বাংলাদেশের শিক্ষক সংগঠন শিক্ষক আন্দোলন - দৈনিকশিক্ষা

বাংলাদেশের শিক্ষক সংগঠন শিক্ষক আন্দোলন

শ্যামল কুমার সরকার |

পেশাগত মান উন্নয়ন, সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সমাধানে সংগঠনের কোন বিকল্প নেই। দক্ষ ও কার্যকরী পেশাগত সংগঠন সহজেই তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য নির্ধারণপূর্বক বাস্তবসম্মতভাবে গন্তব্যে পেঁৗছাতে পারে। অবশ্য সব কিছুই নির্ভর করে সংগঠনের কাঠামো ও গতিশীলতার উপর। ব্যবস্থাপনার মূলতত্ত্ব চঙউঝঈঙজই কাজে লাগালে যে কোন সংগঠন অবশ্যই কার্যকরী হয়ে লক্ষ্যবস্তু অর্জনে সহায়ক হয়। বাংলাদেশের শিক্ষক সংগঠন সমূহের নিরিখে দেখা যাক ব্যাপারটি। শিক্ষক সংগঠনের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন শিক্ষক সংগঠন হচ্ছে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (বিটিএ)। এ সংগঠনটি অল বেঙ্গল টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন (এবিটিএ) নামে ব্রিটিশ ভারতে ১৯২১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেয়া সংগঠনের উত্তরাধিকার। ১৯২১ সালের মার্চে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার রংপুর জেলার গাইবান্ধা মহকুমায় উক্ত শিক্ষক সংগঠনের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল চন্দ্র রায় উক্ত সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। উলি্লখিত সম্মেলনের মাধ্যমে রাজ সাহেব ঈশান চন্দ্র ঘোষ এবং মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯২১ সালে অল বেঙ্গল টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন (এবিটিএ) রেজিষ্ট্রেশন পায় এবং একই সালের সেপ্টেম্বর থেকে সংগঠনের মাসিক প্রকাশনা ‘টিচার্স জার্নাল’ প্রকাশ করতে থাকে।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পরে অল বেঙ্গল টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন (এবিটিএ) পূর্ববঙ্গে ইস্ট বেঙ্গল টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন (ইবিটিএ) নাম ধারণ করে। ১৯৫৬ সালে ইবিটিএ নাম পরিবর্তন করে ইস্ট পাকিস্তান টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন (ইপিটিএ) রূপ ধারণ করে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হলে ইপিটিএ বাংলাদেশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) নামে নতুনভাবে পরিচিতি পায়। ১৯৮৬ সালে পেশাগত ন্যায্য দাবি আদায়ে বিটিএ ৫৮ দিন কর্মবিরতি পালন করে। সে সময় মাধ্যমিক শিক্ষকরা চলমান এসএসসি পরীক্ষায় ইনভিজিলেটরের দায়িত্ব পালন থেকেও বিরত থাকেন।

কিন্তু তখনকার স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী উক্ত আন্দোলনকে সামান্য আমলেও নেননি। ১৯৯২ সালে অন্য ছয়টি বেসরকারি শিক্ষক সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘কেন্দ্রীয় শিক্ষক সংগ্রাম লিয়াজোঁ কমিটি’। ১৫ দফা দাবি আদায়ে ওই সালে কর্মবিরতিসহ শিক্ষক আন্দোলন হয় এবং এর ফলে দাবি-দাওয়া আংশিক পূর্ণ হয়। উলি্লখিত শিক্ষক লিয়াজোঁ কমিটি ১৯৯৪ সালে দীর্ঘ দুই মাসব্যাপী ঐতিহাসিক শিক্ষক আন্দোলন সংগঠিত করে। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিদানের মাধ্যমে উক্ত শিক্ষক আন্দোলনের সাময়িক অবসান হলেও শিক্ষকদের অধিকাংশ দাবি-দাওয়াই অবাস্তবায়িত থেকে যায়।

২০০২ সালে বিটিএ, অন্য তিনটি শিক্ষক সংগঠন এবং একটি কর্মচারী সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ শিক্ষক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ’ এবং পনের দফার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। একইভাবে ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে শিক্ষক আন্দোলন হয় এবং আংশিক দাবিনামা পূর্ণ হয়। ২০০০ সাল থেকে বিটিএ বিশ্ব শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন (ঋওঝঊ/ডঋঞট- ১৯৪৬) এর সদস্য।

