ছিল রুমাল, হয়ে গেল বিড়াল। সুকুমার রায়ের ‘হযবরল’র আজব জগতে এসব চলতে পারত। কিন্তু আমাদের দেশটাই বা কম কী? যে হযবরল পরিস্থিতির মধ্যে আমরা পড়েছি, তাতে সবই সম্ভব। আমার এক শিক্ষকবন্ধু একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রের পরীক্ষার খাতায় লেখা এক দার্শনিক বাক্য পড়ে শুনিয়েছিলেন। ছেলেটি লিখেছিল, যেকোনো কিছু থেকে কোনো কিছু হলে কোনো কিছু থেকেও যেকোনো কিছু হতে পারে। শুনে মাথা ঘুরেছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ছেলেটা দূরদর্শীই ছিল। যেকোনো কিছু থেকে যেকোনো কিছু হওয়া আসলেই সম্ভব। অঙ্ক করলে বিষয়টা দাঁড়াবে এ রকম: যেকোনো কিছু ১ = যেকোনো কিছু ২।
উদাহরণ এক: ছাগলের মৃত্যুর সংবাদে মন্ত্রীর মানহানি হলে সাংবাদিকের ৫৭ ধারায় মামলা খাওয়া সম্ভব। ছাগল খায় কাঁঠালপাতা, সাংবাদিকের খাদ্য হলো ৫৭ ধারা।
মন্ত্রীর কাজ মন্ত্রী করেছেন, করেছেন ছাগল দান। সাংবাদিকের কাজ সাংবাদিক করায় তবে কেন অপমান?
সব দোষ ছাগলের, ব্যাটা অসময়ে কাঁঠালপাতার মায়া কাটিয়ে মরতে গেল কেন? সুতরাং, ছাগলের অপরাধ = মন্ত্রীর মানহানি = ৫৭ ধারার মামলা।
প্রমাণ হলো তো যেকোনো কিছু থেকে যেকোনো কিছু হওয়া সম্ভব!
উদাহরণ দুই: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে চলতি বিবাদের প্রতীক একটি কাঁঠাল। কাঁঠাল আমাদের জাতীয় ফল। জাতির জীবনে এর প্রাসঙ্গিকতা ফিরিয়ে এনেছেন সেখানকার শিক্ষকেরা। প্রশাসনপন্থী শিক্ষকদের মনে ব্যথা, কেন ছাত্ররা তাদের কাঁঠাল ছুড়ে মারল? মনের ব্যথা সম্ভবত মামলায় সারে। তাই হত্যাপ্রচেষ্টার অভিযোগে গণহারে মামলা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ৪২ জন ছাত্রছাত্রীকেও গ্রেপ্তার করা হয়। এখন তাঁরা জামিনে থেকে আন্দোলনে আছেন।
এ পর্যন্ত শুনে কারও ধারণাই হবে না যে এ ঘটনার শুরু দুই ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যু দিয়ে। ছিল ট্র্যাজেডি, হয়ে গেল কমেডি। গত ২৭ মে বাসের ধাক্কায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র রাস্তার ওপরই প্রাণ হারায়। অ্যাম্বুলেন্স আসতে দেরি করলেও আজরাইলের দেরি হয়নি। তদুপরি, নিহত ছাত্রদের জানাজাও ক্যাম্পাসে পড়াতে দেওয়া হয়নি! মানুষ সবচেয়ে আলোড়িত হয় তখন, যখন ঘটনার শিকারের সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পায়। সহজাতভাবেই তারা ভাবল, নিহত রানা ও আরাফাতের পরিণতি তাদেরও হতে পারত। তাজা দুটি প্রাণের শোকে তারা কিছুটা বাড়াবাড়িও করে ফেলল। প্রাণঘাতী সড়ক তারা অবরোধ করল। শেষমেশ উপাচার্যের আশ্বাসে যখন তারা সেই অবরোধ তুলতে যাবে, তখনই হামলা চালাল পুলিশ। সেই হামলার স্বরূপ বুঝতে সিদ্দিকুরের পরিণতি মনে করলেই চলে। ভাগ্যিস ওই দিন রাবার বুলেট ও টিয়ার শেলে এক সাংবাদিকসহ নয়জন আহত হলেও কারও অঙ্গহানি হয়নি।
উপাচার্য আশ্বাস দিয়েছিলেন, অবরোধ প্রত্যাহার হলে হামলা-মামলা হবে না। তারপরও হামলা হলো কেন? এই প্রশ্ন নিয়ে তারা ঘেরাও করেছিল উপাচার্যের বাসভবন। সেখানে কিছু শিক্ষক জড়ো হয়ে অশিক্ষকসুলভ আচরণ করলেন। কিছু শিক্ষার্থীও যা করল, তাও অগ্রহণযোগ্য। ভাঙচুর হলো, অনাকাঙ্ক্ষিত ভাষায় ছাত্ররা তর্কে লিপ্ত হলো। এর মধ্যেই দৃশ্যপটে হাজির হলো একটি বোঁটা-ছেঁড়া কাঁঠাল। ছাত্রদের ছোঁড়া সেই কাঁঠালের আঘাতে আহত হলেন কয়েকজন শিক্ষক।
