বই কেনা, বই পড়া ও বইমেলা - দৈনিকশিক্ষা

বই কেনা, বই পড়া ও বইমেলা

মাছুম বিল্লাহ |

কোন জাতি সভ্যতার কোন সোপানে অবস্থান করছে, তা পরিমাপ করা হয় সেই জাতির পাঠাভ্যাস ও গ্রন্থাগারের মাপকাঠি দিয়ে। সভ্যতার এই পরিমাপটি যুগ যুগ ধরে স্বীকৃত হয়ে আসছে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে-অর্থনীতিতে। উন্নত দেশগুলোতে পাঠাগারের নান্দনিক অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। কোনো কোনো দেশের সমৃদ্ধ লাইব্রেরিগুলোকে বলা হয়ে থাকে ত্রিকালের সিঁড়ি বা জীবিত ও পরলোকগত মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। বিজ্ঞানের অনেক উন্নতি হয়েছে আর সেসব উন্নতির ঢেউ আমাদের দেশে লেগেছে। কিন্তু এত পরিবর্তনের স্রোতের মুখেও বইয়ের প্রতি মানুষের আকর্ষণ এখনো বিলুপ্ত হয়নি। বই পড়ার বিকল্প তৈরি হয়নি। ছাপার অক্ষরের পরিবর্তে এসেছে ‘ই-বুক’। যে প্রকরণেই থাকুক না কেন, বই থেকে যাবে। আমরা জ্ঞাননির্ভর যে সমাজের কথা বলি, তা নির্মাণে বই পাঠের কোনো বিকল্প নেই। বই পাঠের অভ্যাস বাড়াতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন পাঠাগারের সংখ্যা বাড়ানো এবং সেসব পাঠাগারে পাঠের সুযোগ বাড়ানো। আমাদের বর্তমানের পাঠাগারগুলোকে যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে।

গ্রন্থাগার মানুষের জীবনে এক শাশ্বত আলোর উৎস, যা আলোকিত করে তোলে মানুষকে আর তাদের আলোয় আলোকিত হয় সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব। গ্রন্থাগার প্রকৃত অর্থেই দেখাতে পারে আলোর ঠিকানা। নেশার কবল থেকে মানুষকে ফেরাতে পারে সুস্থ জীবনে। শেখাতে পারে বাস্তবতা এবং মুক্ত ও মানবিক চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করে নির্মূল করতে পারে ধর্মীয় গোঁড়ামি, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও মানসিক বিকাশে প্রতিটি স্কুল, কলেজ, ইউনিয়ন, গ্রাম, পাড়া-মহল্লায় গ্রন্থাগার স্থাপন করা দরকার। সেখানে সব বয়সের মানুষ পত্রিকা, গল্প, উপন্যাস, ধর্মীয় বই, খেলাধুলার বই, ভ্রমণকাহিনি, বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনীগ্রন্থ পড়ার সুযোগ যাতে পায়। এভাবে পাঠাভ্যাস গড়তে পারলে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হবে সৃজনশীল চেতনার। খারাপ সঙ্গ, নেশা, আড্ডা এগুলো তারা বাদ দিয়ে পড়ার জগতে, বইয়ের জগতে প্রবেশ করবে। গ্রন্থাগারই তাদের দেখাতে পারবে সঠিক আলোর ঠিকানা, উদ্বুদ্ধ করবে মানবিক চেতনায়। তাই জ্ঞান, আলো ও হৃদয়ের প্রশান্তির জন্য বই হোক শ্রেষ্ঠ বন্ধু এবং বই হোক নিত্যদিনের সঙ্গী।

আমাদের সমাজে বর্তমানে খেলার মাঠ, বিনোদন কেন্দ্র, গ্রন্থাগার ইত্যাদির রয়েছে যথার্থ অপর্যাপ্ততা। ফলে ছাত্রছাত্রী ও তরুণ প্রজন্ম প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত চাপ, পুরনো ধাঁচের শিক্ষাব্যবস্থা ও মুখস্থ বিদ্যার প্রভাবে ছেলেমেয়েদের মধ্যে অল্প বয়সেই পড়াশোনার প্রতি এক ধরনের অনীহা সৃষ্টি হয়। বই পড়ার প্রতি আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আগ্রহী করে তোলার জন্য আমাদের প্রাণের মেলা, বইমেলা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, আমাদের সৃজনশীল প্রকাশকরা, স্বনামধন্য ও নতুন নতুন লেখক প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করছেন।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ৩৯ বছর ধরে সারা দেশে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের জন্য বইপড়া কর্মসূচি চালিয়ে আসছে। বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ১২ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ২০ লাখ ছাত্রছাত্রী এই কর্মসূচির সদস্য। ২৩ এপ্রিল আন্তর্জাতিক বইপড়া উৎসব পালিত হয়। ওই দিন সারা দেশে একসঙ্গে প্রায় ১০ লাখ পাঠককে উপহার দেওয়া হবে এবার। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের উদ্যোগে ২০১৬ সালে বইপড়া কর্মসূচিতে ঢাকা মহানগরীর ১১১টি স্কুল থেকে অংশগ্রহণকারী মূল্যায়ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়েছে কিছু দিন আগে। বইপড়া কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে আজিমপুর গার্লস স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী সুমাইয় ইসলাম বলছিল, ‘বই পড়তে ভালো লাগে বলে প্রতিযোগিতায় অংশ নিই। পুরস্কার পাওয়ায় ভালো লাগাটা আরো বেড়ে গেল। ’

