প্রাথমিকে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ নৈতিক শিক্ষার পরিপন্থী - দৈনিকশিক্ষা

প্রাথমিকে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ নৈতিক শিক্ষার পরিপন্থী

মো. সিদ্দিকুর রহমান |
Siddiq sir
মো. সিদ্দিকুর রহমান

ইংরেজ আমলে বিত্তশালী পরিবারের সন্তানদের শিক্ষার জন্য কাচারি ঘরে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হতো। তখন বাংলা ভাষা পড়ানোর জন্য পন্ডিত মহাশয়ও আরবি ভাষা যেমন কায়দা, আমপারা, কোরআন শরীফ, দোয়া ও হাদিস শিক্ষা দেওয়ার জন্য মুন্সী নিয়োগ দেয়া হতো। ক্রমান্বয়ে শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করার পর জমিদার বা বিত্তশালীরা বিভিন্ন স্থানে বিদ্যালয় স্থাপন করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া শুরু করেন। শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক প্রথমে প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও জেলা বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে আনে। তখন থেকে প্রবীণ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হতো। বেগম খালেদা জিয়া সরকার গঠনের পর থেকে শুরু হয় বহিরাগতদের শতকরা ৩৫ ভাগ প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ। এ প্রক্রিয়া চলছে।

পদোন্নতির মাধ্যমে ৬৫ ভাগ প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দীর্ঘ ৮ বছর ধরে বন্ধ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারিদের পদোন্নতি বন্ধ রেখে বহু শিক্ষক অবসর গ্রহণ ও প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি না পাওয়ার ক্ষোভ ও বেদনা নিয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। শিক্ষকদের অধিকার হরণের নানা ফাঁক ফোকর দেখিয়ে বঞ্চিত করা হচ্ছে। উচ্চ আলাদত শিক্ষকদের পক্ষে রায় দেওয়ার পরেও চলছে সময়ক্ষেপণের নানা ধরনের তালবাহানা।

কতিপয় ব্যক্তির হীন স্বার্থে পরিবর্তন করা হয়েছে বদলী নীতিমালা। সারা দেশের বদলী দায়িত্ব যেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রীর। ভাবখানা দেখে মনে হচ্ছে মন্ত্রণালয়ের হাতে তেমন কোনো কাজ নেই। মনে হয় যেন প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের সকল সমস্যা শেষ করে প্রজাতন্ত্রে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মচারীরা বসে বসে বেতন পাচ্ছেন। এমন ধরনের কর্মকান্ড আমরা পত্যক্ষ করেছিলাম এরশাদ সরকারের প্রথম দিকে ড. মজিদ খানঁ শিক্ষা মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে। মন্ত্রী মহোদয় শুধু ুবং লিখে দিলে শিক্ষকতা চাকুরি পেয়ে যেতেন।

পরবর্তীতে বিএনপি সরকারের আমলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপিকা জাহানারা বেগম বদলীসহ সকল কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করতেন। এসব কর্মকা- অতীতের মত বর্তমানেও একশ্রেণির লোক বিশেষ করে সমিতির নেতৃবৃন্দ মহৎ কাজ হিসেবে বেছে নিয়েছে। বর্তমানে বদলীর পিছনে দৌড়ানো ভুক্তভোগীরা ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা খরচ করেছে বলে গুঞ্জন রয়েছে। মন্ত্রণালয় তথা সমিতির নেতাদের বদলীর চাপে হারিয়ে যেতে বসেছে, সহকারি শিক্ষকদের পদোন্নতি, প্রধান শিক্ষকদের একধাপ নিচে সহকারীদের বেতন স্কেল, প্রধান শিক্ষকদের ২য় শ্রেণির মর্যদার গেজেট, করসপেন্ডিং স্কেল, প্রধান শিক্ষকদের ৮০০০ টাকা বেতন স্কেল, পুল শিক্ষকদের মানবেতর জীবন-যাপনসহ তাঁদের ওপর বিমাতা সুলভ আচরণ। সহকারীদের পদোন্নতি নিয়ে মন্ত্রণালয় তথা সংশ্লিষ্টদের যেন ভাবনাহীন ভাবে বসে আছে।

