ফরমালিনযুক্ত শিক্ষকতা জাতি ধ্বংসের হাতিয়ার - দৈনিকশিক্ষা

ফরমালিনযুক্ত শিক্ষকতা জাতি ধ্বংসের হাতিয়ার

মুন্নাফ হোসেন |

শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ডহীন মানুষ যেমন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতির শিখরে পৌছতে পারে না। কিন্তু শিক্ষায় যদি ফরমালিন ঢুকে যায়, তাহলে জাতির পরিপাকতন্ত্র শ্বাসনালি জ্বালাপোড়া করবে। রক্তের এসিডিটি বাড়িয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস অস্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করে। কিডনি, লিভার ও বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট, বিকলাঙ্গতা, এমনকি মরণব্যাধি ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে শারীরিক বৃদ্ধিসহ মস্তিষ্কের বিকাশও থেমে যায়। এমনকি মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ নষ্ট হওয়ার আশষ্কা থাকে।

বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ হলেও রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস, রয়েছে অপরুপ প্রকৃতি। এমন একটি সুন্দর দেশে শিক্ষাব্যবস্থায় হযবরল অবস্থা মেনে নেয়া যায় না। শিক্ষক হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর যার স্পর্শে গড়ে উঠে সুন্দর সমাজ, সুন্দর ভবিষ্যৎ। কিন্তু সনদ কিনে যে শিক্ষক শিক্ষকতা করে তার নিকট থেকে নৈতিক শিক্ষা আশা করা যায় না। জালসনদে বেশুমার শিক্ষকতায় ফরমালিন প্রতিনিয়ত জাতিগঠনে অন্তরায়। দেশে জাল সনদের মহোৎসব চলছে। লাগামহীন জালসনদধারী শিক্ষকরা দেশকে পেছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। শুধু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই নয়, সরকারি প্রতিষ্ঠানেও অনেকে জালসনদে চাকরি করছেন।

২০০৫ খ্রিস্টাব্দে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়েছিল এনটিআরসিএ। কিন্তু উদ্দেশ্য সফল হয়নি। কেননা এনটিআরসিএ টাকার বিনিময়ে লক্ষাধিক সনদ বিক্রি করেছে। সেই জালসনদে চাকরিও করছে অনেকে। এমন শিক্ষকের কাছ থেকে প্রকৃত শিক্ষা আশা করা যায় না। ফরমালিনযুক্ত শিক্ষকরা নিজেরাই নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত নন। জাল সনদে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ ও এমপিওভুক্তি চলছেই। নিয়োগ পাওয়া জাল সনদধারীদের চিহ্নিত করার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)। নানা অভিযোগে অভিযুক্ত হলেও ডিআইএর কতিপয় পরিদর্শক ও সহকারি পরিদর্শকের অনুসন্ধান ও তদন্তে ধরাও পড়ছে জালিয়াতরা। তাদের সুপারিশ অনুযায়ী এমপিও বন্ধও হচ্ছে। কিন্তু কোনো না কোনোভাবে কয়েকমাস বা বছরের ব্যবধানে আবার এমপিও ফেরত পাচ্ছেন, চাকরিতে পুনর্বহাল হচ্ছেন।

ডিআইএর কর্মকর্তাদের দাবি, বিধান অনুযায়ী ডিআইএর প্রতিবেদন ত্রিপক্ষীয় সভার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে তা করা হয় না। অধিকাংশই ছাড় পেয়ে যাচ্ছে। ছাড় দেয়ার অভিযোগের তীর শিক্ষা অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের আইন ও অডিট শাখার কতিপয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এক শ্রেণির দালালও তো রয়েছেই।

ডিআইএ গত কয়েক বছরে জাল সনদে নিয়োগ পাওয়া এক হাজারের বেশি শতাধিক শিক্ষক চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে শুধু ১৯ মাসেই চিহ্নিত হয়েছে ৫ শতাধিক। এই হিসাব থেকে ডিআইএর কর্মকর্তারা অনুমান করছেন, সারা দেশের ৩০ হাজার প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন শেষে আরও ১০ হাজারের বেশি জাল সনদধারী শিক্ষক চিহ্নিত হতে পারে। এর আগে ২০০৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ৬ হাজার জাল সনদধারী চিহ্নিত করে ডিআইএ কিন্তু অধিকাংশই এমপিও ফিরে পায়, চাকরিও করছেন দিব্যি।

সাম্প্রতিক এক হিসেবে দেখা গেছে, নিবন্ধন সনদের বৈধতা যাচাইয়ের জন্য ডিআইএ থেকে চিঠি দেয়ার পর বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) জবাব দিচ্ছে। সম্প্রতি এনটিআরসিএ কর্তৃপক্ষ জালসনদে চাকিরত শিক্ষকদের সনদ যাচাই করে প্রায় নব্বই ভাগ সনদ জাল পেয়েছেন। জালসনদধারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছেন। এটা কি লোক দেখানো নয়? যে প্রতিষ্ঠান জালসনদ বিক্রি করেছে, তারা কি উপযুক্ত শাস্তি দিতে পারবেন? পারবেন না। কেননা জালসনদ খুজতে গিয়ে নিজেরাই গর্তে পড়ে যাচ্ছেন।

দেশের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের পদ শূণ্য রয়েছে, যার কারণে শিক্ষাব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে। এদিকে কয়েক লাখ নিবন্ধনসনদধারী বেকারেরা চাকরির আশায় প্রহর গুনছেন কিন্তু ফলাফল পাচ্ছেন না। আদালতের দারস্থ হয়েও আশার বাণী নিভৃতে কাঁদছে। কেন এই প্রহসন? জাতিকে কেন ধ্বংস করা হচ্ছে?

সম্প্রতি চলমান এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের পেছনেও জড়িত জালসনদধারী শিক্ষকরা। কেননা জালসনদধারীরা ক্লাসে পড়াতে অক্ষম। সারা বছর ক্লাস না করিয়ে কোচিং বাণিজ্যে মেতে থাকে। তাই পরীক্ষা আসলেই শুরু হয় ভেজাল শিক্ষকদের দৌড়াদৌড়ি। এ দৌড়ে অনেক ভেজাল অভিভাবককেও দেখা যায়। কতটুকু নীতিহীন হলে নিজের সন্তানকে ফাঁস প্রশ্ন তুলে দেওয়া যায় তা আমার বিবেকে ধরে না।

বিবেক হচ্ছে মানুষের প্রকৃত আদালত। সে আদালতে আমরা সবাই কমবেশি অপরাধী। আমাদের সামান্য ভুলের কারণে জাতি অন্ধকারে ডুবতে পারে না। ফরমালিন মার্কা শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান হতে বিতাড়িত করতে না পারলে দেশ কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে; জাতি হবে মেধাশূণ্য। শিক্ষামন্ত্রণালয় জরুরী পদক্ষেপ না নিলে বড় ধরণের ক্ষতি হয়ে যাবে। তাই এ ব্যাপারে সচেতন সমাজও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আসুন, হাতে হাত মিলিয়ে দেশকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলি। একটি শান্তিময় জাতিগঠনে সকলে এগিয়ে আসি- এটাই হোক সকলের অঙ্গীকার।

লেখক : সহকারী শিক্ষক
মোহাম্মদ নগর উচ্চ বিদ্যালয়,ফুলবাড়ীয়া, ময়মনসিংহ।

[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন]

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0069801807403564