প্রাণের প্রিয় বর্ণমালা অ- আ- ক-খ - দৈনিকশিক্ষা

প্রাণের প্রিয় বর্ণমালা অ- আ- ক-খ

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

o a kh khaভাষা মানুষের প্রতি স্রষ্ঠার এক অপার নেয়ামত। নিজেকে প্রকাশ করার নিত্য আকুতি কেবল মানুষের নয়, স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার নিজের ও  পবিত্র কুরআনসহ সকল ঐশীগ্রন্থে তিনি নিজেকে প্রকাশ করেছেন বিশদ ভাবে । প্রাণবন্ত উপস্থাপনায় স্রষ্টা নিজেকে ফুটিয়ে তোলেন তাঁর সৃষ্ঠির মাঝে, আপন ভাষায় সৃষ্ঠির রহস্য বুঝে উঠবার ইঙ্গিত দেন তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্ঠি মানব জাতিকে ।

পৃথিবীতে সাড়ে তিন হাজারের ও বেশী ভাষা প্রচলিত আছে । ভাষার নানা রূপ । এর ব্যবহার বহু মাত্রিক। একমাত্র ভাষার কারণেই পৃথিবীতে মানুষের বসবাস আজ সহজতর হয়েছে । ভাষার সাহায্যে মানুষ চষে বেড়াচ্ছে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে । ভাষার কারণে মানুষ পৃথিবী নামক গ্রহটিকে একান্ত আপনার করে নিতে পেরেছে । মানুষে মানুষে ভালবাসার বন্ধন সৃষ্ঠি করে দিয়েছে ভাষা। এই ভাষাই মানুষকে পরস্পরের সুখ- দুঃখের সাথী বানিয়েছে । ভাষার বন্ধনে গোটা পৃথিবীর মানুষ বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব রচনা করেছে। তাই মানুষের কাছে ভাষার মাহাত্ম্য সর্বকালেই অনন্য ।

মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা যে কোন মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এ সব সম্পদ মানুষের কাছে স্বর্গের চেয়ে ও পবিত্র। এ সবের মধ্যে মাতৃভাষার ভিন্ন এক স্বকীয়তা রয়েছে। অনিবার্য কোন কারণে মা ও মাতৃভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হলে ও কোন মানুষ তার মাতৃভাষা থেকে বিচ্যুত হতে পারে না। সে যেখানেই যাক না কেন, মাতৃভাষা তার অনুগামী হবেই। সুখে- দুঃখে মাতৃভাষার অবলম্বনে মানুষ এগিয়ে চলে সম্মুখ পানে। মনের অতল গভীরে স্বপ্নের জাল বুনে মানুষ আপন মাতৃভাষায়। এখানেই মা ও মাতৃভূমির সাথে মাতৃভাষার পার্থক্য। তবে এ তিনটি বিষয়কে বিচ্ছিন্ন করে দেখার অবকাশটুকু নিষ্প্রয়োজন।

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এ ভাষার স্বকীয়তা এই যে , ভাষাভাষী জনসংখ্যার দিক থেকে এটি পৃথিবীর চতুর্থ বৃহৎ মাতৃভাষা। কেবল আমাদের বাংলাদেশ নয় , ভারতের পশ্চিমবঙ্গ , ত্রিপুরা , উড়িষ্যা ,বিহার ও আসামের কয়েকটি স্থানে ও জনসাধারণ বাংলায় কথা বলে থাকে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের অনেক দেশে এখন বাংলা ভাষাভাষী মানুষজন বসবাস করছে। বর্তমান পৃথিবীতে বাংলা ভাষাভাষী লোকের সংখ্যা তিরিশ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এ ভাষায় সাহিত্য রচনা করে নোবেল জয় করেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নিজেদের কৃতকর্মের স্বীকৃতি স্বরুপ নোবেল পেয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী দুই মহারথী অমর্ত্য সেন ও ড. মুহম্মদ ইউনুছ। ইতোমধ্যে বাংলা ভাষাভাষীরা হিমালয়ের চূড়ায় আরোহণ করেছেন, ক্রিকেট বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্ঠি করেছেন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গবেষণায় অনন্য ভূমিকা পালন করে চলেছেন। এ ভাষায় সাহিত্য রচনা করে অসামান্য কৃতিত্ব অর্জন করেছেন কাজী নজরুল, শরৎচন্দ্র , শামসুর রাহমান, হুমায়ুন আহমদ প্রমুখ সাহিত্যিক। এ ভাষায়ই আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বসেরা এক অনন্য ভাষণ দিয়ে বাঙ্গালী জাতিকে স্বাধীনতার জন্য পাগল করে তুলেন একাত্তরের ৭মার্চে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।

কিন্তু, বাংলা ভাষা ভিন্ন আরেক কারণে বিশ্ব দরবারে বহুল পরিচিত ও মর্যাদাপূর্ণ এক ভাষা। পৃথিবীর আর কোন ভাষাভাষী লোকের সে গৌরব নেই। আমাদের সে গৌরব ত্যাগের মহিমায় সমোজ্জল। মাতৃভাষার জন্য এতো ত্যাগ আর এতো রক্তদানের ইতিহাস আর কারো নেই। ভাষা আন্দোলনের অহংকার আমাদের ছাড়া আর কার আছে ?