বই পড়া সম্পর্কে বিল গেটস  বলেছেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমার অনেক স্বপ্ন ছিল। আর এই স্বপ্ন পেয়েছিলাম বই থেকে। আপনারা যদি আমার ঘরে যান, দেখবেন বই; অফিসে যান, দেখবেন বই, যখন আমি গাড়িতে থাকি, আমার সঙ্গে থাকে বই। ’ আজকাল ছেলেমেয়েরা যারা সফল হতে চায়, বড়লোক হতে চায়, নাম করতে চায়, মানুষের উপকার করতে চায় বিল গেটসের এই উপদেশ তাদের কাজে লাগবে। আমরা যদি মাসে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকার মোবাইল বিল দিতে পারি, তাহলে বছরে কেন দুই হাজার টাকার বই কিনব না? স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে বই দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হোক। উদ্যোগের অভাবেই দেশে আশানুরূপ পাঠক বাড়েনি। সত্যিকারের সুনাগরিক সৃষ্টিতে পাঠক তৈরির বিকল্প নেই। পাঠক বৃদ্ধির জন্য, বইয়ের প্রসারের জন্য, সৃজনশীল ও মননশীল সমাজ গঠনের জন্য দেশের সব বিভাগীয় শহরেই অমর একুশে গ্রন্থমেলা আয়োজনের দাবি উঠছে কয়েক বছর ধরে। বিষয়টি নিয়ে কর্তপক্ষকে গুরুত্বসহ ভাবতে হবে।

বইমেলা ও বই প্রকাশে এখনো পুরোপুরি পেশাদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি আমাদের দেশে। আইন অনুযায়ী একজন লেখককে তাঁর প্রকাশকের সঙ্গে অবশ্যই লিখিত চুক্তি করতে হবে এবং তাঁর স্বত্ব কাপিরাইট  নিবন্ধিত হতে হয়। ২০১৬ সালের বইমেলায় বাংলা একাডেমির তথ্য অনুযায়ী  প্রকাশিত হয়েছে তিন হাজার ৪৪৪টি বই। ২০১৫ সালে তিন হাজার ৭০০ বই, ২০১৪ সালে দুই হাজার ৯৫৯টি বই, ২০১৩ সালে তিন হাজার ৭০টি বই। বাংলাদেশ কপিরাইট কার্যালয়ের রেজিস্ট্রার বলেন, ‘গত কয়েক বছরে দেখা গেছে শুধু একুশে গ্রন্থমেলায়ই প্রতিবছর প্রায় সাড়ে তিন হাজার করে নতুন বই প্রকাশিত হচ্ছে। অথচ কপিরাইট নিবন্ধনের পরিমাণ একেবারেই হাতে গোনা। ফলে লেখকরা তাঁদের গ্রন্থস্বত্বের সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কপিরাইট কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মাত্র ১১৩টি সাহিত্যকর্ম কপিরাইট নিবন্ধিত হয়েছে। আগের পুরো বছরে ২৩৬, তার আগের বছর ১৭৫টি। তবে কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি হচ্ছে, যেমন গত দুই বছর থেকে মেলায় শিশুদের মধ্যে বইয়ের পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার জন্য বইমেলায় তাদের জন্য নির্ধারিত দিন ও সময় ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। শিশুদের মতো বৃদ্ধ কিংবা প্রতিবন্ধীদের জন্য এমন নির্ধারিত দিন ও সময় আলাদা করে দেওয়া যেতে পারে। অনেক প্রবীণ পাঠক রয়েছেন, যাঁরা প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অস্বাভাবিক ভিড়ের কথা চিন্তা করে মেলায় আসেন না। প্রতিবন্ধীদের জন্যও শিশুদের মতো করে আলাদা সময়, সুযোগ করে দেওয়া যেতে পারে। তাদের স্বাভাবিক চলাচলের ব্যবস্থা করলে বইমেলা আরো অর্থবহ ও সবার জন্য বইবান্ধব হবে।

বর্তমান সমাজে মর্যাদার মানদণ্ড হচ্ছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, তা সে বৈধ বা অবৈধ যেকোনো উপায়েই হোক না কেন। এমনটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ থেকে উত্তরণের পথই হচ্ছে বই পড়া, বই কেনা আর তার একটি উত্কৃষ্ট অনুঘটক হচ্ছে বইমেলা। এই মেলার প্রসার ঘটাতে হবে রাজধানী থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যন্ত।

মাছুম বিল্লাহ

শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক

(প্রাক্তন ক্যাডেট কলেজ শিক্ষক ও বর্তমানে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত  )

পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন কলেজ পরিচালনা পর্ষদ থেকে ঘুষে অভিযুক্ত সাংবাদিককে বাদ দেওয়ার দাবি - dainik shiksha কলেজ পরিচালনা পর্ষদ থেকে ঘুষে অভিযুক্ত সাংবাদিককে বাদ দেওয়ার দাবি পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0040879249572754