এ পদোন্নতি নিয়ে কোন আইনগত জটিলতা থাকলে, প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরামের পক্ষ থেকে আপাতত সিনিয়র সহকারী শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষকের চলতি দায়িত্ব দেওয়ার অভিমত দিয়েছে। এ বিষেয়ে কোন কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়। বরং ইদানিং ৮৯৮ জন শিক্ষক নন ক্যাডারকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাদের নন ক্যাডার হিসেব অন্য কোন পেশায় নিয়োগ দেওয়া হয়তো সম্ভব না হওয়ায় এ পেশায় নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এ পেশায় শিক্ষকতার মানসিকতা নিয়ে তারা কতটুকু এগিয়ে আসবে জানি না?

তবে তারা অন্য চাকুরি সুযোগ না থাকায় শিক্ষকতা পেশা হিসেবে না হলে চাকুরি হিসাবে গ্রহণ করবে। যেহেতু তারা সকলে ট্রেনিং বিহীন জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী তাদের বেতন হওয়ার কথা ১১ হাজার ৩০০ টাকা। তাদের বেশিরভাগের বয়স ৩০ এর নিচে, প্রাথমিকের সহকারিদের ৩০ থেকে ৩৫ বছর ধরে অপেক্ষা করে বসে আছে পদোন্নতির অপেক্ষায়। এ অপেক্ষা যেন শেষ হওয়ার কোন লক্ষণ নেই। নিজের ছাত্রের সমতুল্য অধীনে সহকারি শিক্ষক হিসেবে কাজ করা যে কী দুঃসহ যন্ত্রণা ভুক্তভোগী ছাড়া আর অন্য কারো উপলব্ধি হবে কিনা জানি না? অনেকটা নীরবতার মাঝে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শিশুকাল থেকে জঙ্গি কার্যক্রম অঙ্কুরেই নির্মুল করার প্রত্যয় নিয়ে অষ্ঠম শ্রেণি পর্যন্ত নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় কার্যক্রম।

সাধারণতঃ নৈতিক শিক্ষা কার্যক্রমের লক্ষ্য সৎ, বিনয়ী, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, যার যার ধর্ম, মত প্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠা, বড়দের শ্রদ্ধা ও ছোটদের স্নেহ করা ইত্যাদি গুণাবলি অর্জন করানো। যাতে আজকের শিশু বড় হয়ে আদর্শ মানুষ হতে পারে। অথচ শিশু যখন বড়দের শ্রদ্ধা করা শিখবে এবং বাস্তবে দেখবে ৩০ থেকে ৪০ বছরে অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ বয়স্ক শিক্ষক সন্তান তুল্য প্রধান শিক্ষকের আদেশ নির্দেষ মেনে চলে এবং উল্টা তাদের সম্মান করে। তখন তার নৈতিক শিক্ষার বাস্তবতা যেন ষোল আনাই মিছে হয়ে যায়। উচ্চ শিক্ষিত মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসুক এটা সকলের প্রত্যাশা। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ৯৫ শতাংশ অনার্স মাস্টার্স ডিগ্রি ধারী। বেশির ভাগই সি,ইন,এড/বি,এড, এমএড সহ সকল বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। নন ক্যাডার বহিরাগতরা শিক্ষকতা পেশায় আসার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। তাদের বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষকতায় বাধ্য করা হচ্ছে।

