অ্যানেক্স ও সংযুক্ত ক্যাম্পাসের নামে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় ভাড়া বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অবৈধ ক্যাম্পাসও বন্ধ করা হচ্ছে। বন্ধ হচ্ছে ইবাইসের ধানমন্ডি শাখা ও অতীশ দীপংকরের সব অবৈধ ক্যাম্পাস। সবু বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অ্যানেক্স, বর্ধিত ক্যাম্পাস ও সংযুক্ত ক্যাম্পাস’র তালিকা তৈরি করা হচ্ছে।
এই ধরনের নাম ব্যবহার করে প্রায় দুই ডজন বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের খেয়ালখুশি অনুযায়ী ঢাকায় ভাড়া বাড়িতে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এগুলোতে ইচ্ছেমতো শিক্ষার্থী ভর্তি নিয়ে নামকাওয়াস্তে পাঠদান করেই সময়-অসময়ে সনদ ধরিয়ে দেয়া হয় বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অথচ মূল ক্যাম্পাসের বাইরে এই ধরনের ক্যাম্পাস পরিচালনার কোন অনুমোদন নেই।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) হেলাল উদ্দিন সংবাদকে বলেন, ‘কারা আউটার ক্যাম্পাস চালাচ্ছে- সে বিষয়ে একটি তালিকা দেয়ার জন্য আমরা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) নির্দেশ দিতে যাচ্ছি। যারা মামলার অজুহাতে অবৈধ ক্যাম্পাস চালাচ্ছে তারাও এই তালিকায় থাকবে।’ মূল ক্যাম্পাসের বাইরে অন্যত্র শাখা ক্যাম্পাস চালানোর কোন সুযোগ নেই বলেও জানান অতিরিক্ত সচিব।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছে, ‘মূলত অ্যানেক্স ও সংযুক্ত ক্যাম্পাসের নামে অবৈধ আউটার ক্যাম্পাস পরিচালনা করা হচ্ছে। এটি প্রতারণা। প্রশাসনকে বোকা বানানোর চেষ্টা’।
দেশে মোট ৯৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৪৮টিই ঢাকায় স্থায়ী, অস্থায়ী ও ভাড়া বাড়িতে কার্যক্রম চালাচ্ছে। কিন্তু আইনের বরাত দিয়ে ইউজিসি বলছে, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও পরিচালনায় নিমিত্ত প্রদত্ত সাময়িক অনুমতিপত্রে যা, ক্ষেত্রমতে, সনদপত্রে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদিত ক্যাম্পাস যে শহর বা স্থানে স্থাপিত ও পরিচালিত হইবে উহার সুনির্দিষ্ট উল্লেখ থাকিবে।’
হাইকোর্টের রায়ের আলোকে সরকার গত ২৬ জুলাই এক আদেশে বহুল বিতর্কিত দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা এবং সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আউটার ক্যাম্পাস (দূর শিখন) নিষিদ্ধ করেছে।
যেভাবে চলছে অবৈধ ক্যাম্পাস
যেসব বিশ্ববিদ্যালয় ‘অ্যানেক্স’, ‘বর্ধিত ভবন’ এবং ‘বর্ধিত ও সংযুক্ত ক্যাম্পাস’ এর নামে রাজধানীর বিভিন্ন অলিগলিতে অবৈধভাবে ক্যাম্পাস খুলে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে তাদের কার্যক্রমও বন্ধ করা হবে কীনা জানতে চাইলে হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০’ অনুযায়ী অ্যানেক্স, বর্ধিত ক্যাম্পাস- সবই অবৈধ। কারণ এগুলো অনুমোদন নিয়ে করা হয়নি।’
‘ইবাইস ইউনিভার্সিটি’র বিষয়ে গত ২৭ জুন ইউজিসি’র প্রণয়ন করা একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ এর সংশ্লিষ্ট ধারা অনুযায়ী ইউজিসি’র সুপারিশের ভিত্তিতে মূল ক্যাম্পাসের অনুমোদন প্রদান করবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এক্ষেত্রে ইউজিসি কর্তৃক বাড়ি নং-২১/এ, সড়ক নং- ১৬ (পুরাতন-২৭), ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা, ঢাকা-১২০৯ ঠিকানায় অবস্থিত অস্থায়ীভাবে সাময়িক অনুমোদন দেয়া যথাযথ হয়নি।’
এই ইউনিভার্সিটির উদ্যোক্তা প্রফেসর জাকারিয়া লিংকন বলেন, ‘২০০২ সালে আমাকে বাড়ি নং-৫, সড়ক নং-১০ (পুরাতন-২৭), ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা, ঢাকা-১২০৯ ঠিকানায় বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপন ও পরিচালনার সাময়িক অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে জনৈক শওকত আজিজ রাসেল ধানমন্ডির ১৬ নম্বর সড়কের (পুরাতন ২৭) ২১/এ নং- বাড়িতে অননুমোদিত একটি ক্যাম্পাস চালু করে, যা অবৈধ। এ নিয়ে আমি হাইকোর্টে মামলা করেছি।’
ইবাইস ইউনিভার্সিটির ধানমন্ডিতে গড়ে উঠা অবৈধ ক্যাম্পাসটি বন্ধের দাবি জানিয়ে জাকারিয়া লিংকন জানান, ‘আগে ইবাইসের নামে বনানীতেও একটি ক্যাম্পাস চালু করেছিল কিছু অসৎ লোক। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেটি বন্ধ করে দেয়।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায়, ব্যস্ততম সড়কের পাশে মার্কেট, দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁর উপর, এমনকি সিএনজি স্টেশনের উপর খুবই স্বল্পপরিসরে ভাড়া করা ভবনে ক্যাম্পাস খুলে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি করে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মতো কার্যক্রম চালাচ্ছে।
কেউ কেউ নামে-বেনামে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা বা আউটার ক্যাম্পাস খুলে অবৈধভাবে শিক্ষার্থী ভর্তি করে প্রতারণা করছে। বিশ্ববিদ্যালয়কে কেউ কেউ পারিবারিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা, মালিকদের একচ্ছত্র আধিপত্য, অর্থের বিনিময়ে ক্যাম্পাস ভাড়া বা অন্যপক্ষকে লিজ দেয়া এবং অননুমোদিতভাবে আউটার ক্যাম্পাস পরিচালনা ইত্যাদি বিষয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করছে।
