প্রাইভেট-পাবলিক নয়, ভালো ও খারাপ বিশ্ববিদ্যালয় - দৈনিকশিক্ষা

প্রাইভেট-পাবলিক নয়, ভালো ও খারাপ বিশ্ববিদ্যালয়

মো. সিরাজুল ইসলাম  |

১৮ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় মতামত পাতায় আসিফ নজরুলের লেখাটি পড়লাম। তাঁকে ধন্যবাদ। যদিও ১৪ আগস্ট একই প্রসঙ্গে আমার একটি লেখার ধারণার সঙ্গে এর যথেষ্ট মিল আছে। আমার ধারণা, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইদানীং একধরনের ‘হেট ক্রাইম’-এর শিকার হচ্ছে। অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তিত্বও খামখেয়ালির বশবর্তী হয়ে এমন বক্তব্য দিচ্ছেন, যা তাঁদের কাছ থেকে কাম্য নয়। ‘থ্যাংকলেস জব বলে’ ইংরেজিতে একটা কথা আছে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে আজকাল তা শতভাগ প্রযোজ্য।

১৯৮৯ সালে যখন প্রথম বুয়েটে ভর্তি হলাম, শিক্ষকেরা প্রায়ই বকাঝকা করতেন এই বলে যে আমাদের প্রত্যেকের পেছনে নাকি সরকারের লাখ টাকা খরচ হচ্ছে প্রতিবছর। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় কেন এই সাবসিডি? এই আশায় যে এই গ্র্যাজুয়েটরা একদিন তাঁদের কর্মদক্ষতার বলে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রেখে সেই টাকা বহুগুণে ফিরিয়ে দেবেন। আসলে একটি দক্ষ জনশক্তিই রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি আর শিক্ষাই এর মূলমন্ত্র। আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ সেবাটিই করে যাচ্ছে একেবারে বিনা মূল্যে, রাষ্ট্রের কাছ থেকে এক পয়সাও না নিয়ে; বরং বিভিন্নভাবে রাষ্ট্রকে তারা ট্যাক্স দিচ্ছে।

অথচ কৃতজ্ঞতা দূরে থাক, নিন্দুকের কশাঘাতে বরং তারা বারবার জর্জরিত হচ্ছে। খোলা জায়গা নেই, বড় মাঠ নেই, গবেষণা হয় না—ভাবখানা এমন যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইচ্ছা করেই তা করছে না! তাদের ধারণা থাকা উচিত যে ঢাকা শহরের মাঝখানে এমনকি ছোট মাপের এক একরের একটি মাঠের ক্রয়মূল্য কত হতে পারে—কম করে হলেও এক শ কোটি টাকা। এক কলমের খোঁচায় একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তা দখল করে নিতে পারে, কিন্তু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তা গড়ে তুলতে হয় তিলে তিলে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এ ব্যাপারে সরকারের সহযোগিতা পাওয়া যায়, অর্থাৎ কম মূল্যে জমি কেনার ক্ষেত্রে। তারা আরও অনেকভাবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সাহায্য করে থাকে। আর আমাদের ক্ষেত্রে তার উল্টো—এটা যেন টাকার খনি! বাজেট ঘাটতি মেটাতে হবে, ব্যস! প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আর ইংলিশ স্কুলে ভ্যাট বসাও!!

জাতি হিসেবে আমরা অনেকটা অধৈর্যও বটে। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কমপক্ষে ১৫টিই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। এই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইতিহাস প্রায় কয়েক শ বছরের পুরোনো। যেমন: হার্ভার্ড প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৬৩৬ সালে, ইয়েল ১৭০১ সালে, প্রিন্সটন ১৭৪৬ সালে কিংবা কলাম্বিয়া ১৭৫৪ সালে ইত্যাদি। আমাদের সেই ইতিহাস মাত্র ২৪ বছরের, আর এরই মধ্যে সবাই উঠেপড়ে লেগেছে এদের মান নিয়ে। আবার অন্যদিকে চলছে প্রতিদিন একটা করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি দেওয়ার হিড়িক!

শতবর্ষীয় কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কোনো বাচ্চা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের যেমন তুলনা চলে না, আবার একইভাবে এটাও ভেবে দেখা প্রয়োজন যে জনগণের ট্যাক্সের টাকার সর্বোত্তম ব্যবহার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো করছে কি না। আজ থেকে প্রায় এক যুগ আগে পত্রিকায় অধ্যাপক জাফর ইকবালের একটি লেখা পড়েছিলাম, যার শিরোনাম ছিল এ রকম—দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরবর্তী আদমজী জুট মিল হচ্ছে কি না! অধ্যাপক জাফর ইকবাল যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করেছেন এবং বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করছেন। সেই প্রবন্ধে তিনি আফসোস করেছিলেন এই বলে যে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী শিক্ষক যুক্তরাষ্ট্র থেকে পিএইচডি শেষে তাঁর পূর্বতন স্থানে ফিরে না গিয়ে ঢাকার একটি নামী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছিলেন। তিনি জানেন কি না জানি না, এই মুহূর্তে সেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে একইভাবে আরও অন্তত চারজন আছেন, যাঁরা তাঁর সাবেক সহকর্মী! উচ্চশিক্ষা শেষে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরা ফিরে যাননি।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা ভিন্ন, তবে বাংলাদেশের সরকারি অফিসগুলো নিয়ে কিন্তু বরাবর বিস্তর অভিযোগ। সরকারি টিঅ্যান্ডটি বোর্ডের কথাই ধরা যাক। কথিত আছে, একটি টেলিফোন লাইনের জন্য একজন গ্রাহককে নাকি ৩৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আর এখন ৩৫ মিনিটেই আপনি পেতে পারেন একটি বেসরকারি মোবাইল ফোনের কানেকশন। মজার কথা হচ্ছে, দেশে প্রাইভেট সেক্টরে যখন মোবাইল ফোন চালুর প্রস্তাব আসে, সরকারি টিঅ্যান্ডটিওয়ালারা এর বিরোধিতা করেছিল এই বলে, এগুলো ব্যবসায়িক স্বার্থে বিদেশি চক্রান্ত। সরকারি ব্যাংক কিংবা মিল–ফ্যাক্টরির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা প্রযোজ্য। শিক্ষার ক্ষেত্রেও কি ঠিক এমনটিই হচ্ছে না? ঢাকা কলেজের এইচএসসির ছাত্র ছিলাম ১৯৮৬-৮৮ সালে। বাঘা বাঘা ছাত্র সেখানে আসত গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে। সেই ঢাকা কলেজ আর গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি আজ কোথায়?

পর্যাপ্ত পরিমাণে ইতিহাস-সংস্কৃতিচর্চা করা হচ্ছে না বলে যে অভিযোগ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে, তা–ই বা কতটা যুক্তিযুক্ত? আমাদের সময়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পদার্থ, রসায়ন কিংবা ব্যাংকিং বিষয়ের কোনো ছাত্রকে শুনিনি যে বাংলা বা বাংলাদেশ স্টাডিজ পড়েছেন। বড়জোর সাবসিডিয়ারিতে নিজ বিষয়ের বাইরে দুটি অন্য বিষয়ের কোর্স নিলেই যথেষ্ট ছিল। আর তাই বলে তাদের সবাই যে সন্ত্রাসী হয়ে গিয়েছিল তা তো দেখিনি। মজার কথা হচ্ছে, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের কারিকুলামগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের আদলে, প্রায় ৫০ শতাংশ সাধারণ ও মানবিক শিক্ষার প্রস্তাবসহ যখন ইউজিসিতে পাঠানো হয়, তখন প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা এই বলে মন্তব্য প্রদান করেন, এ রকম কারিকুলাম দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে দক্ষ বিশেষজ্ঞ তৈরি সম্ভব নয় এবং এটা বাংলাদেশের অন্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কারিকুলামের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়! এমন বক্তব্যও এসেছিল যে তাঁরা সহজে ইঞ্জিনিয়ারিং বা বিজ্ঞান ডিগ্রি পেতে বাংলা আর ইতিহাস পড়াতে চাইছেন।

এ ধরনের অজস্র ভুল ধারণা আছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে। অধ্যাপক আসিফ নজরুল তাঁর লেখাতেও কিছু ভুল ধারণার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সবশেষে এটাই বলব যে সরকারি-বেসরকারি বিভেদের চেয়ে আমার মনে হয় ভালো আর খারাপ মানের বিশ্ববিদ্যালয় এই ভাগটিই এই মুহূর্তে অধিক যুক্তিসংগত। সরকারি-বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই ভালো ও খারাপ মানের বিশ্ববিদ্যালয় আছে এবং এগুলো দেখার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাও আছে। আশা করি, অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল করে এই মান নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটি তারা যৌক্তিকভাবে তত্ত্বাবধান করবে। বিজ্ঞ বুদ্ধিজীবী কিংবা সাংবাদিক ভাইদের প্রতিও অনুরোধ, উচ্চশিক্ষা নিয়ে এই নতুন মাত্রাটিকেই যেন তাঁরা অধিক যুক্তিযুক্ত হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে গঠনমূলক আলোচনায় ব্যাপৃত হন।

মো. সিরাজুল ইসলাম: একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার - dainik shiksha মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038368701934814