শিক্ষায় ইদানিং আমাদের দেশের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। শিক্ষায় অভাবিত সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরুপ আমাদের শিক্ষামন্ত্রি আজ জাতিসংঘের ইউনেস্কোর ভাইস প্রেসিডেন্ট। জাতিসংঘের মহাসচিব থেকে শুরু করে বিশ্বের অনেকে অবাক হন এই ভেবে যে, বাংলাদেশে বছরের প্রথম দিনেই দেশের মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীর হাতে সরকার এক যোগে বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক তুলে দেয় কিভাবে ? নিঃসন্দেহে এ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। জানিনা, পৃথিবীর ক’টি দেশ এ কঠিন কাজটি করতে পেরেছে ?
আমাদের স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ ছাত্র-ছাত্রীদের উপচে পড়া ভীড়। এই তো মাত্র ক’বছর আগে পর্যন্ত আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা ছিল একেবারে নগন্য । মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা হাতে গোণা পর্যায়ে ছিল। কিন্তু আজ এ ক্ষেত্রে অনন্য এক বিপ্লব সাধিত হয়েছে। আজ স্কুলে পড়াশুনা করার বয়েসী কোনো মেয়ে আর ঘরে বসে থাকে না।সকলে স্কুলে ছুটে চলে।
এ সবের সাফল্য কার ? নিশ্চয় এ সাফল্য ও কৃতিত্বের বহুলাংশে দাবিদার আমাদের রাষ্ট্র তথা সরকার। আমাদের দেশে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই প্রাথমিক শিক্ষাকে সার্বজনীন ও বাধ্যতামুলক ঘোষণা করা হয়। সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ও সার্বজনীন করার সুফল আজ ঘরে তুলছে। নারী শিক্ষাকে আজ আমাদের দেশে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হচ্ছে। আমাদের দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে আজ ৭৫% মহিলা শিক্ষক।তাঁরা মায়ের কিংবা বড় বোনের মমতা ও স্নেহ দিয়ে শিশু শিক্ষার্থীদের পাঠদান করেন। এ ছাড়া উপবৃত্তি প্রকল্পে প্রথম প্রথম কেবল ছাত্রীদের টাকা দেবার কারণে লেখাপড়ায় মেয়েদের এমনকি এ বিষয়ে তাদের অভিভাবকদের আগ্রহ বহুগুণে বেড়ে যায়। উপরন্তু, পাঠ্যবই সরকার থেকে বিনামূল্যে পাবার কারণে মা- বাবা সকল ছেলে মেয়েকে লেখাপড়া করানোর ব্যাপারে অধিক আগ্রহ দেখাতে থাকেন। এর ফলে দিনে দিনে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সূচিত হতে আরম্ভ করে। বাল্য বিবাহ বহুলাংশে নিরোধ হয়। কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতভাবে বৃদ্ধি পায়। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ পার্শ্ববর্তি অনেক দেশকে পেছন ফেলে এগিয়ে যায়। শুধু তাই নয়, উন্নয়নের অন্যান্য কয়েকটি সূচকে ও বাংলাদেশ ইতোমধ্যে চীন, জাপান ইত্যাদি দেশের পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।
এখন পর্যন্ত আমাদের শিক্ষায় চারটি স্তর। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষাস্তর। প্রাথমিক শিক্ষা স্তর বাধ্যতামূলক ও সার্বজনীন করার ফলে আমাদের শিক্ষায় বিপ্লব সূচিত হয়েছে। এ স্তরের লেখাপড়া অবৈতনিক হওয়ায় এর সুফল বেশী বেশী আমরা পাচ্ছি।
মাত্র বছর কয়েক পূর্বে ও আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে চিঠি পত্র পড়ার মতো লোকের অভাব ছিল। সে দৈন্যদশা অবশ্য এখন আর আমাদের নেই। এখন প্রত্যেক গ্রামে দু’ চার জন বিএ-এমএ পাস লোকের দেখা পাওয়া ভার নহে। নারী শিক্ষার হার যতই বাড়ছে, আমাদের উন্নতি ততই প্রসারিত হচ্ছে।
শিক্ষা যে কোনো মানুষের জন্মগত একটি মৌলিক অধিকার। মানুষ ও পশুর মধ্যে তফাত রচনা করে একমাত্র শিক্ষা। তাই মানব জীবনকে সাফল্য মন্ডিত করার ক্ষেত্রে শিক্ষাই হচ্ছে একমাত্র মাধ্যম ।
নাগরিকের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের এক অপরিহার্য দায়। এ দায়বোধ থেকেই রাষ্ট্র তার সামর্থানুযায়ী নাগরিকের শিক্ষার সকল আয়োজন ও বন্দোবস্ত করে থাকে।
রাষ্ট্র তথা সরকার নাগরিকের শিক্ষার অধিকার সুপ্রসন্ন করে দেয়। প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ, আবশ্যকীয় শিক্ষাপোকরণ সরবরাহ, যুগোপযোগী কারিকুলাম ও সিলেবাস প্রণয়ন থেকে শুরু করে শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সকল কাজই সরকারের অপরিহার্য দায়িত্ব।
আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে পাহাড় সম বৈষম্য বিদ্যমান। বিশেষ করে আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষায় বিদ্যমান বৈষম্য শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের সামগ্রিক সাফল্যকে ম্লান করে তুলে। একই কারিকুলাম ও সিলেবাসের আওতায় থেকে কেউ সরকারি আর কেউ বেসরকারি। সরকারি- বেসরকারি দ্বন্ধে জর্জরিত আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর। সরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীরা এক ধরণের সুযোগ- সুবিধা আর বেসরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীগণ ভিন্ন ধরণের সুবিধা ভোগ করে। বেসরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীগণ যেখানে মাসিক টিউশন ফি ন্যুনতম ১০০ টাকা দেয়, সেখানে সরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীরা দেয় সর্বোচ্চ পনের টাকা। এ স্তরে কর্মরত শিক্ষক- কর্মচারী কেউ মাসের ১ তারিখে বেতন পান আর কেউ নিজের বেতনটুকু পাবার নির্দিষ্ট তারিখটা পর্যন্ত জানেন না। কেউ বাড়ী বাড়া ৫০% আর কেউ সাকুল্যে ৫০০ টাকা পান। তা আবার অধ্যক্ষ যা পান, পিয়ন ও তা-ই। সাম্যের এ কী চমৎকার উদাহরণ! কেউ চিকিৎসা ভাতা ৩০০ টাকা আর কেউ ১৫০০ টাকা। প্রথমোক্ত জনের হোমিওপ্যাথিক ঔষধেই সারে বুঝি!
