সম্প্রতি জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন সংক্রান্ত সভায় বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বর্ধিত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে ২০১৮ সালের মধ্যে বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বর্ধিত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। তারই অংশ হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করে। এখন সাক্ষরতা মানে কেবল পড়তে, লিখতে ও গণনা করতে পারাই নয়; এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অধিকার সচেতনতা, অভিযোজন ক্ষমতা, যোগাযোগ দক্ষতা ইত্যাদি। প্রাথমিক শিক্ষার স্তর বৃদ্ধির বিষয়টিও একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও প্রাথমিক শিক্ষার স্তর বৃদ্ধি যুক্তিসঙ্গত। বাংলাদেশ এমডিজি অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করেছে। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী ভর্তি এখন প্রায় শত ভাগ, ঝরে পড়ার হারও কম। বিশ্বের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ—টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি। এসডিজি-র অন্যতম লক্ষ্য—মানসম্মত শিক্ষা প্রদান এবং জীবনব্যাপী ও অব্যাহত শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা। প্রাথমিক শিক্ষার স্তর বৃদ্ধি পেলে অবশ্যই জীবনব্যাপী ও অব্যাহত শিক্ষার সুযোগও বৃদ্ধি পাবে। এসডিজি-তে আরো বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ১২ বছরের প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক করতে হবে। ফলে বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার স্তর বৃদ্ধি এসডিজি বাস্তবায়নেরই একটি ধাপ।
প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বর্ধিত করতে হলে সরকারকে বেশকিছু চ্যালেঞ্জও মোকাবেলা করতে হবে। সরকারি বা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক সংকট রয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নতুন তিনটি শ্রেণির জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষক প্রয়োজন। বিদ্যমান শিক্ষকদের মধ্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের সংখ্যা আরো কম। তাই তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বিপুল সংখ্যক শিক্ষককে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান ও শিক্ষাপদ্ধতির প্রশিক্ষণ দিতে প্রচুর শিক্ষা-গ্র্যাজুয়েট প্রয়োজন হবে। যার জোগান দিতে আপাতত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন নতুন শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট চালু করতে হবে। যে শিক্ষা-গ্র্যাজুয়েটরা পিটিআই, টিটিসিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে পারবে। শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষকদের যোগ্যতার প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। প্রাথমিক স্তরে যাঁরা শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁরা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাদান করতে পারবেন কি না, ভেবে দেখতে হবে। অতিরিক্ত তিনটি শ্রেণিতে পাঠদান করার কারণে তাঁদের বেতনভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির বিষয়টিও বিবেচনার দাবি রাখে।
তিনটি শ্রেণিকে প্রাথমিক স্তরে অন্তর্ভুক্ত করতে পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষাক্রম প্রণয়নে দর্শনগত পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। স্কুলগুলোতে বিশেষত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শ্রেণিকক্ষ বাড়ানো, লাইব্রেরি, শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হবে।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা মোটাদাগে তিনটি ধারায় বিভক্ত—বাংলা, ইংরেজি ও মাদ্রাসা। তিনটি ধারায় প্রাথমিক শিক্ষার নতুন স্তর চালু করার ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হতে পারে। প্রাথমিক স্তর পরিচালনা ও পরীবীক্ষণের দায়িত্ব প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এবং মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিছ ুকিছু স্কুল শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে পঞ্চম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত। ফলে একাডেমিক ও অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে একই প্রতিষ্ঠান দুটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে সমন্বয়হীনতার চক্রে পড়তে পারে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১৭ সাল থেকে পঞ্চম শ্রেণি শেষে পিএসসি পরীক্ষা হচ্ছে না; এটি হবে অষ্টম শ্রেণি শেষে। এই পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে প্রশ্নপত্রের মান বজায় রাখা এবং গাইডবই-কোচিং সেন্টার নির্ভরতা কমাতে গ্রহণ করতে হবে বিশেষ পদক্ষেপ। নিশ্চিত করতে হবে, সম্মানিত শিক্ষকগণ যেন ক্লাসরুমে পাঠ্যবই পড়ানোর প্রতি মনোযোগ দেন। খেয়াল রাখতে হবে, পাবলিক পরীক্ষাগুলোর প্রশ্নের ধরনে মিল থাকলেও প্রশ্নের যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে এবং গাইডবইয়ের সঙ্গে যেন মিলে না যায়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—শিক্ষার বাজেট। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা বাংলাদেশে বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বিনাবেতনে শিক্ষার্থীরা পড়ছে। পাশাপাশি নানান উপবৃত্তি ও মেয়েদের বিনামূল্যে লেখাপড়ার ব্যবস্থা করছে সরকার। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক স্তর বর্ধিত করা হলে, পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষাক্রম প্রণয়ন, শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ, শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ এবং অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন করতে শিক্ষা খাতে বাজেটের বড় একটি অংশ বরাদ্দ করতে হবে। বিশ্বের শিক্ষাবিশেষজ্ঞ মহলে শিক্ষাখাতে জিডিপি-র ৬% ও বাজেটের ২০% বরাদ্দের বিষয়টি স্বীকৃত হলেও বাংলাদেশ এখনো এদিক থেকে পিছিয়ে। বাংলাদেশে এখনো শিক্ষাখাতে জিডিপি-র ২.৫% এর বেশি এবং বাজেটের ১৬% এর বেশি বরাদ্দ করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ অনেক বেশি। ২০১৬-২০১৭ সালের অর্থবছরে বাংলাদেশে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বাজেট বরাদ্দ স্মরণকালের সর্বোচ্চ ১৫.৬%। প্রযুক্তিখাতের বরাদ্দ বাদ দিলে যা খুব বেশি হবে না। তাই দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে অনুত্পাদনশীল খাতে কিছুটা কমিয়ে হলেও শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতেই হবে।
চট্টগ্রাম থেকে