শুধু প্রধান শিক্ষক নহে প্রাথমিকের কর্মকর্তাদের সকল পদে অনাভিজ্ঞ লোকদের নিয়োগ দেওয়া হয়। যার ফলে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন শিক্ষকদের শিক্ষক হিসেবে অনভিজ্ঞরা প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালনা করে থাকেন। যার ফলে প্রাথমিক শিক্ষার কাক্সিক্ষত উন্নতি হোঁচট খাচ্ছে। সকল পেশায় ক্যাডার আছে। অথচ প্রাথমিক শিক্ষায় ক্যাডার নেই। এ প্রসঙ্গে সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও বর্তমানে প্রাথমিকও গণশিক্ষামন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. মোতাহার হোসেন আক্ষেপ করে বলেন, গরু ছাগলেরও ক্যাডার আছে অথচ প্রাথমিক শিক্ষার কোন ক্যাডার নেই। এত বড় জনগোষ্ঠী ও বড় প্রশাসন মুখ থুবড়ে পড়ছে নিজস্ব ক্যাড়ারের অভাবে। প্রাথমিক শিক্ষায় অনাভিজ্ঞ ভিন্ন পেশার ক্যাডার দিয়ে চলছে প্রাথমিক শিক্ষা। সকলে যেন, নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। হতভাগা প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের নিয়ে ভাবনা যেন কারো নেই। এ মুহুর্তে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে আজকের দিনে সকল অনাভিজ্ঞ লোকদের প্রাথমিক শিক্ষায় নিয়োগ বন্ধ করে স্বতন্ত্র প্রাথমিক শিক্ষার ক্যাডার গঠন প্রয়োজন। পাশাপাশি তৃণমূল পর্যায় থেকে সহকারি শিক্ষকদের নিয়োগ দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষার সর্বোচ্চ পদ পর্যন্ত শতভাগ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা হোক।

শতভাগ অভিজ্ঞ জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার হতাশা, বেদনা, ক্ষোভ দূর হবে। পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষার আশাব্যঞ্জক সফলতা বয়ে আনবে। প্রাথমিক শিক্ষার স্বতন্ত্র ক্যাডারসহ সহকারি শিক্ষকদের থেকে শুরু করে শতভাগ পদোন্নতি হোক সকল শিক্ষক সংগঠন ও কর্মকর্তাদের দুর্বার আন্দোলন। এ আন্দোলন হবে হতভাগা প্রাথমিক শিক্ষাকে রক্ষার আন্দোলন। প্রাথমিক শিক্ষা সফলভাবে চললে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী উপকৃত হবে। দেশ দ্রুত উন্নত বিশ্বের সাথে পাল্লা দিয়ে চলবে। নৈতিক শিক্ষার পরিপন্থী কার্যক্রম বন্ধ হবে।

সুধি সমাজ ও দেশের শিক্ষাবিদ সকলকে প্রাথমিক শিক্ষার এ আন্দোলনে শরিক হওয়ার আহ্বান জানাই। বঙ্গবন্ধু যেমন ১-৭-৭৩ সালে শূন্য হাতে বিশাল প্রাথমিক শিক্ষাকে সরকারি করণ করে এদেশের সাধারণ মানুষের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করেছেন। জননেত্রী শেখা হাসিনা সরকারও সহকারী শিক্ষক থেকে শতভাগ পদোন্নতি ও প্রাথমিক শিক্ষার স্বতন্ত্র ক্যাডার সৃষ্টি করে প্রাথমিক শিক্ষার বর্তমান হ-য-ব-র-ল অবস্থা থেকে মুক্তি দেবেন। সাবেক প্রতিমন্ত্রীর মতো সকলের মাঝে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে ভাবনার উদয় হোক। প্রাথমিকের শিক্ষক সংগঠনগুলোর মাঝ থেকে সকল ব্যবসায়ী মনোবৃত্তি দূর হোক। শিক্ষকদের নিয়ে ভাবনা হোক সকলের। প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারে সকলের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে আজকের প্রাথমিক শিক্ষা দ্রুত এগিয়ে চলুক। এটাই প্রত্যাশায়।

লেখক: আহবায়ক, প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম।

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029549598693848