উক্তরুপ অসংখ্য অসঙ্গতি আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরকে কুরে কুরে খেয়ে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।শিক্ষার সর্বোচ্চ সুফল পেতে আমাদের দেশে মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরকে বাধ্যতামূলক ও সার্বজনীন করার এখনই উপযুক্ত সময়।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে সার্বজনীন ও বাধ্যতামূলক করায় আমরা এর সুফল ভোগ করতে শুরু করেছি। আমাদের দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে অনেক। স্বাক্ষরতার হার আমাদের দেশে ৬১% বলা হলে ও বাস্তবে তা অনেক উপরে চলে গেছে। খুব শীঘ্রই আমরা একটি নিরক্ষরতা মুক্ত বাংলাদেশ পেতে যাচ্ছি।
আমাদের অনেক সময় গড়িয়ে গেছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর আমরা দীর্ঘ পথ পরিক্রমা পাড়ি দিয়ে এসেছি। স্বনির্ভর দেশ গড়ার জন্য তা একেবারে কম সময় নহে। কিন্তু আমরা এখনো স্বাধীনতার সুফল ষোল আনা অর্জন করতে পারিনি।
অবশ্য আমরা এখন আর খুব একটা পিছিয়ে ও নেই। আমাদের জাতীয় উৎপাদন ও জাতীয় আয় যেমন বেড়েছে, তেমনি আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। আমাদের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। শিশু মৃত্যু ও মাতৃ মৃত্যুর হার বহুগুণে হ্রাস পেয়েছে। ডায়রিয়া রোগে এখন আর গ্রাম সাবাড় হয় না। গুটি বসন্ত কিংবা চোখ উঠা রোগের জন্য এখন আর গ্রামের লোকজন হুকার পানির সন্ধান করে না। গ্রামে এখন ছনের বা খড়ের চালার ঘর তেমন একটা চোখে পড়ে না। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিদ্যুত পৌঁছে গেছে। এখন গ্রামের লোকজন ডিস এন্টিনায় বিভিন্ন চ্যানেল দেখতে পায়।সর্বত্রই অনেকটা আধুনিকতার ছোঁয়া।
আমাদের সরকার তথা রাষ্ট্রের সঙ্গতি বেড়েছে অনেক। যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। গ্রামে গঞ্জে পাকা রাস্তা হচ্ছে। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশের হাতছানি দেখছি আমরা। আমাদের সরকার বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ কে চ্যালেঞ্জ দিয়ে সাড়ে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ স্বপ্নের পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ নিজস্ব অর্থায়নে শুরু করে দিয়েছে। এ এখন শুধু স্বপ্ন নয়,বাস্তবের প্রায় কাছাকাছি। আমাদের ঢাকা শহরের সৌন্দর্যে অনেক বিদেশীর চোখ ও ছানাবড়া হয়ে যায়। ঢাকার ফ্লাই ওভারগুলো দেখলে কে না বলবে, আমরা খুব দ্রুত মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছতে যাচ্ছি। ২০৪১ সালে আমরা উন্নত দেশের পর্যায়ে উন্নীত হবো। এ আমাদের রাষ্ট্রীয় তথা জাতীয় অঙ্গিকার। মাধ্যমিক শিক্ষাকে সার্বজনীন ও বাধ্যতামুলক করেই তবে আমরা মধ্যম আয়ের দেশকে অতিক্রম করে উন্নত দেশের সোপানে উন্নীত হতে পারবো। প্রাথমিক শিক্ষাকে সার্বজনীন ও বাধ্যতামুলক করে আজ যেমন আমরা মধ্যম আয়ের দেশে রুপান্তরিত হতে যাচ্ছি,তেমনি মাধ্যমিক শিক্ষাকে সার্বজনীন ও বাধ্যতামুলক করে তবেই আমরা উন্নত দেশের সারিতে পৌঁছতে সক্ষম হবো। অন্যথায় তা হবে দূর্গম এক বন্ধুর পথ।
লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট।