে প্রশও তুলেছেন তাঁরা।
এদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা নতুন করে পরীক্ষা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার সংবাদ অসত্য বলে দাবি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়েছে, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও মুদ্রণ এতটাই গোপনীয়তার মধ্যে করা হয় যে তাতে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান গতকাল শনিবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘যদি আগের রাতেই প্রশ্ন ফাঁস হয় তাহলে কেন আমরা কেউ আগের রাতে জানলাম না? সকালে পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরে কেন জেনেছি? নিশ্চয়ই একটি কুচক্রী মহল বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান নষ্ট করতে ষড়যন্ত্র করছে। কারা এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত তা আমরা খতিয়ে দেখব। আর প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে আরো খোঁজ নিয়ে দেখি। পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’
বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহায়তা ছাড়া কোনোভাবেই সিআইডির পক্ষে অভিযান চালানো সম্ভব নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সহায়তা নিয়েই পরীক্ষার হল থেকে প্রমাণসহ ১৩ জনকে আটক করা হয়েছে। এ ছাড়া পরীক্ষার আগের রাতে এবং পরীক্ষার দিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে প্রশ্ন ছড়িয়ে পড়েছিল। ওই প্রশ্ন আসল কি না সে নিয়ে প্রথমে অনেকেই দ্বিধায় ছিল। কিন্তু পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর দেখা গেল হুবহু মিলে গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এখন আসলে দায় এড়ানোর চেষ্টা চলছে। ভর্তি পরীক্ষার আগের রাতে অভিযান চালানোর পরও বলা হচ্ছে তাদের জানা নেই। কোনো কিছু অস্বীকার করার প্রবণতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। যদি প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে সেটা খতিয়ে দেখা উচিত। এরপর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। ’
অভিভাবক সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শামীমা সুলতানা নীপা বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও যদি কোনো কিছু না বুঝেই অস্বীকার করা হয় তাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকে না। আমরা মনে করি, অবশ্যই বিষয়টির তদন্ত করা উচিত। আর প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণ পাওয়া গেলে এই পরীক্ষা বাতিল করতে হবে। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টান্তই অন্য সবাই অনুসরণ করবে। ’
জানা যায়, পরীক্ষার আগের রাতে আটক হওয়া শহীদুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র মহিউদ্দিন রানা এবং অমর একুশে হলের আবাসিক ছাত্র আব্দুল্লাহ আল মামুন দুজনেই ছাত্রলীগের নেতা। রানা ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহসম্পাদক। আর মামুন সংগঠনের হল শাখার নেতা। তাদের বিশ্ববিদ্যালয় এবং ছাত্রলীগ থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগে মহিউদ্দিন রানা ও আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ তিনজনকে চার দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত। ঢাকা মহানগর হাকিম আক্তার মাহমুদা বেগম গতকাল এ আদেশ দেন।
গত শুক্রবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ৫৩টি কেন্দ্র এবং ক্যাম্পাসের বাইরে ৩৩টি কেন্দ্রে ওই ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষার আগের রাত ৩টার দিকে ইংরেজি অংশের ২৪টি প্রশ্ন ই-মেইলের মাধ্যমে প্রথমে পাওয়া যায়। এরপর পরীক্ষা শুরু হওয়ার ঘণ্টাখানেক আগে ওই প্রশ্নের উত্তর নির্দিষ্ট শিক্ষার্থীর মোবাইল ফোনে পাঠানো হয় এসএমএস করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, প্রশ্নপত্র ছাপা হয় পরীক্ষার আগের রাতে। এরপর প্রতিটি কেন্দ্রে দায়িত্বে থাকা শিক্ষকদের সহায়তায় তা পৌঁছানো হয়। যেহেতু আগের রাতেই অনেকের হাতে