দাঁড়ান দাঁড়ান, জ্যৈষ্ঠ মাসে কাঁঠাল পেলেন কই? সেটা তো এঁচড়ের সময়, যাকে বলে কাঁঠালের মুচি। এঁচড়ে পাকা ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকদের সঙ্গে কিছু একটা বেয়াদবি করেছে, তা ঠিক। কিন্তু তিলকে তাল করা, এঁচড়কে কাঁঠাল বানানো কেন? শোক ও হতাশার আচরণকে মামলার ভাষায় বলা হলো ‘সন্ত্রাসী’ হামলা এবং হত্যাপ্রচেষ্টা! প্রশাসন প্রমাণ করলো যেকোনো কিছু থেকে যে কোনো কিছু হওয়া সম্ভব।
এখন ওই শিক্ষার্থীদের হয়েছে বেকুব দশা। দুই সহপাঠীর লাশের ভার আর মামলার খাঁড়া মিলিয়ে তাদের অবস্থার নিখুঁত নাম: মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।
এই গন্ডগোলে হারিয়ে গেল দুই শিক্ষার্থীর অপঘাতে মৃত্যুর জন্য দায়ী বাসচালকের বিচার এবং সড়কের নিরাপত্তার প্রশ্ন।
শিক্ষার্থীদের প্রাণ যাবে কিন্তু প্রশাসন থাকবে নির্বিকার। ক্লাসে পড়ালেখা হবে না, কিন্তু অভিযোগ করা যাবে না। ফেসবুকে শিক্ষকদের অনিয়ম নিয়ে কথা বলায় ৫৭ ধারার হুমকি দেওয়া হয়েছে সেখানকার একটি বিভাগের শিক্ষার্থীদের। প্রায় আশিরও বেশি শিক্ষার্থীকে জবাবদিহির জন্য তদন্ত কমিটির সামনে ডাকা হয়েছে।
শুধু সিদ্দিকুরই নয়, ক্ষমতার অন্ধ প্রতিহিংসায় কি প্রশাসনও অন্ধ হয়ে যাচ্ছে? এ শিক্ষার্থীরা তো সন্ত্রাসী নয়, অসৎ উদ্দেশ্যও ছিল না তাদের। শিক্ষকের হৃদয় আহত হলে শিক্ষার্থীরা ক্ষমা চাইতেই পারে। উপাচার্য ফারজানা ইসলামও পারেন ভাঙ্গা সম্পর্ক আবার জোড়া লাগাতে। কিন্তু শাস্তি দেওয়ার নেশা মনে হয় সেটা হতে দেবে না। প্রশাসন রাগের চরমে উঠে বসে আছেন। অবস্থা হয়েছে সেই যুবকের মতো, কাজ নাই বলে সে মেলার পাশে ঘুরতে গিয়েছিল। সেদিন আবার সার্কাস দলের এক দড়াবাজ ছিল নিখোঁজ। রিংমাস্টার যুবকটিকে পেয়ে ভরসা পেল। তাকে প্রস্তাব দেওয়া হলো, ৫০ ফুট উঁচু বাঁশ বেয়ে উঠতে পারলে পাঁচ হাজার টাকা পাবে। যুবক ভাবল, এ আর এমন কি!
কিন্তু মুশকিল হলো নামার সময়। নিচের দিকে তাকিয়ে যুবকের মাথা ঘোরায়, কিছুতেই আর নামতে পারে না। দর্শক অস্থির, রিংমাস্টার বিরক্ত। সবার পীড়াপীড়ির মুখে একটা কথাই সে শুধু বলতে পারে: আমারে এখন নামাইব ক্যাডা?
ক্ষমতা দেখাতে দেখাতে এত ওপরে ওঠা যাবে না যেখান থেকে নামা কঠিন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বলে, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই গণচেতনা ও আবেগের বিপক্ষে দাঁড়ানো উপাচার্যরা পরাস্ত হয়েছেন। আর পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছে তৃতীয় পক্ষ। কাঁঠালাঘাতের দিকে তাকিয়ে থাকলে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ধাক্কা এবং বহু শিক্ষার্থীর ভবিষ্যতের উদ্বেগ তাঁরা দেখতে পেতেন।
শিক্ষক আর শিক্ষার্থীর সম্পর্ক আর সাবেকি পিতা-পুত্র, মাতা-কন্যার সম্পর্ক থাকছে না। ঢাবি ও জাবি দুখানেই শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের প্রতিপক্ষ ভাবছেন। তাঁরা যদি সাবেকি সম্মান, নৈতিকতা ও স্নেহ-ভালবাসা ছাড়বেনই, তাহলে শিক্ষার্থীরাই বা কেন তাঁদের সাবেকি ভক্তির চোখে দেখবে? তাঁরা যদি ছাত্রছাত্রীদের প্রতিপক্ষ মনে করতেই থাকেন, তাহলে ‘প্রতিপক্ষ’ও কিন্তু নাগরিক হিসেবে তার অধিকারের হিস্যা বুঝে নিতে চাইবে।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।