শান্তা (ছদ্মনাম) হুসমায়ূন আহমেদের লেখার ভক্ত। তবে শুধু হুসমায়ূন নন, আরও অনেক লেখকের বই পড়েন তিনি। তাঁর প্রিয় লেখকের তালিকায় যেমন সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক আছেন, তেমনি আছেন ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হক থেকে শুরু করে হাল আমলের শাহাদুজ্জামান, জাকির তালুকদার, শাহনাজ মুন্নী, প্রশান্ত মৃধা, আহমাদ মোস্তফা কামালসহ আরও অনেকে। কয়েক দিন আগে শান্তার হাতে একটি বই এসেছে, বিখ্যাত একটি বই—খোয়াবনামা। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের এই উপন্যাসটি শান্তা পড়তে চাচ্ছিলেন অনেক দিন ধরেই। কিন্তু পড়া যখন শুরু করলেন, গোল বাধল তখনই—পড়া আর এগোয় না। বইয়ের পৃষ্ঠায়, লাইনে লাইনে চোখ বোলান শান্তা, তবে এগোতে পারেন না সামনে; কোথায় যেন আটকে যান। শান্তার মতো এমন সমস্যা আমাদের অনেকেরই ঘটে। একটি বই খুব আগ্রহ নিয়ে পড়তে শুরু করার পরও দেখা যায় পড়া আর এগোচ্ছে না।
কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের জীবনে এই পড়তে পড়তে আটকে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার। তিনি বললেন, ‘আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি পড়ার পর তাঁর আরেকটি বই আইল্যান্ড ইন দ্য স্ট্রিম পড়া শুরু করলাম বেশ আগ্রহ নিয়ে। কিন্তু কয়েক পাতা পড়ার পর আর এগোতে পারিনি।’ জানেন, তখন কী করেছিলেন এই বরেণ্য কথাশিল্পী? বইটি তাকে রেখে দিয়েছিলেন। এরপর পড়েছিলেন আবার। যেসব বই পড়তে পড়তে ‘আটকে’ গেছেন তিনি, সেসব বই ও পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর মন্তব্যটি বেশ সরস। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘হিংটিংছট’ কবিতা থেকে ধার করে তিনি বললেন, ‘ওঠো ভাই, তোলো হাই, শুয়ে পড় চিৎ/অনিশ্চিত এ জগতে সবই অনিশ্চিত।’
তবে কি, যে বই পড়তে পড়তে আটকে যাব সেটি রেখে দিতে হবে? প্রশ্নটি শান্তার মাথায় ঘুরছে বেশ কদিন ধরে।
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই কথা হলো এ সময়ের কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামালের সঙ্গে। তাঁর অভিজ্ঞতাও বেশ মিলে যায় শান্তার সঙ্গে। খোয়াবনামা যখন প্রথমবারের মতো পড়তে শুরু করেছিলেন তিনি, একবারে পড়তে পারেননি, মাঝখানে ‘আটকে’ গিয়েছিলেন। তখন তিনি নিয়েছিলেন এক অভিনব পন্থা। তাঁর ভাষ্যে, ‘নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলাম, এই যে আমি বইটি (খোয়াবনামা) পড়তে পড়তে আটকে গেলাম, এটা কোন কারণে ঘটল—আমার কারণে না লেখকের কারণে, সমস্যাটি আমার না লেখকের? প্রশ্নের জবাবে আমার মন বলল, না, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আমার প্রিয় লেখকদের একজন। তাঁর অন্য লেখাগুলো তো তরতর করে পড়েছি। এখানে পাঠক হিসেবে সমস্যা তাহলে আমারই। এরপর কিছু বিরতি দিয়ে আবার দ্বিগুণ মনোযোগে পড়তে শুরু করলাম খোয়াবনামা। অবাক কাণ্ড! দেখলাম, বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই পড়তে পারছি এবার।’
নিজের পঠন-অভিজ্ঞতা থেকে এ ‘আটকে যাওয়া’ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য বেশ কিছু পরামর্শও দিলেন আহমাদ মোস্তফা কামাল। তাঁর মতে, কোনো বই পড়তে পড়তে আটকে গেলে একে প্রথমত স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই নেওয়া উচিত। তারপর খুঁজে দেখা যেতে পারে কেন, ঠিক কী কী কারণে এটি ঘটল। কামাল বললেন, ‘একটি বই—তা যত বিখ্যাত বা যত প্রিয় লেখকেরই হোক না কেন—সেটি পড়তে সব সময় মন যে একইভাবে প্রস্তুত থাকবে, এমন তো নয়; কখনো কখনো বিপরীত ঘটনাও ঘটতে পারে—বিক্ষিপ্ত থাকতে পারে মন। ফলে পাঠক যখন কোনো বই পড়তে পড়তে আটকে যাবেন, তখন সেটি রেখে দেওয়াই ভালো। পরে সময়-সুযোগমতো আবার পড়া যেতে পারে।’
এ ক্ষেত্রে কিছু কৌশলের আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই ১৪১৩ ’-এর পুরস্কারজয়ী এ লেখক, ‘প্রথমত পুরোনো কোনো প্রিয় বই আবার পড়ার মাধ্যমে মনকে প্রস্তুত করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত যে বই পড়তে পড়তে আটকে গিয়েছি, সে বই কয়েক দিন বন্ধ রেখে নিজেকে আরেকটু সময় দেওয়া যেতে পারে। এ সময় শোনা যেতে পারে গান, দেখা যেতে পারে ভালো কোনো সিনেমা। মোদ্দা কথা, বইটি পড়তে পড়তে আটকে গিয়েছি, এ বিষয়টি মনে না আনাই উত্তম।’
বই পড়তে পড়তে যে ‘আটকাবস্থা’ সেটি নিরসনে আহমাদ মোস্তফা কামালের এসব কথা শুনতে শুনতে আমাদের মনে পড়ছে হাসান আজিজুল হকের মুখনিঃসৃত সরস-বাক্যও, ‘ওঠো ভাই, তোলো হাই, শুয়ে পড় চিৎ…।’