গত কয়েক বছর পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস দেশে স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবারও পরীক্ষা শুরুর আগের রাত থেকেই ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে কয়েকটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। আমাদের দেশে বিগত বছরগুলোতে অন্য বিষয়ের পাশাপাশি প্রশ্ন ফাঁসের প্রক্রিয়ায়ও উন্নতি ঘটেছে।
বিগত বছরেও ফাঁস হওয়া প্রশ্ন কিনতে কয়েক হাজার টাকা দরকার হতো বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু এবার বিষয়প্রতি মাত্র ৮০০ টাকায় প্রশ্নপত্র পাওয়া গেছে। বিফলে মূল্য ফেরত দেওয়ার মতো সুন্দর ব্যবস্থা চালু রেখে, প্রশ্ন কমন থাকার পর টাকা দিতে হবে- ঘোষণা দিয়ে কিছু অসাধু ব্যক্তি প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে।
প্রশ্ন কমন থাকার পরও যদি কেউ টাকা না দেয় তাতেও তারা অসুখী নয়। আর যারা টাকা দেবে তাদের উপহারস্বরূপ প্রশ্ন ফাঁসকারীরা পরবর্তী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফ্রি দেবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল এবং অসাধু হলেও তারা তাদের কথা রেখেছে। চলতি এসএসসি পরীক্ষায় ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই ঢাকা বোর্ডের শারীরিক শিক্ষা, গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
প্রতিবারই প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার পর প্রথমে গুজব বলে উড়িয়ে দেওয়া হয় এবং পরে অস্বীকার করে তদন্ত কমিটি গঠনের মাধ্যমে বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়া হয় এবং যুক্তি দেওয়া হয়, কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশ্ন ফাঁসের কোনো তথ্য নেই। এবারও তাই হচ্ছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের কঠিন শাস্তির বিধানসহ আইন থাকলেও বিগত বছরগুলোর প্রতি বছরই প্রশ্ন ফাঁস হলেও কাউকে সাজা দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়নি।
বিগত বছরগুলোর মতো এবার বলা হয়েছে, প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে শিক্ষকরা সম্পৃক্ত। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কিছু। শিক্ষকরা পরীক্ষা নেওয়ার জন্য প্রশ্নপত্র হাতে পান পরীক্ষা শুরু হওয়ার প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে। এবার ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র পাওয়া যাচ্ছে পরীক্ষা শুরু হওয়ার প্রায় ১০ ঘণ্টা আগ থেকেই এবং দুই থেকে তিন দিন আগেই ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে পরবর্তী পরীক্ষার প্রশ্নও তারা শতভাগ কমনের ব্যবস্থা করতে পারবে।
শুধু তাই না। পরীক্ষা নেওয়ার জন্য শিক্ষকরা নির্দিষ্ট একটি সেটের প্রশ্নই হাতে পান কিন্তু এখন প্রায় সব সেটের প্রশ্নই ফাঁস হচ্ছে। তাহলে কারা এর সঙ্গে জড়িত? যারা প্রশ্ন লিখছেন, ছাপছেন এবং বিলি করছেন- তারা কেন দায়ী নয়? এই প্রশ্ন ফাঁসের দায় কে নেবে? দায়িত্ব যারই থাক, দায় কেউ নেবে না। কারণ দায় নিলে দায়িত্ব পালনের অধিকার থাকে না। তবে নিজে দায় না নিলেও অন্যকে দায়ী করা কতটুকু শোভা পায়?