প্রশ্ন এসেছে তাই রাতেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারো কারো ধারণা, যখন ছাপানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তখন এর সঙ্গে জড়িত কারো সহযোগিতায় এ প্রশ্নপত্র বাইরে চলে গেছে। একটি চক্র এই প্রশ্নপত্র ফাঁস করার সঙ্গে জড়িত। তাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী রয়েছেন। তাঁরা আগে থেকেই কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ করে রেখেছিলেন। ওই শিক্ষার্থীদের একটি করে ডিভাইসও দেওয়া হয়, যার মাধ্যমে বাইরে থেকে হলের ভেতরে পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে উত্তর জানিয়ে দেওয়া হয়। মাস্টারকার্ডের মতো দেখতে পাতলা ওই ডিভাইসের ভেতরে মোবাইল ফোনের সিম থাকে। পরীক্ষার হলে শোনার জন্য থাকে অতি ক্ষুদ্র লিসেনিং কিট। এর মাধ্যমেই শিক্ষার্থীরা প্রশ্নের উত্তর জেনে লিখেছেন।
জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটে এক হাজার ৬১০টি আসনের বিপরীতে এবার পরীক্ষায় অংশ নেয় ৯৮ হাজার ৫৪ জন। গড়ে একটি আসনের বিপরীতে অংশ নেয় ৬০ জনের বেশি পরীক্ষার্থী। এই হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে এক-দুই নম্বরের ব্যবধানই পরীক্ষার্থীদের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়। তাই সাধারণ শিক্ষার্থীরা নতুন করে পরীক্ষা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে।
ফেরদৌস নামের একজন পরীক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা তিন মাস কোচিং করেছি। সারা দিন পড়ালেখা করেছি। কিন্তু যে পরীক্ষার্থী টাকা দিয়ে আগের রাতে প্রশ্ন পেল, দেখা যাবে সে-ই বেশি নম্বর পেয়েছে। তাহলে আমাদের কষ্টের মূল্য কী রইল? এখন যেহেতু ইংরেজি অংশ নিয়েই বেশি অভিযোগ উঠেছে, তাই এই অংশের হলেও যেন নতুন করে পরীক্ষা নেওয়া হয়। ’
ফেরদৌসের বাবা আফজাল হোসেন বলেন, ‘এসএসসিতে প্রশ্ন ফাঁস, এইচএসসিতে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ছিল। এবার ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসেও প্রশ্ন ফাঁসের সম্মুখীন হতে হলো। এতে আমাদের বাচ্চারা কী শিখছে সেটাই ভাবার বিষয়। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায়ও যদি মেধার মূল্যায়ন না হয় তাহলে এই পরীক্ষার দরকার আছে কি না সেটাও ভেবে দেখা উচিত। ’
এদিকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার সংবাদের প্রতিবাদ পাঠিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন (ভারপ্রাপ্ত) ড. সাদেকা হালিমের সই করা প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়েছে, ‘‘বিভিন্ন গণমাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। সংবাদে দাবি করা হয়েছে যে পরীক্ষা অনুষ্ঠানের আগের রাতেই প্রশ্নপত্র বা এর একাংশ ফাঁস হয়েছে। এই দাবি অসত্য ও বাস্তবসম্মত নয়। যে প্রক্রিয়ায় প্রশ্ন প্রণয়ন ও মুদ্রণ হয় তা এতটাই গোপনীয়তার মধ্যে করা হয় যে তাতে ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস’-এর কোনো সুযোগ নেই। ”
সাদেকা হালিম বলেন, ‘কোনো কোনো গণমাধ্যমের দাবি অনুযায়ী আগের রাতে তাঁদের কাছে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র পৌঁছে থাকলেও তাঁরা পরীক্ষা শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর সংবাদ আকারে প্রকাশ করেছেন। এভাবে সংবাদ প্রকাশ করায় আমরা বিস্মিত ও উদ্বিগ্ন হয়েছি। গণমাধ্যমের কাছে রাতে বা পরীক্ষা চলাকালীন প্রশ্নপত্র ফাঁসসংক্রান্ত কোনো তথ্য থাকলে তা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা বাঞ্ছনীয় ছিল। ’
প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়, পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার আগের রাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় একটি সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্রকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় পরীক্ষা চলাকালীন বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে ১৩ জন পরীক্ষার্থীকে বিভিন্ন ডিভাইসসহ আটক করা সম্ভব হয়।