মধুর মতো মিষ্ট আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা। হৃদয়- মন থেকে উচ্ছরিত এ ভাষা আমাদের যেন পাগল করে তোলে। তাই তো এ ভাষার প্রতি কারো অবহেলা সহ্য করার মানসিকতা এ ভাষাভাষী কারো নেই।

১৯৪৮ থেকে ১৯৫২। বালা ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট রচনা ও আন্দোলনের পরিসমাপ্তির সময়কাল। এ সময়কালে বিশ্ব ইতিহাসে সৃষ্ঠি হলো এক অনন্য কীর্তি। বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখলো, মায়ের ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সন্তানের অভিনব আত্মাহুতি। বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে দিয়ে মাতৃভাষার সম্মান বাঁচালো তাঁরা। তাঁরা রফিক,সফিক, সালাম,বরকত প্রমুখ। তাঁরা এ জাতির নমস্য আজ,চিরকাল নমস্য হয়েই থাকবেন।

পাকিস্তানীরা আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদা কেড়ে নিতে পারেনি। মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই থেকে আমরা শিখেছি, যে কোন ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম অপরিহার্য। পাকিস্তানীদের নাগপাশ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এ ছিলো আমাদের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের প্রথম ধাপ বা সিঁড়ি। এ সিঁড়ি বেয়েই আমরা স্বাধীনতার মঞ্চে আরোহণ করেছি। আজো যে কোন ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম বা আন্দোলনে প্রেরণা যোগায় আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন ।

আমাদের ভাষা আন্দোলন আজ আর কেবল আমাদের নয়। ইউনেস্কোর বদান্যতায় বিশ্ববাসী আজ আমাদের গৌরবের অংশীদার। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি এলে সারা পৃথিবীর মানুষ আমাদের বাংলা ভাষা ও এ ভাষার অকুতোভয় সন্তানদের স্মরণ করে , শ্রদ্ধা জানায়।

এতো কিছুর পর ও ভাষা সৈনিকদের সত্যিকারের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে বলে মনে হয়নি । কেবল প্রভাতফেরি , শহীদ মিনারে নগ্নপায়ে ফুল দেয়া আর হৃদয়স্পর্শী গান গেয়ে একুশ উদযাপন করলেই কী ভাষা শহীদদের প্রতি আমাদের দায় শেষ হয়ে যায় ? তাঁরা কী চেয়েছিলেন ?

আজো আমাদের দেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হয় নাই। ভাষা আন্দোলনের এতোগুলো বছর পর ও আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আদালত সমূহে ইংরেজি ভাষায় রায় প্রদান করা হয়। আমাদের বিজ্ঞান,প্রযুক্তি ও চিকিৎসাসহ উচ্চ শিক্ষার প্রায় সকল পাঠ্যপুস্তক ও সহায়ক বই এখনো ইংরেজিতে লেখা। আইসিটির সকল বই পুস্তক অনুরুপ ভাবে রচিত।

আজকাল বাংলা ভাষার চর্চা ও অনুশীলন অনেকটা সীমিত। বাংলাকে বাংলিশ বানানোর অপচেষ্ঠা ও করে কেউ কেউ। আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোতে এখন আর কেউ ‘হস্তলিপি’ কিংবা ‘শ্রুতলিপি’ লিখান না। বাংলা নীরব পাঠ কিংবা সরব পাঠের চর্চা ও বহুলাংশে কমে গেছে। এখন আমরা কেবল সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি । বাংলা ব্যাকরণ বইটাকে আমরা অনেক কাটছাট করে ফেলেছি। একা এক বাংলা একাডেমি আমাদের ভাষাটাকে কতোদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারবে ? প্রতি জেলায়- উপজেলায় বাংলা একাডেমির শাখা হলে ভালো হয়। আমাদের প্রিয় মাতৃভাষার অনেক অনেক সংস্কার প্রয়োজন। প্রিয় বর্ণমালাসহ প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার ব্যবহার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করতে পারলে আমাদের শহীদদের আত্মা শান্তি লাভ করবে। আমাদের ছোটবেলায় খড়িমাটি দিয়ে শ্লেটে প্রিয় বর্ণমালা অ.আ. ক.খ ইত্যাদি লিখতে লিখতে এক সময় তা হৃদয়ে লেখা হয়ে যেতো। এ ভাবেই আমরা মাতৃভাষার বর্ণমালা রপ্ত করেছি। আজকাল এভাবে আর অনুশীলন হয় না। এখন সন্তানের প্রতি ভিন্ন প্রত্যাশা । দু ‘ চার কথা ইংরেজি বলতে কিংবা লিখতে পারলে আমরা উচ্ছসিত হই ।

কেবল ভাষা আন্দোলনের গৌরব নিয়ে বেঁচে থেকে কী লাভ? বাংলা ভাষার পরিমার্জন ও উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করতে না পারলে ভাষা আন্দোলনের অহংবোধ একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে ।

মহান একুশ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রাক্ষালে শহীদ ভাইদের জন্য রক্তিম সালাম। জয় হউক বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালীর।

লেখক : অধ্যক্ষ , চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ , কানাইঘাট , সিলেট ।

ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার - dainik shiksha মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.006382942199707