এছাড়াও কিছু ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে জমি ক্রয় না করে মালিক বা ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের নামে জমি ক্রয় করেছে। তারা ইচ্ছেমতো বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল তছরুপ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকার রাস্তার পাশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করায় সংশ্লিষ্ট এলাকার আবাসিক পরিবেশ প্রায় বিপন্ন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সীমিতসংখ্যক স্থাপনায় অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা হওয়ায় ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিত ভিআইপি রাস্তা পারাপার করতে হয়। এতে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাস্তায় হরহামেশাই তীব্র যানজট হচ্ছে। চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে পথচারী ও সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে মেয়াদোত্তীর্ণ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে শর্ত পূরণে পুনরায় সময় দেয়ার কোন সুযোগ ছিল না। এরপরও সকল বিশ্ববিদ্যালয়কে কয়েক দফা সময় দেয়া হয়েছে নিজস্ব ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে স্থায়ী সনদ অর্জনের জন্য। সেই অনুযায়ী সরকারের সকল শর্ত পূরণ করে স্থায়ী সনদ অর্জন করেছে মাত্র তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়। বাকিগুলো নানাভাবে সরকারের শর্ত উপেক্ষা করে চলছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
কারা বেশি অবৈধ ক্যাম্পাস চালাচ্ছে
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীতে অবৈধভাবে সবচেয়ে বেশি ক্যাম্পাস চলছে ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে। বিতর্কিত এই প্রতিষ্ঠান হলো দারুল ইহসান, প্রাইম ইউনিভার্সিটি, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, অতীশ দীপংকর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, শান্তমারিয়াম ও আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় দারুল ইহসান ও প্রাইম ইউনিভার্সিটির নামে ৫/৭টি অবৈধ ক্যাম্পাস চলছে। এছাড়াও ঢাকার উত্তরা, খিলগাঁও, গোড়ান ইস্টার্ন হাউজিং বনশ্রী প্রকল্প, যাত্রাবাড়ী, পান্থপথ, মগবাজার, বারিধারা, মিরপুর, মালিবাগ, রামপুরা, মৌচাক, ধানমন্ডি, গুলশান, মতিঝিল, পল্টন এলাকায় কমপক্ষে অর্ধশত ক্যাম্পাসে সনদ বাণিজ্য চলছে। এরমধ্যে ৩৭টিই দারুল ইহসানের। বাকিগুলো প্রাইম ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস।
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর মালিকরা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে উত্তরা, মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ ক্যাম্পাস খুলে সনদ বাণিজ্যে লিপ্ত। ২০১২ সালে এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ছয় হাজার ২০ জন ছাত্রছাত্রীকে অবৈধভাবে উচ্চ ডিগ্রি দেয়ার অভিযোগ উঠে। এই প্রতিষ্ঠানের উপাচার্যের বিরুদ্ধেও অবৈধভাবে ২০ কোটি টাকা মূল্যের বিলাসবহুল বাড়ির মালিক হওয়া এবং এক হাজার ২০০ কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পরবর্তীতে এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। রাজশাহী ও খুলনায়ও এশিয়ানের নামে অবৈধ ক্যাম্পাস চলছে।
জানা গেছে, নিয়মানুযায়ী শাখা ক্যাম্পাসের অনুমোদন দেয়ার এখতিয়ার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু কিছু প্রতিষ্ঠান ইউজিসি থেকে অনুমোদন নিয়ে আউটার ক্যাম্পাস চালু করেছিল। পরে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করায় এসব প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন বাতিল করা হয়। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় রাজধানীর ধানমন্ডি (বাড়ি-২৩, রোড-৩), লিডিং ইউনিভার্সিটির ঢাকা আউটার ক্যাম্পাস (৮৩ সিদ্ধেশ্বরী) এবং ইউআইটিএস কাকরাইলে ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে।
বর্তমানে দেশে অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৯৫টি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকার অনুমোদিত পুরনো ৫১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৪৮টির সাময়িক অনুমোদনের মেয়াদ শেষ হয় ২০০৯ সালের আগস্টে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় সাত বছরের সাময়িক অনুমোদন নিয়ে গত ১৬ বছরে মাত্র তিনটি প্রতিষ্ঠান স্থায়ী অনুমোদনের শর্তগুলো পূরণ করেছে এবং ১০/১৫টি বিশ্ববিদ্যালয় আংশিকভাবে স্থায়ী ক্যাম্পাসে একাডেমিক কার্যক্রম চালাচ্ছে।
বাকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারের নির্দেশনাকে আমলে না নিয়ে ইচ্ছেমতো ভাড়া বাড়িতে শাখা ক্যাম্পাস খুলে নামকাওয়াস্তে একাডেমিক কার্যক্রম সম্পন্ন করে সনদ ধরিয়ে দিচ্ছে।