আমার মনে আছে, আমার এক সহকর্মী, যিনি কর্তৃপক্ষের খুব আস্থাভাজন ছিলেন, ষষ্ঠ শ্রেণির ইংরেজি প্রশ্ন করেছেন। সেখানে রচনা লিখতে দিয়েছিলেন ‘আমেরিকান ইনভ্যাশন অব ইরাক’, বিকল্প হিসেবে দিয়েছিলেন ‘টু ইয়ার্স সাকসেস অ্যান্ড ফেইলিওর অব বিএনপি গভর্নমেন্ট।
’ প্রশ্ন দেখে আমি অবাক! এই প্রশ্ন সাধারণত গ্র্যাজুয়েশন লেভেল, সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা কিংবা যাঁরা আন্তর্জাতিক রিলেশন ও পলিটিক্যাল সায়েন্সে পড়াশোনা করেন তাঁদের জন্য। সেই প্রশ্ন তিনি দিয়েছিলেন কোমলমতি ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের। আমি বলেছিলাম, শিক্ষকদের মধ্যে কয়জন এই রচনা ইংরেজিতে লিখতে পারবেন যে আপনি ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের এ ধরনের রচনা লিখতে দিয়েছেন? যা হোক, তিনি যেহেতু কর্তৃপক্ষের আস্থাভাজন ছিলেন তাই কোনো সমস্যা হয়নি। তবে এখানে যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে সেগুলে হচ্ছে—ক. আমরা চাইল্ড সাইকোলজি নিয়ে চিন্তা করি না বা বোঝার চেষ্টা করি না; খ. কোন বয়সের বাচ্চাদের কী ধরনের প্রশ্ন করতে হবে, পড়াতে হবে তা আমরা চিন্তা করি না এবং গ. এই শিক্ষক জানতেন যে শিক্ষার্থীরা এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর লিখতে পারবে না, তাদের শিক্ষকদের কাছে আসতে হবে। এই উদ্দেশ্যে এ ধরনের প্রশ্নপত্র তৈরি করা হয়। আমার শিক্ষকতা জীবনে এবং এখনো শিক্ষা নিয়েই কাজ করি, এ ধরনের সমস্যার ব্যাপকতা আরো বেড়েছে।
চলমান প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার (২০১৭) সিলেট অঞ্চলের ইংরেজি ভার্সনের বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচিতি বিষয়ের পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ৫০টির বেশি ভুল ধরা পড়েছে। নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের মধ্যে ৪০টিতেই ভাষা ও ব্যাকরণগত ভুল পাওয়া গেছে। প্রশ্নপত্রে অন্তত ২০টি বাক্য ও অনেক বানান ভুল রয়েছে।
এ ছাড়া অনেক প্রশ্নপত্রের বহু প্রশ্ন পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত নয়, অথচ তাদের জন্য সেটা করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক প্রণব কান্তি দেব। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি এটাই প্রমাণ করে যে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তামাশা করছি। বড় পরিসরে প্রথমবার পরীক্ষা দিতে এসে কোমলমতি শিশুরা এমনিতেই মানসিক চাপে থাকে। এর মধ্যে প্রশ্নপত্রের ভুল তাদের জন্য সামগ্রিক পরিস্থিতিকে আরো কঠিন করে তোলে। ’
পরীক্ষা যখন মেধা যাচাইয়ের একটি অংশ, তখন যদি প্রশ্নপত্রেই ব্যাপক ভুল থাকে তাহলে কি মেধা যাচাই করা হচ্ছে? একদিকে প্রশ্নপত্রে ভুল, অন্যদিকে জালিয়াতি এবং প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা থেকে শুরু করে নানা মাত্রার অনিয়ম হচ্ছে শিক্ষা ক্ষেত্রে। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্ন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ) তৈরি করে থাকে। নির্ধারিত প্যানেলভুক্ত শিক্ষক-কর্মকর্তাদের মাধ্যমে প্রথমে ছয়টি বিষয়ের প্রতিটির জন্য ৬৪ সেট প্রশ্ন করা হয়। প্রথমে বাংলায় প্রশ্নগুলো করা হয়, পরে অনুবাদ করে ৬৪ সেট ইংরেজি ভার্সনের প্রশ্নপত্র করা হয়। সেখান থেকে বাংলায় ৩২ সেট ও ইংরেজি ভার্সনের ৩২ সেট প্রশ্ন বাছাই করা হয়। সেগুলো পরে সিলগালা করে প্যাকেটের মাধ্যমে পাঠানো হয় বিজি প্রেসে। সেখানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, নেপ ও বিজি প্রেসের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে আট সেট প্রশ্নপত্র লটারির মাধ্যমে বাছাই করে ছাপা হয়। বাকি প্রশ্নপ্রত্র সেখানেই পুড়িয়ে ফেলা হয়। পরে ওই আট সেট প্রশ্নপত্রে বিভিন্ন অঞ্চলের পরীক্ষা নেওয়া হয়। এত কিছুর পরও প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। কারণ এগুলো সবই অ্যানালগ সিস্টেম আর প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে ডিজিটাল সিস্টেমে। পরীক্ষার আগের রাতেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ ও পেজে প্রশ্ন-উত্তর পাওয়া যাচ্ছিল। এত দিন টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র কেনাবেচা হতো এবার তা পাওয়া যাচ্ছে বিনা মূল্যে। সপ্তাহখানেক আগে শেষ হওয়া জেএসসির প্রায় সব কয়টি পরীক্ষার প্রশ্ন পাওয়া গিয়েছিল কয়েকটি ফেসবুক গ্রুপ ও পেজে।