দেশের একটি অনলাইন পত্রিকার রিপোর্ট অনুয়ায়ী, পরীক্ষা শুরু হওয়ার তিন দিন আগে থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘোষণাদাতাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে? তাদের শনাক্ত করতে পারেনি এবং ঠিকই ঘোষণা অনুযায়ী, ওই অসাধু ব্যক্তিরা প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে। প্রশ্ন ফাঁসকারীরা প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে প্রশ্ন ফাঁস করছে এবং সবার কাছে প্রশ্ন পৌঁছে দিচ্ছে।
ইচ্ছা থাকলে, এ প্রযুক্তির সুবিধা নিয়েই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ওই আইপি অ্যাড্রেস শনাক্ত করে প্রশ্ন ফাঁসকারীদের আটক করা সম্ভব ছিল। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিজে থেকে যেমন কিছু করেনি, তেমনি নিজেদের সক্ষমতা না থাকলে দেশের প্রযুক্তিবিদদের সঙ্গে আলোচনা করে কীভাবে সমাধানে আসা যায়, সে ব্যাপারেও কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করছে বলে জানা যায়নি। চেষ্টা না করলে প্রশ্ন ফাঁসের উৎস কীভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে? ইচ্ছের অভাব যাদের রয়েছে, দায় তাদেরই নিতে হবে।
শিক্ষার্থীরা এই বয়সে কেন ইন্টারনেট ব্যবহার করে সেটার দিকে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। তাদের আটকে রাখার চিন্তা করা হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলা হয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য। কিন্তু কেন? গুগলের থেকে বিশ্বের কোন লাইব্রেরি বেশি তথ্য দিতে পারবে আমাদের? ইউটিউব শিক্ষার্থীদের কাছে ক্ষেত্রবিশেষে ক্লাসরুমের শিক্ষকের থেকেও কার্যকর ভূমিকা পালন করছে।
শুধু তাই নয়, ইউটিউব শিক্ষকদেরও শিক্ষকে পরিণত হচ্ছে। এখন অনেক শিক্ষকই কোনো বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে গুগল, ইউটিউবের দ্বারস্থ হন বিশ্ব জ্ঞান ভাণ্ডারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য। ইন্টারনেটের ব্যবহার বন্ধ করলে বিশ্বের জ্ঞান ভাণ্ডারের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা পরিচিত হবে কীভাবে? ইন্টারনেটে ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা এনে অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়। কার্যকর উদ্যোগ নিলে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতোই এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধীদের শনাক্ত করা সম্ভব।
বিগত কয়েক বছর ধরে টানা প্রশ্ন ফাঁস হলেও, প্রশ্ন ফাঁসের কোনো উৎস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দেশের বিদ্যমান আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সম্প্রতি কঠিন কাজেও সফলতা এনেছে এবং দেশ ও দেশের বাইরে সুনাম কুড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন সফল হতে পারছে না? নাকি তাদের কাজ করতে দেওয়ার সুযোগই দেওয়া হচ্ছে না?
একসময় দেশে যখন নকলের রমরমা অবস্থা ছিল, তখন গত বিএনপি সরকারের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী নকলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। তিনি হেলিকপ্টারে চড়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে যেতেন এবং নকলবাজ ও নকল সরবরাহকারীদের ধরতেন। মানুষ তাকে সাধুবাদ জানিয়েছিল এবং দেশ থেকে নকল সমস্যার সমাধান হয়েছে।
এই সরকারের শিক্ষামন্ত্রী কেন প্রশ্ন ফাঁসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সফল হতে পারেন না? বিএনপি সরকারের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী যেমন যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, তেমনি যুদ্ধে জয়ের জন্য নিজেই মাঠে নেমেছিলেন এবং প্রাণপণে চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু এ সরকারের সময় তিন দিন আগে প্রশ্ন ফাঁসের ঘোষণা দেওয়া হয় এবং সেটি গণমাধ্যমে আসার পরও তাদের চিহ্নিত করতে কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয় এবং এটাই কর্তৃপক্ষের যুদ্ধ জয়ের ইচ্ছের মাপকাঠি পরিমাপ করে।
প্রশ্ন ফাঁসের সমস্যার সমাধান ততদিনে হবে না, যতদিন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এটা স্বীকার না করবে, অপরাধীদের শাস্তি দেবে, দায়িত্বপ্রাপ্তদের জবাবদিহি নিশ্চিত করবে এবং এটা বন্ধের জন্য সার্বিকভাবে নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি প্রাণপণে চেষ্টা করবে।