১৯৮৪ সালের ৪ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) জন্ম নেয় নতুন ধারার শিক্ষক সংগঠন বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (বাকবিশিস/ইঈটঞঅ)। প্রফেসর ড. এম আখতারুজ্জামান, প্রফেসর ড. রঙ্গলাল সেন, প্রফেসর ড. অজয় রায়, প্রফেসর ড. হায়াৎ মামুদ, প্রফেসর আলী আনোয়ার, প্রফেসর ড. নুর মোহাম্মদ তালুকদার এবং প্রফেসর যতিন সরকারসহ অন্যান্য শিক্ষাবিদগণ বাকবিশিস গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (বাকবিশিস) এর জন্মের ইতিহাস থেকে জানা যায় অল ইন্ডিয়া ফেডারেশন অব ইউনির্ভাসিটি অ্যঠন্ড কলেজ টিচার্স অর্গানাইজেশন (আইফুক্টো/অওঋটঈঞঙ-১৯৬২) এবং অল বেঙ্গল কলেজ-ইউনির্ভাসিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন (অইঈটঞঅ) এর আদলে এর জন্ম। উল্লেখ্য, অইঈটঞঅ এর জন্ম অবিভক্ত বাংলার কোলকাতায় ১৯২৬ সালে। এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট রসায়নবিদ আচার্য প্রফুল চন্দ্র রায়। আর এই সংগঠনের দ্বিতীয় সভাপতি ছিলেন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক স্যার সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন। ১৯৭৩ সালে এদেশে ৪৯ দিন শিক্ষক ধর্মঘট পালিত হয়। বাকবিশিস ১৯৯৮ সালের দুই মাসের আন্দোলনে, ১৯৯৪ সালের ৬৫ দিনের আন্দোলনে, ১৯৯৪ সালের ১০ দিনের আমরণ অনশনে, ২০০৩ সালের দীর্ঘ ৪৭ দিনের শিক্ষক ধর্মঘটে, ২০১২ এবং ২০১৩ সালের ১৭ দফার শিক্ষক আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। আশানুরূপ না হলেও ২০১২ এবং ২০১৩ সালের শিক্ষক আন্দোলনে বাড়ি ভাড়া ভাতা ও চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধি পায়। এভাবে আন্দোলনের ফলে বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন ১৯৯৪ সালে ৭০% হতে ৮০% এ, ২০০০ সালে ৮০% হতে ৯০% এ, ২০০৬ সালে ৯০% হতে ৯৫% এ এবং ২০০৭ সালে ৯৫% হতে ১০০% এ উনি্নত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা ১৯৮০ সালে প্রথম এমপিওভুক্ত হন। বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (ইঈটঞঅ) ১৯৮৪ সাল থেকে বিশ্ব শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন (ঋওঝঊ/ডঋঞট-১৯৪৬) এর সদস্য।

পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি (ইঈঞঅ) জন্ম লাভ করে। ১৯৯৬ সালে জন্ম নেয় বাংলাদেশ বেসরকারি কারিগরি শিক্ষক সমিতি (ইঞঞঅ)। তবে হতাশার বিষয় হলো, দেশের সর্বপ্রাচীন ও সর্ববৃহৎ শিক্ষক সংগঠন বিটিএ ইতিমধ্যেই ভেঙ্গে দু টুকরো হয়ে গেছে। এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদাগার করছে। বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এবং বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতির মধ্যে মতবিরোধ তুঙ্গে। বর্তমান সরকার প্রথম দফায় ক্ষমতায় আসার পরে বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির পুরানো নেতৃত্বের দাবিদার একটি অংশ নতুন ভাবে বাকবিশিস এর কার্যক্রম চালানো শুরু করেছে। অর্থাৎ বাকবিশিস (১৯৮৪) এর বিভক্তি শুরু হয়ে গেছে। এই অংশটি ২০১৫ সালে জাতীয় সম্মেলন সম্পন্ন করেছে। বর্তমান সরকারের আমলে এদেশে সর্বশেষ জন্ম নিয়েছে স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ নামের একটি সংগঠন। বাংলাদেশ বেসরকারি কারিগরি শিক্ষক সমিতির সভাপতি সর্বশেষ গঠিত শিক্ষক সংগঠনটিরও সাধারণ সম্পাদক। এগুলো ছাড়াও রয়েছে দেশে প্যাডসর্বস্ব আরও ২০টি শিক্ষক সংগঠন। এসব সংগঠনের কোনো কর্মিসভা ও সম্মেলন চোখে পড়ে না। রহস্যজনক ভাবে পত্রিকার মাধ্যমে মাঝেমধ্যে এদের অস্তিত্ব আছে বলে জানা যায়। হ্যালির ধূমকেতুর মতই প্যাড সর্বস্ব শিক্ষক সংগঠন সমূহ যে কোন শিক্ষক আন্দোলনের চরম সময়ে মিডিয়ার সামনে এসে হাজির হয়। আর এর সুযোগ নেয় রাজনৈতিক সরকার। যেমনটি হয়েছিল ২০০০ সালে। শিক্ষক স্বার্থ বিরোধী বেশ কিছু চুক্তিতে সে সময় স্বাক্ষর করেছিল ২৪টি শিক্ষক সংগঠন। সরকারি প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক সংগঠন থাকলেও এগুলো নানাভাবে বিভক্ত এবং বাস্তবিক পক্ষে সরকারের বিরুদ্ধে এদের তেমন কিছু করারও নেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকরা অনেকটাই ভালো আছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রফেসর পদে সকল শিক্ষক না যেতে পারলেও সহযোগী অধ্যাপক পর্যন্ত সবাই যেতে পারেন।

আবার পর্যাপ্ত না হলেও বাংলাদেশের শিক্ষকদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই সর্বোচ্চ বেতন স্কেল ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন।

অবিভক্ত বাংলা, পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশের সত্তরের দশকের শিক্ষকদের সাথে তুলনা করলে বর্তমানের সবস্তরের শিক্ষকরা নিঃসন্দেহে অনেক ভালো আছেন। কাঠের ছাতা, টর্চ, পবিত্র কোরআন শরীফ, জায়নামাজ আর পবিত্র গীতা হাতে আমাদের শিক্ষকদের বিদায় নিতে দেখেছি। সময় বদলেছে। এখন দেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষক, কর্মচারীরা নিজ নিজ স্কেলের শতভাগ সরকারি কোষাগার থেকে পান। যথেষ্ট না হলেও ২০০৪ সাল হতে বছরে দুটি উৎসব ভাতা (শিক্ষক ২৫% এবং কর্মচারী ৫০%), আংশিক চিকিৎসা ভাতা ও আংশিক বাড়ি ভাড়া ভাতা পান, যা আমাদের বেশির ভাগ শিক্ষাগুরুদের ভাগ্যে জোটেনি। শিক্ষকদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ২০০২ সালে অবসর সুবিধা তহবিল এবং ২০০৫ সালে বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারীদের জন্য কল্যাণ ট্রাস্ট এবং গঠিত হয়েছে। ফলে কর্মজীবন শেষে আজকাল একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীকে আর খালি হাতে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে ঘরে ফিরতে হয় না। বরং তারা মোটামুটি বাঁচার মতো এককালীন টাকা পাচ্ছেন। তবে এ টাকা পেতেও শিক্ষক-কর্মচারীদের ৫/৭ বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে। প্রায় ৭০ হাজার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীর আবেদন অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টে পড়ে আছে। ২০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হলেই অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টের সমস্যা মিটে যায়। অথচ সরকার এ ব্যাপারে নির্বিকার। অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্ট বাবদ এতদিন শিক্ষক কর্মচারীদের বেতনের ৬% কাটা হলেও জুন/২০১৭ এ ১০% কাটার সিদ্ধান্ত হওয়ায় এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীরা আন্দোলন করছেন। শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবির মধ্যে আরে ৫% বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট, পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, এবং বাড়ি ভাড়া ভাতাসহ শিক্ষা ব্যবস্থার জাতীয়করণ। উল্লেখ্য, দেশের ৩৮,১৫৮টি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৭,৭২২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত। আন্দোলনরত শিক্ষকরা ৩ দিনের মধ্যে ১০% কর্তনের প্রজ্ঞাপন বাতিলের আল্টিমেটাম দিয়েছেন। অন্যদিকে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য-সচিব (যিনি বাংলাদেশ বেসরকারি কারিগরি শিক্ষক সমিতির সভাপতি এবং নবগঠিত স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক) বলছেন সবার সঙ্গে আলোচনা করেই ১০% কাটার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অথচ বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (বাকবিশিস) এবং বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (বিটিএ) ১০% কাটার ব্যাপারে কিছুই জানে না। বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (বাকবিশিস)’র কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্য হিসেবে এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তাহলে ১০% কাটার আলোচনাটি হলো কার সঙ্গে?

বাংলাদেশের শিক্ষকরা ভেদাভেদ ভুলে ও সরকারের লেজুড়বৃত্তি না করে একই প্লাটফর্মে এসে পেশাগত দাবি-দাওয়া আদায়ে একমত হতে পারলে আরও আগেই সামাজিক ও আর্থিক অবস্থানে অনেক উঁচুতে উঠতে পারতেন। যেমনটি পেরেছে সর্বভারতীয় শিক্ষক সংগঠন অল ইন্ডিয়া ফেডারেশন অব ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড কলেজ টিচার্স অর্গানাইজেশন (আইফুক্টো/অওঋটঈঞঙ)। জানা যায় ভারতের উত্তর প্রদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও সংগঠক প্রফেসর হৃদয় নারায়ণ সিং এবং রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রফেসর ভি ভি জন এর নেতৃত্বে অওঋটঈঞঙ গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয় এবং ১৯৬১ সালের ২৯ ডিসেম্বর এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ১৯৬১ সালেই সংগঠনের জন্য সংবিধান রচিত হয় এবং ১৯৬২ সালে বেনারস সম্মেলনের মাধ্যমে অওঋটঈঞঙ যাত্রা শুরু করে।

AIFUCTO এর জন্মের আগে ভারতে উচ্চ শিক্ষার শিক্ষকরা প্রাইভেট কলেজ, সরকারি কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদান করতেন। কিন্তু তাদের বেতন-ভাতায় ছিল ব্যাপক বৈষম্য। সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তাদের মতো আর্থিক সুবিধা পেতেন। আবার বিভিন্ন রাজ্যের সরকারি কলেজের শিক্ষকরা সংশ্লিষ্ট রাজ্যের সরকারি কর্মকর্তাদের মতো আর্থিক সুবিধা ভোগ করতেন। রাজ্যের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রাজ্য সরকারের সুযোগ-সুবিধা পেতেন। পক্ষান্তরে বিভিন্ন রাজ্যের বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের অবস্থা ছিল খুবই করুন। উক্ত শিক্ষকরা পূর্ণ বেতন পেতেন না, বেতন যথাসময়ে পেতেন না। এমনকি তাঁরা চিকিৎসা ভাতা, বাড়ি ভাড়া ভাতা এবং চাকরি শেষে পেনশন ও গ্র্যাচুইটিও পেতেন না। এসব ব্যাপারে অওঋটঈঞঙ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। সংগঠনটি সারা ভারতের (২৯টি রাজ্য) কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এক কাতারে আনতে সক্ষম হয়। বিশেষ করে প্রাইভেট কলেজের শিক্ষকদের জন্য উক্ত সংগঠন অভাবনীয় সাফল্য নিয়ে আসে।

AIFUCTO একাধিকবার ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ওটএঈ) এর সঙ্গে আলোচনায় বসে ট্রেড ইউনিয়নের মতো করে দর কষাকষির মাধ্যমে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধাসহ পদোন্নতির ব্যবস্থা নিশ্চিত করে। এক্ষেত্রে অওঋটঈঞঙ এর দীর্ঘদিনের সাধারণ সম্পাদকদ্বয় প্রফেসর অমিয় দাশগুপ্ত (পূর্ব পাকিস্তান থেকে যাওয়া, ১৯৭০-১৯৮০) এবং প্রফেসর মৃন্ময় ভট্টাচার্যের (পূর্ব পাকিস্তান থেকে যাওয়া, ১৯৮০-১৯৯৯) নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণযোগ্য। অওঋটঈঞঙ ১৯৮৮ সালে সর্বভারতে ৪৩ দিনব্যাপী এবং ১৯৯৮ সালে ৩৬ দিনব্যাপী শিক্ষক ধর্মঘট পালন করে এবং যৌক্তিক দাবি মেনে নিতে ওটএঈ এবং সরকারকে বাধ্য করে।

এর ফলশ্রুতিতে ২০০৬ সালে ভারতের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রফেসর পদমর্যাদা ও বেতন-ভাতার ব্যাপারে নিশ্চিত হন। একই শিক্ষাগত যোগ্যতার ফলে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে পদমর্যাদা ও বেতন-ভাতা নিয়ে সেখানে কোন ভেদাভেদ নেই। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ভারতের ওয়েস্ট বেঙ্গল কলেজ-ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনও (ডইঈটঞঅ) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অধ্যাপক অমিয় দাশগুপ্ত (পূর্ব পাকিস্তান থেকে যাওয়া) সংগঠনটির জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

২০০৬ সালের বেতন স্কেল অনুযায়ী ভারতের একজন সহকারী অধ্যাপক ১৫,৬০০ – ৩৯,১০০ + গ্রেড পে ৬৬০০, সিনিয়র সহকারী অধ্যাপক ১৫,৬০০ – ৩৯,১০০ + গ্রেড পে ৭২০০, সিলেকশন গ্রেড সহকারী অধ্যাপক ১,৫৬০০-৩৯,১০০ + গ্রেড পে ৮০০০ (সিলেকশন গ্রেড প্রাপ্তির ৩ বছর পর), সহযোগী অধ্যাপক ৩৭,৪০০ – ৬৭,০০০ + গ্রেড পে ৯০০০ এবং প্রফেসর ৩৭,৪০০ – ৬৭,০০০ + গ্রেড পে ১০,০০০ রূপি পান। এছাড়াও ভারতের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ১০% হতে ৩০% পর্যন্ত বাড়ি ভাড়া ভাতা এবং চিকিৎসা ভাতা পান। চাকরির প্রথম পর্যায়েই ভারতের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ১৭/১৮ হাজার রুপি এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ৩০/৪০ হাজার রুপি বেতন পান।

AIFUCTO ভারতের অবসরপ্রাপ্ত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সমস্যা সমাধানেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। সেখানকার সিলেকশন গ্রেড লেকচারার (কমপক্ষে ৩ বছর চাকরি) পদমর্যাদার একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মাসিক প্রায় ৩০,০০০ রুপি পেনশন পান। আমাদের দেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধার দিকে তাকালে খুব সহজেই বিরাজমান বৈষম্য ধরা পড়বে। ফেডারেল রাষ্ট্র ভারতের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের বেশির ভাগ অধ্যাপক ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করেন। আর আমাদের দেশের একই পর্যায়ের বেশির ভাগ অধ্যাপক গণপরিবহনে চলাফেরা করেন। একমাত্র পেশাগত সহাবস্থানই ভারতীয় শিক্ষকদের অধিকার আদায়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। কংগ্রেস-বিজেপি-তৃণমূল-সিপিএম সমর্থনকারী শিক্ষকরাও পেশাগত দাবি আদায়ে অবিচল ও এক। ভারতের মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি বেশ সক্রিয়। এমনকি ভারতের নিখিল বঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতিও অনেক শক্তিশালী।

আর আমরা নৌকা, ধানের শীষ, কাস্তে আর দাড়ি পাল্লায় ভাসতে ভাসতে বিলীন হওয়ার পথে। ভারতের ওডিশা রাজ্যে ২০১২ সালে উচ্চশিক্ষা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সেমিনারে ও নিউ দিলি্লতে ২০১৫ সালে ঋওঝঊএর ১৮তম স্ট্যাটুটরি কনফারেন্স ও আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ গ্রহণের সুবাদে এবং বিভিন্ন সময়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক শিক্ষক সম্মেলনে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে শুধুই মনে হয়েছে অওঋটঈঞঙ এর মতো দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী ও নেতৃত্বদানকারী শিক্ষক সংগঠন আমাদের দেশে কবে হবে? ভারতের পশ্চিম বঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, বিহার, ওডিশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, কেরালা, কর্ণাটক এবং নিউ দিলি্লর মতো নিবেদিতপ্রাণ ও পেশাজীবী শিক্ষক সমাজ আমরা কখন পাব? আর কবেইবা বাস্তবায়িত হবে আমাদের মহান সংবিধানের ১৭ ও ১৯তম ধারা? আসন, পদ-পদবি আর ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির হিসেব ও ভেদাভেদ ভুলে দেশের সকল শিক্ষক সংগঠন পেশাগত দাবি আদায়ে এক কাতারে দারাই। রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতা থাকতেই পারে। কিন্তু পেশাগত মর্যাদা রক্ষার ও জীবিকার আন্দোলনে আমাদের এক হতেই হবে। রাজনৈতিক দলের পকেটের বাসিন্দা হলে শিক্ষক আন্দোলন কখনই সফল হবে না। শিক্ষক-কর্মচারীদের বঞ্চনা চলতেই থাকবে।

[লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঝিট্কা খাজা রহমত আলী ডিগ্রি কলেজ, হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ]

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.02764105796814