প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে খেলাধুলা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক কার্যক্রম যুক্ত করার পাশাপাশি এই স্তরে পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিলে পরামর্শ দেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য ভালো শিক্ষা পাওয়া। শুধু প্রথম হওয়া নয়। গোটা শিক্ষাব্যবস্থা এখন পরীক্ষাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। প্রাথমিক স্তরে পরীক্ষার কোনো আবশ্যকতা নেই। বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থা শোচনীয়। এখানে শিশুদের পরীক্ষার নামে রীতিমতো পীড়ন করা হচ্ছে। এতে বিন্দুমাত্র আনন্দযোগ নেই। শিক্ষাব্যবস্থা এখন পরীক্ষাসর্বস্ব। জ্ঞান ও শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষার্থীর সম্পর্ক আমরা নষ্ট করে ফেলেছি। শিক্ষা কমিশন যখন ছড়া, চারুকলা, নৃত্য শিক্ষাব্যবস্থায় যোগ করার কথা বলছে, তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো ভাবনাচিন্তাই নেই। শিশুকে তার চিন্তার স্বাধীনতা দিতে হবে। ওর ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে না দিয়ে সে কী বলতে চায়, তা শুনতে হবে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ নিয়ে শিশুরা নিজেরা কী ভাবছে, তা আমাদের শুনতে হবে। ’
শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীর নৈতিকতা আর মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটিয়ে উন্নত চরিত্র গঠন করা। সেখানে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা বাণিজ্য, দুর্নীতি, শিক্ষকদের অনৈতিক কোচিং বাণিজ্য আর প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা কি নীতিহীনতার শিক্ষা দিচ্ছে না? দুর্নীতি, অন্যায় আর অপরাধমূলক ক্রিয়াকলাপের শিক্ষা তারা একধরনের প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই লাভ করছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের পেছনে সরকারসহ এক শ্রেণির অভিভাবকও কম দায়ী নন। তারা মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে প্রশ্নের পেছনে ছুটছেন। এই সুযোগটি নিচ্ছে আরেকটি কুচক্রী ও দুর্নীতিপরায়ণ মহল। সামাজিকভাবে মেধা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের পরিবর্তে এ+ প্রাপ্তির ওপর আমরা অধিকতর গুরুত্ব দিচ্ছি। শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ হলো কি না, নীতি-নৈতিকতা শিখছে কি না তা আমরা মূল্যায়ন করছি না। মেধা যাচাইয়ের ইন্ডিকেটর অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে। পাবলিক পরীক্ষার ফল অবশ্যই এর মধ্যে একটি, তবে প্রচলিত পদ্ধতিতে এ যেন আর কাজ করছে না। বিকল্প চিন্তা ও পদ্ধতি অবশ্যই বের করতে হবে।
শিক্ষাদান ও গ্রহণ একটি মানসিক প্রক্রিয়া। এখানে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া বা আরোপ করার অর্থ হলো শিক্ষার্থীর মেধা বিকাশ বাধাগ্রস্ত করা। তাই শিক্ষার্থীরা যেন আনন্দের সঙ্গে শিক্ষালাভ করতে পারে সে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা একান্তই প্রয়োজন। আনন্দের সঙ্গে শিক্ষাদানের কথা আমরা শুনে আসছি সর্বক্ষণই কিন্তু কারা করবেন সে ধরনের শিক্ষাদান? আমাদের সীমিত সম্পদ দিয়ে কিভাবে আনন্দদায়ক শিক্ষাদান করবেন শিক্ষকরা, সেই প্রশিক্ষণ কি তাঁদের আছে? তা ছাড়া সরকারের নানা মাত্রিক দুর্বলতার কারণে সর্বত্র গড়ে উঠছে ব্যবসায়িক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কে দেখবে এসব?
এখানে আর একটি বিষয় লক্ষণীয়। আর সেটি হচ্ছে নতুন প্রজন্ম এখন বড় হচ্ছে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দেখে, তার উত্তর শিখে পরীক্ষা দিয়ে। তারা তার পুরস্কারও পাচ্ছে। কারণ অল্প পরিশ্রমেই পরীক্ষায় ভালো করছে। অন্যদিকে যারা নৈতিকতা আঁকড়ে ধরে থাকছে, ফাঁস করা প্রশ্ন না দেখে পরীক্ষা দিচ্ছে, তারা পিছিয়ে পড়ছে পাবলিক পরীক্ষায়। একসময় তারা হয়তো হতাশ হয়ে নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে নিজেদের ভাসিয়ে দেবে গড্ডলিকা প্রবাহে। অনেক অভিভাবক এখনই মনে করছেন যে প্রশ্ন ফাঁস, প্রশ্ন ক্রয় বিষয়টি যেহেতু সবাই করছে, অতএব এতে কোনো অন্যায় নেই। বরং এটি না নেওয়াটাই বোকামি। এই পরিস্থিতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমরা কি তা ভেবে দেখব না?
লেখক: মাছুম বিল্লাহ, লেখক শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত।